উত্তর আফ্রিকার দেশ সুদানের কলেরা-পীড়িত শরণার্থী শিবিরগুলোর পরিস্থিতি প্রতিদিন ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। আতঙ্কে কাটছে মানুষের জীবন। খোলা জায়গায় পানি ফুটিয়ে জীবাণুমুক্ত করার আগেই মাছি এসে পড়ে, আর তাতেই আবার দূষিত হচ্ছে পানি।
দারফুরের তাওয়িলা এলাকার শিবিরগুলোতে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে কলেরা। লাখ লাখ মানুষের কাছে জীবাণুনাশক বা ওষুধ নেই। রোগ প্রতিরোধের একমাত্র উপায় এখন ফুটানো পানি। খবর আল-জাজিরা।
গত দুই মাস ধরে তাওয়িলায় তড়িঘড়ি করে তৈরি করা এক শিবিরে আশ্রয় নেওয়া মোনা ইব্রাহিম বলেন, ‘আমরা পানি খাওয়ার সময় তাতে লেবু মিশিয়ে ওষুধের মতো পান করি।’ মাটিতে বসা অবস্থায় তিনি বলেন, ‘আমাদের আর কোনো উপায় নেই।’
২০২৩ সালের এপ্রিলে সুদানের সেনাবাহিনী ও আধাসামরিক র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ)-এর সংঘর্ষ শুরু হলে প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ এল-ফাশের ও জমজম শিবির থেকে পালিয়ে তাওয়িলা ও আশপাশের এলাকায় আশ্রয় নেয়।
ডক্টরস উইদাউট বর্ডার্সের প্রকল্প সমন্বয়কারী সিলভাইন পেনিকড জানান, তাওয়িলার প্রথম কলেরা রোগী শনাক্ত হয় জুনের প্রথম দিকে, যা শহর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দক্ষিণে তাবিট গ্রামে। তিনি বলেন, ‘দুই সপ্তাহের মধ্যে আমরা সরাসরি তাওয়িলার শিবিরগুলোতেও কলেরা রোগী শনাক্ত করতে শুরু করি, বিশেষ করে বাস্তুচ্যুতদের শিবিরগুলোতে।’
দারফুরের তাওয়িলা শহরে কলেরা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। গত এক মাসেই এখানে এক হাজর ৫০০ জনের বেশি রোগীর চিকিৎসা করা হয়েছে। জাতিসংঘের শিশু সংস্থা (ইউনিসেফ) জানিয়েছে, এপ্রিল মাস থেকে শহরটির প্রায় ৩০০ শিশু এই রোগে আক্রান্ত হয়েছে।
ইউনিসেফের মতে, উত্তর দারফুর রাজ্যজুড়ে পাঁচ বছরের কম বয়সী ৬ লাখ ৪০ হাজারের বেশি শিশু কলেরার মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, গত ৩০ জুলাই পর্যন্ত বৃহত্তর দারফুর অঞ্চলে দুই হাজার ১৪০ জন এই রোগে আক্রান্ত হয়েছেন এবং অন্তত ৮০ জনের মৃত্যু হয়েছে।
তাওয়িলায় ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক ইব্রাহিম আদম মোহাম্মদ আবদুল্লাহ জানান, তার দল মানুষকে সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, পাওয়া কম্বল ও টারপলিন পরিষ্কার রাখা এবং পরিষ্কার পানি ব্যবহারের পরামর্শ দেয়। কিন্তু তাওয়িলার অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে এমন সহজ সতর্কতাও প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। ক্যাম্পের বাসিন্দারা নিকটবর্তী দূষিত প্রাকৃতিক উৎস অথবা কয়েকটি অগভীর কূপ থেকে পানি সংগ্রহ করতে বাধ্য হন।
এমএসএফের সিলভাইন পেনিকড বলেন, ‘এটা অত্যন্ত উদ্বেগজনক, কিন্তু ওই মানুষগুলোর আর কোনো উপায় নেই।’ যুদ্ধ এবং সংঘাতের কারণে মানবিক সহায়তা পৌঁছানোও কঠিন হয়ে পড়েছে, ফলে চিকিৎসা সরঞ্জামের সংকট দেখা দিয়েছে।
জাতিসংঘ বারবার সতর্ক করেছে যে, তাওয়িলায় ত্রাণ পৌঁছালেও তা ক্ষুধার্ত লাখো মানুষের জন্য যথেষ্ট নয়। সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, তৃতীয় বছরে গড়ানো সুদানের সংঘাত লক্ষাধিক মানুষের প্রাণ নিয়েছে এবং বিশ্বের সবচেয়ে বড় বাস্তুচ্যুতি ও খাদ্য সংকট তৈরি করেছে।
তাওয়িলায় স্বাস্থ্যকর্মীরা কলেরার প্রাদুর্ভাব ঠেকানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু প্রয়োজনীয় উপাদানের মারাত্মক অভাব রয়েছে।
এমএসএফ তাওয়িলায় ১৬০ শয্যার কলেরা চিকিৎসা কেন্দ্র চালু করেছে, যা শিগগিরই ২০০ শয্যায় উন্নীত করার পরিকল্পনা রয়েছে। এছাড়া দাবা নাইরায় আরেকটি কেন্দ্র খোলা হয়েছে, যা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত শিবিরগুলোর একটি। কিন্তু এমএসএফের পেনিকড জানান, আক্রান্ত রোগীর চাপ ইতোমধ্যেই উভয় কেন্দ্রের সামর্থ্যের বাইরে চলে গেছে।
এদিকে, চলমান যুদ্ধের কারণে ত্রাণবাহী কনভয় কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে, মানবিক সহায়তা পৌঁছানোও প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। সশস্ত্র গোষ্ঠী বিশেষ করে আরএসএফ অনেক সময় ত্রাণ বহনকারী যানকে বাধা দিচ্ছে। তার ওপর, চলতি মাসে শুরু হওয়া বর্ষার চূড়ান্ত সময়ে বন্যার পানি এসে পানির উৎসকে আরও দূষিত করতে পারে, যা সংকটকে আরও ভয়াবহ করে তুলবে।