যুক্তরাষ্ট্রের ভাবগতি দেখে মনে হচ্ছে, ভেনেজুয়েলায় হামলা চালাতে একেবারে প্রস্তুত তারা। এর পেছনে একটি কারণ আছে বলে গত সপ্তাহে উল্লেখ করেছিলেন ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো। সেটি হলো—তাঁর দেশের বিপুল জ্বালানি তেলের ভান্ডার নিজেদের দখলে নিতে ওয়াশিংটনের তুমুল আগ্রহ।
ভেনেজুয়েলা ঘিরে আধা ডজনের বেশি যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়েছে মার্কিন বাহিনী। মোতায়েন করেছে ১৫ হাজার সেনা। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তো হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেই রেখেছেন, শিগগিরই ভেনেজুয়েলায় আক্রমণ চালানো হতে পারে। দেশটির আকাশসীমা এড়িয়ে চলতেও বলেছেন তিনি।

তবে এর পেছনে মূল কারণ তেল নয় বলে জানিয়েছে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর। ট্রাম্প সরকারের ভাষ্যমতে, ভেনেজুয়েলা থেকে অবৈধ অভিবাসী ও মাদক ঠেকাতে চেষ্টা করছে তারা। তাই এই সেনা সমাবেশ। কারণ যা–ই হোক না কেন, ভেনেজুয়েলায় যদি সরকারের পরিবর্তন হয় তাহলে দেশটির ভবিষ্যৎ নির্ধারণে মূল ভূমিকা রাখবে তাদের হাতে থাকা বিশ্বের সবচেয়ে বড় জ্বালানি তেলের ভান্ডার।
ভেনেজুয়েলার কালো সোনা
বেশির ভাগ মানুষ মনে করেন, সবচেয়ে বেশি জ্বালানি তেল রয়েছে মধ্যপ্রাচ্য বা যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস অঙ্গরাজ্যে মাটির নিচে। তা একদমই ঠিক নয়। যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানিবিষয়ক তথ্য সরবরাহকারী কর্তৃপক্ষের (ইআইএ) হিসাবে, ভেনেজুয়েলার কাছে ৩০৩ বিলিয়ন ব্যারেলের অপরিশোধিত তেলের ভান্ডার রয়েছে, যা ইরাকের চেয়েও বেশি। এটি বিশ্বে সংরক্ষিত মোট তেলের ৫ ভাগের ১ ভাগ।
তবে ভেনেজুয়েলা খুব কম পরিমাণ তেল উত্তোলন করে—প্রতিদিন ১০ লাখ ব্যারেল। এটি বিশ্বের মোট উত্তোলনের মাত্র শূন্য দশমিক ৮ শতাংশ। তেল উত্তোলনের এই পরিমাণ ২০১৩ সালে মাদুরো ক্ষমতা নেওয়ার আগের সময়ের অর্ধেক। আর ১৯৯৯ সালে সমাজতন্ত্রীরা ভেনেজুয়েলার ক্ষমতায় বসার আগের সময়ের চেয়ে এক–তৃতীয়াংশের কম।
এই কমার পেছনে কারণটা কী? আসলে ভেনেজুয়েলা সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা এবং দেশটির অর্থনৈতিক সংকটের কারণে ক্রমেই তেল উত্তোলন কমেছে। এ ছাড়া ইআইএর তথ্য অনুযায়ী, ভেনেজুয়েলায় জ্বালানিতে বিনিয়োগ ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থার ঘাটতি রয়েছে। ফলে তাদের জ্বালানি অবকাঠামোগুলোর অবস্থা খারাপ হচ্ছে এবং উত্তোলনের সক্ষমতা কমছে।

বিদেশি বিনিয়োগটা ভেনেজুয়েলার জন্য বড় একটি সমস্যা। কারণ, দেশটির তলদেশে যে ভারী ও সালফারযুক্ত অপরিশোধিত তেল রয়েছে, তা উত্তোলনের জন্য বিশেষ যন্ত্রপাতি ও উচ্চ মাত্রার প্রযুক্তিগত সক্ষমতা প্রয়োজন। এগুলো তোলার এবং পরিশোধনের ক্ষমতা রয়েছে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন তেল কোম্পানির। তবে ভেনেজুয়েলায় ব্যবসা করতে তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
ভেনেজুয়েলার কাছে ৩০৩ বিলিয়ন ব্যারেলের অপরিশোধিত তেলের ভান্ডার রয়েছে, যা ইরাকের চেয়েও বেশি। এটি বিশ্বে সংরক্ষিত মোট তেলের ৫ ভাগের ১ ভাগ।
২০০৫ সাল থেকে ভেনেজুয়েলার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র সরকার। ২০১৯ সালের ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদের সময় ভেনেজুয়েলার রাষ্ট্রীয় তেল কোম্পানি পেত্রোলিওস ডি ভেনেজুয়েলা থেকে যুক্তরাষ্ট্রে তেল আমদানি পুরোপুরি বন্ধ করা হয়। পরে যুক্তরাষ্ট্রে গ্যাসের দাম কমাতে ২০২২ সালে মার্কিন জ্বালানি কোম্পানি শেভরনকে ভেনেজুয়েলায় কার্যক্রম চালানোর অনুমতি দেন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। গত মার্চে ট্রাম্প ওই লাইসেন্স বাতিল করেন। তবে মাদুরো সরকার এ থেকে কোনো আয় করতে পারবে না—এমন শর্তে আবার অনুমতি দেন তিনি।
যুক্তরাষ্ট্র কেন ভেনেজুয়েলার তেল চায়
বিশ্বের যেকোনো দেশের চেয়ে যুক্তরাষ্ট্র বেশি তেল উত্তোলন করে। এরপরও দেশটির তেল আমদানির দরকার হয়—বিশেষ করে যে ধরনের তেল ভেনেজুয়েলা উত্তোলন করে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র যে অপরিশোধিত তেল উত্তোলন করে সেগুলো হালকা ও কম সালফারযুক্ত। এগুলো পেট্রল উৎপাদনের জন্য ভালো হলেও আর বেশি কিছু পাওয়া যায় না।
অন্যদিকে ভেনেজুয়েলায় পাওয়া যায় ভারী ও সালফারযুক্ত অপরিশোধিত তেল। এই তেল পরিশোধনের সময় ডিজেল, অ্যাসফাল্ট এবং কলকারখানা ও ভারী যন্ত্রপাতির জ্বালানিসহ বিভিন্ন ধরনের দ্রব্য পাওয়া যায়। বিশ্বজুড়ে ডিজেলের জোগান কমে আসছে। এর বড় একটি কারণ হলো ভেনেজুয়েলার তেলের ওপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা।

ইআইয়ের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রতিদিন ভেনেজুয়েলা থেকে এক লাখ দুই হাজার ব্যারেল অপরিশোধিত তেল আমদানি করেছে যুক্তরাষ্ট্র। সে হিসাবে যুক্তরাষ্ট্রে আমদানি করা মোট তেলের দশম উৎস ছিল ভেনেজুয়েলা। একই সময় পর্যন্ত সৌদি আরব থেকে প্রতিদিন ২ লাখ ৫৪ হাজার ব্যারেল এবং কানাডা থেকে ৪১ লাখ ব্যারেল তেল আমদানি করেছে ওয়াশিংটন।
ভেনেজুয়েলার তেলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহের বড় কারণ হলো—এই তেল তাদের কাছাকাছি রয়েছে, দামও কম। আঠালো ও বেশি ঘনত্বের কারণে এই তেল বেশি পরিশোধনের দরকার পড়ে। এ জন্যই এটি কম দামে পাওয়া যায়। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান প্রাইস ফিউচারস গ্রুপের জ্যেষ্ঠ বাজার বিশ্লেষক ফিল ফ্লিন বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের বেশির ভাগ পরিশোধনাগার নির্মাণ করা হয়েছে ভেনেজুয়েলার ভারী তেল প্রক্রিয়াজাত করার মতো করে। যুক্তরাষ্ট্রের তেলের তুলনায় ভেনেজুয়েলার তেল পরিশোধনের সক্ষমতাও বেশি সেগুলোর।
মাদুরোর পতন হলে এই তেলের কী হবে
ভেনেজুয়েলায় মাদুরোর যদি পতন হয়, আর বিশাল এই তেলের ভান্ডারের ওপর থেকে যদি নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়, তাহলে সুবিধা পেতে পারে যুক্তরাষ্ট্র ও দেশটির মিত্ররা। পাশাপাশি এ থেকে ভেনেজুয়েলার অর্থনীতিও সুবিধা পেতে পারে। এ ছাড়া ভেনেজুয়েলার তেলের রপ্তানি বাড়লে তা বড় পরিসরে তেলের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করতে পারে।
বিশ্লেষক ফিল ফ্লিন বলেন, ‘ভেনেজুয়েলায় বিভিন্ন বিষয় পরিচালনার জন্য যদি আমরা একটি বৈধ সরকার পাই, তাহলে বিশ্বের তেলের সরবরাহ আরও বাড়তে পারে। ফলে তেলের মূল্যবৃদ্ধি ও সংকটের ঝুঁকি কমবে। ভেনেজুয়েলার তেল বাজারকে আবার জাগিয়ে তুলতে পারলে তা একটি বিরাট বিষয় হবে।’

তবে আগামী দিনে ভেনেজুয়েলার তেল পূর্ণমাত্রায় বিশ্ববাজারে প্রবেশ করতে পারলেও কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। যেমন ভেনেজুয়েলার তেল উত্তোলনের সক্ষমতা পুরোপুরি ফিরিয়ে আনার জন্য কয়েক বছর এবং বিরাট খরচের প্রয়োজন। ভেনেজুয়েলার রাষ্ট্রীয় জ্বালানি প্রতিষ্ঠান পেত্রোলিওস ডি ভেনেজুয়েলা জানিয়েছে, ৫০ বছর ধরে তাদের পাইপলাইনগুলো নতুন করে সংস্কার করা হয়নি। আর উত্তোলন চূড়ান্ত পর্যায়ে নিতে বিভিন্ন অবকাঠামোগত সংস্কারে ৫৮ বিলিয়ন ডলার লাগতে পারে।
মাদুরোর পতনের পর যদি পশ্চিমবান্ধব কোনো সরকার ভেনেজুয়েলায় ক্ষমতায় বসে তাহলে পশ্চিমা দেশগুলো হয়তো এই বিপুল খরচ দেওয়ার বিষয়ে আগ্রহ দেখাতে পারে। এটি শুধু ভেনেজুয়েলার তেল ও পরিশোধনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর লাভের জন্যই তারা করবে না, এর সঙ্গে ভূরাজনৈতিক বিষয়াদিও জড়িত থাকবে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে রাশিয়ার তেলের কথা। এই তেল ভেনেজুয়েলার তেলের মতোই। সে কারণে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার পরও রাশিয়ার তেলের ওপর ব্যাপক হারে নির্ভরশীল ভারত ও চীন। এখন ভেনেজুয়েলায় যদি তেল উত্তোলন বাড়ে, তা রাশিয়ার তেলের একটি বিকল্প হতে পারে। এর জেরে রাশিয়ার ক্রেতারা ভেনেজুয়েলামুখী হলে মস্কোর অর্থনীতি দুর্বল হয়ে পড়বে।
রাশিয়ার তেল ভেনেজুয়েলার তেলের মতোই। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার পরও রাশিয়ার তেলের ওপর ব্যাপক হারে নির্ভরশীল ভারত ও চীন।
ভেনেজুয়েলার তেলের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হলে এর উল্লেখযোগ্য প্রভাব পড়তে পারে দেশটির ওপরও। কারাকাস যদি আবার আগের মতো তেল উত্তোলন করতে পারে তাহলে তাদের আয় বাড়বে। বিশ্লেষক ফিল ফ্লিন বলেন, ভেনেজুয়েলা আবার তেল থেকে আয়কে উচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে। তবে এ জন্য তাদের মাদুরোমুক্ত হতে হবে।

এসব কারণে জল্পনা রয়েছে যে মাদুরোর ওপর ট্রাম্পের চাপের পেছনে একটি কারণ ভেনেজুয়েলার জ্বালানি তেল। চলতি সপ্তাহান্তেই তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর জোট ওপেকের মহাসচিবের কাছে লেখা একটি চিঠিতে মাদুরো বলেছিলেন, তাঁর দেশের তেলের মজুত দখল করতে চায় ট্রাম্প প্রশাসন। কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট গুস্তাভো পেত্রোও তা–ই মনে করেন। সিএনএনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, এই উত্তেজনার মূলে রয়েছে তেল। ভেনেজুয়েলার তেল নিয়ে একটি সমঝোতার জন্যই যুক্তরাষ্ট্র এমনটা করছে।

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন