আধুনিক সমাজে সম্পর্ক ও বিবাহের মতো প্রতিষ্ঠান যেভাবে দ্রুত অবক্ষয়ের মুখে পড়ছে, তা নিঃসন্দেহে অভূতপূর্ব। আজকের দিনে সিঙ্গেলহুডকে অনেক সময় স্বেচ্ছায় বা পছন্দমতো একক জীবন এবং আধুনিক জীবনের স্বাধীনতা ও স্বনির্ভরতার প্রতীক হিসেবেও ধরা হয়। তবে কিছু বিশেষ সমাজে এটি সামাজিক একাকিত্ব বা বিচ্ছিন্নতার মতো নেতিবাচক দৃষ্টিকোণেও দেখা হয়। উন্নত বিশ্বে ‘সিঙ্গেলহুড’ যেন এক নতুন নীরব মহামারির রূপ নিয়েছে।
২৫ থেকে ৩৪ বছর বয়সি আমেরিকানদের মধ্যে কোনো সঙ্গী ছাড়াই বসবাসকারী পুরুষের সংখ্যা গত পাঁচ দশকে দ্বিগুণ হয়ে ৫০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। নারীদের ক্ষেত্রেও এই হার ৪১ শতাংশ।
দ্য ইকোনমিস্ট-এর তথ্য বলছে, ২০১০ সালের পর ধনী বিশ্বের ৩০টি দেশের মধ্যে ২৬টিতেই একা বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। আর ২০১৭ সালের মতো জুটি গঠনের হার বজায় থাকলে আজ অন্তত ১০ কোটি কম সিঙ্গেল মানুষ থাকত। অর্থাৎ, বিশ্বজুড়ে চলছে এক বৃহৎ সম্পর্ক–মন্দা।
সিঙ্গেলহুড: অবক্ষয় নাকি মুক্তি?
এই প্রবণতাকে কেউ দেখছেন নৈতিক অবক্ষয় হিসেবে, আবার কেউ দেখছেন ব্যক্তিগত স্বাধীনতার বিজয় হিসাবে। ফ্যাশন ম্যাগাজিন ভোগ যেখানে এটিকে ‘আত্মনির্ভরতার প্রতীক’ আখ্যা দিয়েছে, সেখানে আধুনিক উচ্চাভিলাষী নারীদের জন্য বয়ফ্রেন্ড রাখা পর্যন্তকে ‘লজ্জাজনক’ বলা হয়েছে।
বাস্তবতা হচ্ছে—সিঙ্গেলহুডকে ‘শুধু ভালো’ বা ‘শুধু খারাপ’—কোনো একক ব্যাখ্যায় ফেলা যায় না। কর্মক্ষেত্রে নারীদের অগ্রগতি এবং আর্থিক স্বাধীনতা তাদের সম্পর্ক বাছাইয়ের ক্ষমতা বাড়িয়েছে।
নারীরা যত স্বাধীন হচ্ছেন, তত কম রাজি হচ্ছেন অযোগ্য, আলসেমি-কাতর বা নির্যাতনকারী সঙ্গীর সঙ্গে জীবন কাটাতে।
কিন্তু এর উল্টোপিঠও আছে। একা থাকার স্বাধীনতা যেমন মুক্তির স্বাদ দেয়, তেমনই এনে দেয় গভীর নিঃসঙ্গতা।
মানুষ কি সত্যিই সিঙ্গেল থাকতে চায়?
অনেক সিঙ্গেল নারী-পুরুষ বললেও যে তারা সুখী—জরিপের তথ্য বলছে ভিন্ন কথা।
বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে, ৬০-৭৩ শতাংশ মানুষ আসলে সম্পর্কে থাকতে চান।
২০১৯ সালের যুক্তরাষ্ট্রের এক জরিপে দেখা যায়—যদিও ৫০ শতাংশ সিঙ্গেল সক্রিয়ভাবে সঙ্গী খুঁজছিলেন না, কিন্তু তাদের মধ্যে মাত্র ২৭ শতাংশ বলেছেন যে তারা সিঙ্গেল থাকতে উপভোগ করেন।
অন্যরা হয় প্রত্যাশামাফিক সঙ্গী পাননি, অথবা সম্পর্কের ‘বাজারে’ নিজেদের উপযোগী মানুষ খুঁজে পাচ্ছেন না।
সম্পর্কের বাজারে গড়মিল কেন?
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন কয়েকটি কারণ বড় ভূমিকা রাখছে:
১. সোশ্যাল মিডিয়া ও ডেটিং অ্যাপের অবাস্তব প্রত্যাশা
ডেটিং অ্যাপ মানুষকে ‘অতিরিক্ত পছন্দ’ দিয়েছে, যা মানুষকে খুঁতখুঁতে এবং অস্থির করে তুলেছে।
ফল—যারা সম্পর্কে যেতে চান, তারাও সঙ্গী নির্বাচন নিয়ে দোটানায় পড়ে যাচ্ছেন।
২. রাজনৈতিক বিভাজন
তরুণ ছেলেরা ডানপন্থী আফসনে ঝুঁকছে, মেয়েরা বামপন্থী।
এই বাড়তে থাকা মতাদর্শগত দূরত্ব নতুন প্রেম-সম্পর্ককে কঠিন করে তুলছে।
৩. সামাজিক দক্ষতার অভাব
স্ক্রিনভিত্তিক জীবনে বেড়ে ওঠা তরুণদের একাংশ মুখোমুখি যোগাযোগে দুর্বল হয়ে পড়ছে।
এটি দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্কে যাওয়ার আত্মবিশ্বাস কমিয়ে দিচ্ছে।
৪. নারীদের প্রত্যাশার বৃদ্ধি, পুরুষদের পিছিয়ে পড়া
নারীরা চান—সঙ্গী হবে সুশিক্ষিত, অর্থনৈতিকভাবে স্থিতিশীল।
কিন্তু বহু দেশে পুরুষরা শিক্ষায় ও কর্মক্ষেত্রে নারীদের তুলনায় পিছিয়ে পড়ছে।
ফলে প্রত্যাশা ও বাস্তবতার মধ্যে ফাঁক বাড়ছে।
উন্নত দেশেও একই প্রবণতা
নর্ডিক দেশগুলো—ফিনল্যান্ড, সুইডেন—যারা সামাজিক নিরাপত্তা ও সমতার দৃষ্টান্ত, তারাও ব্যতিক্রম নয়। সেখানেও সিঙ্গেলহুড বাড়ছে দ্রুত।
এই পরিবর্তন জন্মহারের নাটকীয় পতনকে আরও ত্বরান্বিত করছে
আরও ভয়াবহ দিক হলো—তরুণ, অবিবাহিত পুরুষরাই পরিসংখ্যানগতভাবে বেশি সহিংস অপরাধ করে।
অতএব কম জুটি–বাঁধা মানে সম্ভাব্যভাবে আরও বিপজ্জনক সমাজ।
এআই সঙ্গীর উত্থান: ভবিষ্যতের প্রেম?
অন্যদিকে, সম্পর্কের এই সংকট এতটাই প্রকট যে ৭ শতাংশ তরুণ জানিয়েছেন—
তারা ‘এআই সঙ্গী’র সঙ্গে রোবোটিক প্রেম মেনে নিতে রাজি!
কারণ—
- এআই ধৈর্যশীল
- অভিযোগ করে না
- ব্যক্তিগত কাজ, চাকরি বা দায়িত্ব নিয়ে চাপ দেয় না
ফলে প্রযুক্তি নতুনভাবে সম্পর্কের মানচিত্রকেও বদলে দিচ্ছে।
আগামী দিনের পৃথিবী
কম দম্পতি, কম সন্তান—এমন এক ভবিষ্যৎ পৃথিবী হয়তো আরও নিঃসঙ্গ, আরও ধূসর।
তবে এই পরিবর্তন ঠেকানো যাবে না শুধু আক্ষেপ করে।
সমাজের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান—নির্মাণ খাত থেকে কর বিভাগ পর্যন্ত—
এই নতুন বাস্তবতার জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার সময় এসেছে।
সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট



