জাম্বিয়ার রাজধানী লুসাকায় দীর্ঘ বিরতির পর আগস্টের শেষের দিকে পুনরায় চালু হলো ইসরায়েলি দূতাবাস। ৫২ বছরের মধ্যে এটাই প্রথমবার লুসাকার আকাশে উড়ে ইসরায়েলের পতাকা। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী গিডিয়ন সার। ফিতা কেটে তিনি ঘোষণা দেন, ‘ইসরায়েল জাম্বিয়ায় ফিরেছে, ইসরায়েল আফ্রিকায় ফিরেছে।’
গাজার ভয়াবহ হামলার কারণে যখন আন্তর্জাতিক মহলে ইসরায়েল বিচ্ছিন্ন, তখন এই ঘটনাকে বড় কূটনৈতিক সাফল্য হিসেবে দেখছে তেল আবিব। ইসরায়েলি মিডিয়া একে ‘আফ্রিকার নতুন সীমানা’ বলে অভিহিত করেছে। সার অনুষ্ঠানে দাবি করেন, আফ্রিকার অনেক দেশ এখন ইসরায়েলি দূতাবাস চালুর অপেক্ষায়।
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, আফ্রিকায় প্রভাব বিস্তারই আসল উদ্দেশ্য। বিশেষ করে দক্ষিণ আফ্রিকার মতো কঠোর সমালোচককে দুর্বল করার কৌশল। উইটওয়াটারস্র্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ফেইথ মাবেরা আল-জাজিরাকে বলেন, এটি আঞ্চলিক সমর্থন ভাঙার জন্য পুরোনো ‘বিভক্ত করো ও শাসন করো’ নীতি।
জাম্বিয়ার দূতাবাস খোলার এক সপ্তাহ আগে ইসরায়েলের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী শ্যারেন হাসকেল নাইজেরিয়া সফর করেন। সেখানকার কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক হলেও আবুজা প্রকাশ্যে প্রচার করেনি। এরপর হঠাৎ নাইজেরিয়ার ফিলিস্তিনি সম্প্রদায়ের নেতা র্যামজি আবু ইব্রাহিমকে গ্রেপ্তার করে সন্ত্রাসবিরোধী ইউনিট। এ ঘটনার সঙ্গে হাসকেলের সফরের যোগসূত্র আছে কি না তা স্পষ্ট নয়।
হাসকেল পরবর্তীতে যান দক্ষিণ সুদানে। সেখানে তিনি প্রেসিডেন্ট সালভা কির ও ভাইস প্রেসিডেন্ট রিক মাচারকে সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেন। তবে একই সময়ে ফাঁস হয় গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের জোরপূর্বক দক্ষিণ সুদানে স্থানান্তরের পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা। যদিও জুবা সরকার সেটি অস্বীকার করেছে।
এমনকি সোমালিল্যান্ডের সঙ্গেও অনুরূপ আলোচনা চলছে। তবে সোমালিল্যান্ডের জনগণ সরাসরি জানিয়েছে, তারা ফিলিস্তিনি স্থানান্তরের অংশ হবে না।
আফ্রিকার সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক ওঠানামার মধ্যে রয়েছে। ১৯৫০-৬০ দশকে স্বাধীনতা অর্জনের পর আফ্রিকান দেশগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়েছিল তেল আবিব। কিন্তু ১৯৭৩ সালের যুদ্ধের পর ২০টিরও বেশি দেশ সম্পর্ক ছিন্ন করে। সেটি ছিল নজিরবিহীন কূটনৈতিক আঘাত। পরে ইসরায়েল ধীরে ধীরে কিছু দেশে দূতাবাস পুনরায় চালু করে। এখন পর্যন্ত আফ্রিকায় ১১টি দূতাবাস চালু রয়েছে।
২০২১ সালে ইসরায়েল আফ্রিকান ইউনিয়নের (এইউ) পর্যবেক্ষক মর্যাদা পায়। তবে দক্ষিণ আফ্রিকা ও আলজেরিয়ার তীব্র আপত্তিতে পরে সেটি স্থগিত হয়। ২০২৩ সালে আদ্দিস আবাবায় রুয়ান্ডার গণহত্যার ৩০তম বার্ষিকীতে ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূত আব্রাহাম নিগুসেকে অনুষ্ঠান থেকে বের করে দেওয়া হয়। এই ঘটনাই ইঙ্গিত দেয়, এইউ-তে ইসরায়েলের প্রভাব ক্ষীণ হয়ে গেছে।
এর মধ্যেও ইসরায়েল কিছু সাফল্য পেয়েছে। ২০২৩ সালের নভেম্বরে গাজায় হামলার নিন্দা জানিয়ে জাতিসংঘ প্রস্তাবের ভোটে বিরত থাকে জাম্বিয়া, দক্ষিণ সুদান, ক্যামেরুন, ইথিওপিয়া, মালাউই ও নিরক্ষীয় গিনি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঋণে ডুবে থাকা জাম্বিয়া বিনিয়োগের আশায় ইসরায়েলের দিকে ঝুঁকছে। আগস্টে দেশটি ইসরায়েলি সংস্থা ‘সেভ এ চাইল্ডস হার্ট’ থেকে একটি হৃদ-ফুসফুস পর্যবেক্ষণ যন্ত্র পেয়েছে।
ইসরায়েলের আফ্রিকা কৌশল শুধু সাহায্য নয়, অস্ত্র ও প্রযুক্তি বিক্রির সঙ্গেও জড়িত। এসআইপিআরআই’র তথ্য বলছে, ক্যামেরুন, চাদ, নাইজেরিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকাসহ বহু দেশ ইসরায়েলি অস্ত্র কিনেছে।
তবে দক্ষিণ আফ্রিকার বিশ্লেষক রেনেভা ফৌরি বলেন, এই অংশীদারিত্ব আসলে ইসরায়েলের অপরাধকে আড়াল করে। ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসকে ঢেকে রাখতে তারা আফ্রিকার নিরাপত্তা খাতে নিজেদের ঢুকিয়ে নিচ্ছে।
২০২৩ সালের ডিসেম্বরে দক্ষিণ আফ্রিকা আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) গাজায় গণহত্যার অভিযোগ আনে। এরপরই আফ্রিকান ইউনিয়ন ইসরায়েলের নিন্দা জানায়। এপ্রিলে আদ্দিস আবাবার ঘটনায় রাষ্ট্রদূত নিগুসের বহিষ্কার ইসরায়েলের জন্য অপমানজনক অধ্যায় তৈরি করে।
তবুও জাম্বিয়ার মতো নতুন দেশকে পাশে টেনে নিতে সক্ষম হয়েছে তেল আবিব। বিশ্লেষকদের মতে, অর্থনৈতিক সংকটে থাকা দেশগুলোকে প্রলোভন দেখিয়ে ইসরায়েল তার প্রভাব বাড়াতে চাইছে। তবে আফ্রিকার সাধারণ জনগণ ফিলিস্তিনের পক্ষে সোচ্চার। Africa4Palestine’র সহ-প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ দেশাই বলেন, ‘জনগণ শেষ পর্যন্ত সরকারকে জবাবদিহি করবে। ইসরায়েলের মরিয়া প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবে।’
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন