ঢাকা মঙ্গলবার, ১৮ নভেম্বর, ২০২৫

বিশ্বজুড়ে পলাতক নেতাদের বিচার ও মৃত্যুদণ্ডের গল্প

বিশ্ব ডেস্ক
প্রকাশিত: নভেম্বর ১৮, ২০২৫, ১১:০৪ এএম
বিশ্বের পলাতক নেতারা। ছবি - সংগৃহীত

বিশ্ব ইতিহাসে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ক্ষমতাচ্যুতির পরিস্থিতিতে অনেক নেতাই দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। কেউ রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব এড়াতে বিদেশে আশ্রয় নিয়েছেন, কেউ আবার দুর্নীতি, মানবাধিকার লঙ্ঘন বা যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ এড়াতে পালিয়েছেন। অনেকে দেশে ফেরার পরও বিচার এড়াতে সক্ষম হয়েছেন, আবার কেউ শাস্তির মুখোমুখি হয়েছেন। এই প্রতিবেদনে আমরা কয়েকটি দেশের প্রখ্যাত পলাতক নেতার ঘটনা এবং তাদের বিচার ও পরিণতি বিশ্লেষণ করেছি।

১) পাকিস্তান : নওয়াজ শরিফ ও পারভেজ মোশাররফ

পাকিস্তানের দুই সাবেক শাসক- নওয়াজ শরিফ ও পারভেজ মোশাররফ- পলাতক নেতাদের তালিকায় আলোচিত।

নওয়াজ শরিফ ২০১৮ সালে দুর্নীতির অভিযোগে কারাগারে যান। পরে শারীরিক অসুস্থতার কারণে জামিন পেয়ে চিকিৎসার জন্য লন্ডনে যান এবং চার বছর পর দেশে ফিরে ২০২৩ সালে সব মামলা থেকে খালাস পান। তবে তার বিচার প্রক্রিয়া এখনো বিতর্কিত।

পারভেজ মোশাররফ ক্ষমতা দখল, রাষ্ট্রদ্রোহ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে দুবাইয়ে আত্মগোপন করেন। পাকিস্তানের বিশেষ আদালত তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়, কিন্তু তিনি দেশে ফেরেননি। ২০২৩ সালে দুবাইয়েই তার মৃত্যু হয়। তার বিচার দেশের রাজনৈতিক বিভাজনকে আরও তীব্র করেছে।

২) থাইল্যান্ড : থাকসিন সিনাওয়াত্রা

২০০৮ সালে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগে থাইল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী থাকসিন সিনাওয়াত্রা দেশত্যাগ করেন। প্রায় ১৫ বছর লন্ডন ও দুবাইয়ে নির্বাসনে কাটানোর পর ২০২৩ সালে দেশে ফিরে কারাবন্দি হন। রাজকীয় ক্ষমার কারণে তার সাজা দ্রুত কমে আসে। থাকসিনের ঘটনায় দেখা যায়, বিচার ও রাজনৈতিক আপস একে অপরের সঙ্গে জটিলভাবে জড়িত।

৩) শ্রীলঙ্কা : গোতাবায়া রাজাপাকসে

২০২২ সালের ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকট ও ব্যাপক গণ-আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে দেশত্যাগ করেন। তার বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আছে। তবে রাজনৈতিক সুরক্ষা এবং দুর্বল বিচার প্রক্রিয়ার কারণে দেশে ফিরে বিচার এড়াতে সক্ষম হয়েছেন।

৩) ইউক্রেন : ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ

২০১৪ সালের ইউরোমাইদান আন্দোলনের পর ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ রাশিয়ায় পালিয়ে যান। রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় অনুপস্থিতিতেই তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয় এবং ১৩ বছরের সাজা দেয়া হয়। তবে রাশিয়ার আশ্রয়ের কারণে তাকে কখনো কারাভোগ করতে হয়নি।

৪) তিউনিসিয়া : জিন আল আবেদিন বেন আলী

২০১১ সালের আরব বসন্তে ক্ষমতাচ্যুত বেন আলী সৌদি আরবে পালিয়ে যান। দুর্নীতি, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে তার অনুপস্থিতিতে সাজা প্রদান করা হয়। সৌদি আরবের আশ্রয়ে তিনি দেশে ফেরেননি এবং ২০১৯ সালে মৃত্যুবরণ করেন।

৫) বলিভিয়া : জিনিন আনেজ ও ইভো মোরালেস

২০১৯ সালে ক্ষমতাচ্যুত ইভো মোরালেস প্রথমে আর্জেন্টিনায়, পরে মেক্সিকোতে আশ্রয় নেন। ২০২০ সালে দেশে ফিরে তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ স্থগিত হয়, এবং তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় থাকেন। তবে ২০২৪ সালে আদালত তাকে ভবিষ্যতের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে নিষিদ্ধ করে। তার উত্তরসূরি জিনিন আনেজও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগে গ্রেপ্তার হন।

৬) জিম্বাবুয়ে : রবার্ট মুগাবে

চার দশক ক্ষমতায় থাকা রবার্ট মুগাবে ২০১৭ সালে সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হন। মানবাধিকার লঙ্ঘন ও অর্থনৈতিক ধস থাকা সত্ত্বেও দেশে নিরাপদ ‘অবসর’ দেওয়া হয়। বিচার এড়ালেও তার শাসনামলের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বহু অভিযোগ রয়ে যায়। ২০১৯ সালে সিঙ্গাপুরে তিনি মারা যান।

৭) ইরাক : সাদ্দাম হুসেইন

২০০৩ সালে মার্কিন নেতৃত্বাধীন আগ্রাসনের পর সাদ্দাম হুসেইন ক্ষমতাচ্যুত হন। আট মাস আত্মগোপনের পর গ্রেপ্তার হন এবং দুজাইল হত্যাকাণ্ডের মামলায় মানবতাবিরোধী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে ২০০৬ সালে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মারা যান।

৮) লিবিয়া : মুয়াম্মার গাদ্দাফি

২০১১ সালের আরব বসন্তের সময় লিবিয়ার শাসক গাদ্দাফি আত্মগোপন করেন। পরে বিদ্রোহীদের হাতে বন্দী হয়ে নিহত হন। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত তার বিরুদ্ধে তদন্ত চালালেও জীবিত অবস্থায় বিচারের মুখোমুখি করা সম্ভব হয়নি। লিবিয়া তার পতনের পর দীর্ঘসময় গৃহযুদ্ধ ও বিভাজনের মধ্যে পড়ে।

৯) উগান্ডা : ইদি আমিন

১৯৭৯ সালে ক্ষমতাচ্যুত ইদি আমিন সৌদি আরবে আশ্রয় নেন। তার শাসনামলে লাখ লাখ মানুষ হত্যার শিকার হয়েছেন। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার বিচার দাবি থাকলেও সৌদি আরব তাকে আশ্রয় দেয়। ২০০৩ সালে বিনাবিচারে মৃত্যু হয়।

১০) ইথিওপিয়া : মেঙ্গিস্টু হাইলে মারিয়াম

১৯৭৭ থেকে ১৯৯১ পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকা মেঙ্গিস্টুর বিরুদ্ধে গণহত্যা, গুম ও রাজনৈতিক হত্যার অভিযোগ রয়েছে। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর জিম্বাবুয়েতে পালিয়ে যান। ২০০৬ সালে ইথিওপিয়ার আদালত গণহত্যার দায়ে তার অনুপস্থিতিতে যাবজ্জীবন সাজা দেয়।

১১) ফিলিপাইন : ফার্দিনান্দ মার্কোস সিনিয়র

১৯৮৬ সালের ‘পিপল পাওয়ার’ বিপলে ক্ষমতাচ্যুত হওয়া মার্কোস পরিবার হাওয়াইতে পালিয়ে যায়। দুর্নীতি ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে আন্তর্জাতিক আদালত মামলা করে। ১৯৮৯ সালে মার্কোস সিনিয়রের মৃত্যু হলেও তার পরিবার রাজনীতিতে সক্রিয় থেকে যায়। ২০২২ সালে তার ছেলে বংবং মার্কোস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।

১২) তুরস্ক : ফেতুল্লাহ গুলেন

২০১৬ সালের ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের জন্য তুরস্ক ফেতুল্লাহ গুলেনকে দায়ী করে। বহু বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করা গুলেনকে রাষ্ট্রদ্রোহী ঘোষণা করা হলেও যুক্তরাষ্ট্র তাকে প্রত্যর্পণ করেনি। অনুপস্থিতিতেই তুরস্কে তার বিরুদ্ধে মামলা চালানো হয়েছে।

১৩) ইয়েমেন : আলী আবদুল্লাহ সালেহ

২০১১ সালের আরব বসন্তে ক্ষমতাচ্যুত সালেহ প্রথমে সৌদি আরবে পালান। পরে দেশে ফিরে গৃহযুদ্ধে অংশ নেন। দুর্নীতি ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ থাকলেও বিচার হয়নি। ২০১৭ সালে হুথি বিদ্রোহীদের সঙ্গে সংঘর্ষে নিহত হন। ইয়েমেন এখনও গৃহযুদ্ধের আগুনে পুড়ছে।