- সেপ্টেম্বর মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ৮০ জনের মৃত্যু। আক্রান্ত প্রায় ১৭ হাজার
- চলতি বছরের ৯ মাসে ডেঙ্গুতে মৃত্যু ১৯৮। আক্রান্ত ৪৭৩৪২
- ডেঙ্গু আক্রান্তদের অনেকেই সুস্থ হলেও ভুগছেন নানা শারীরিক জটিলতায়
- এ বছর ক্ল্যাসিকাল ডেঙ্গুর পরিমাণ বেশি। অধিকাংশই ভুগছেন জ্বর, তীব্র শরীর ও মাথাব্যথায়
- নিজ নিজ জায়গা থেকে সচেতন হওয়ার তাগিদ বিশেষজ্ঞদের
সেপ্টেম্বর মাসের শুরু থেকেই দেশজুড়ে বাড়তে থাকে ডেঙ্গু জ¦রের সংক্রমণ। পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে মৃত্যুও। চলতি বছরের মোট আক্রান্তের প্রায় ৯০ ভাগই এ মাসেই আক্রান্ত হয়েছেন। এ মাসে মোট আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ১৭ হাজার। গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ৮০ জনের। এর মধ্যে সবশেষ গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে আরও তিনজন। এ সময়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ৫৫৬ জন। এ নিয়ে চলতি বছর ডেঙ্গুতে মারা গেছে ১৯৮ জন, আক্রান্ত হয়েছে ৪৭ হাজার ৩৪২ জন।
এদিকে এডিস মশা নিধনে আরও জোরালো কার্যক্রম না নিলে আসছে অক্টোবর মাসে ডেঙ্গু মহামারি আকার ধারণ করতে পারে বলে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের। তাদের মতে, ডেঙ্গুর ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণ সরকারের একার পক্ষে সামলানো মুশকিল। কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না সিটি করপোরেশনও। শুধু লোক দেখানো কাজ করে ডেঙ্গু প্রতিরোধ সম্ভব নয়। তাই সবাইকে নিজ নিজ জায়গা থেকে দায়িত্ব নিতে হবে। নিজ নিজ জায়গা থেকে সবার সচেতনতা ডেঙ্গু প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখবে।
ক্যালেন্ডারের হিসেবে বর্ষাকাল শেষ হলেও এখনো থামেনি বৃষ্টি। আশি^নের মধ্যভাগে অন্যান্য বছর এ সময়ে আবহাওয়া কিছুটা নাতিশীতোষ্ণ থাকলেও চলতি বছর তীব্র গরমে ভুগছে নগরবাসী। মাঝেমধ্যে বৃষ্টি স্বস্তি দিলেও সেটাই আশঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ এই বৃষ্টি এডিস মশার প্রজনন বাড়তে সাহায্য করছে। গত বছরের ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর দুই সিটি করপোরেশনেই নেই কোনো স্থানীয় জনপ্রতিনিধি। ফলে মশা নিধনসহ সব কার্যক্রমে কিছুটা স্থবিরতা বিরাজ করছে গত বছরের শেষভাগ থেকেই। ওই বছরের সেপ্টেম্বরেও আক্রান্তের সংখ্যা ছাড়িয়েছিল ১৮ হাজারের বেশি। মৃত্যু হয়েছিল ৮০ জনের। এই ধারাবাহিকতা চলতি বছরেও বজায় থাকায় আসন্ন অক্টোবরে ডেঙ্গুর মহামারির আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘এখন যে পরিস্থিতি দেখছি, তাতে ডেঙ্গুকে সারা বছরের স্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করাই সমীচীন। ডেঙ্গুর সংক্রমণ ও বিস্তারের প্রকৃতি লক্ষ্য করলে এটাকে এড়ানোর কিছু উপায় আমরা অবলম্বন করতে পারি। সেটা হলো বাসাবাড়ির ভেতরে ও আশপাশে পানি জমতে না দেওয়া, যাতে এডিস মশার বংশবিস্তার ঠেকানো যায়। দ্বিতীয়ত, মশার কামড় এড়ানোর জন্য সতর্ক থাকা, বাসা মশামুক্ত রাখার চেষ্টা করা, ঘুমানোর সময় মশারি ব্যবহার করা। বিশেষ সতর্ক থাকা প্রয়োজন শিশুদের ব্যাপারে। তাদের খালি গায়ে না রাখা, কেননা এডিস মশা সাধারণত শরীরের উন্মুক্ত অংশে বসে। ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সতর্কতার পাশাপাশি সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগও বিশেষভাবে প্রয়োজন।’
তবে এ ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনের ভূমিকাও কম নয় বলে জানিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেনিন চৌধুরী। রূপালী বাংলাদেশকে তিনি বলেন, ‘আমরা বরাবরই বলে আসছি ডেঙ্গু প্রতিরোধে একটি সমন্বিত পরিকল্পনা জরুরি, যা বছর শুরুর আগেই করা উচিত। যেহেতু দেশে একটা রাজনৈতিক পট পরিবর্তন এসেছে। একটু সময় লাগবে এ ক্ষেত্রে। তবে আশা করব এডিস মশা নিধনে সরকারের পক্ষ থেকে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’
ডেঙ্গুর সাম্প্রতিক লক্ষণ বিশ্লেষণে এটিকে আর নগরকেন্দ্রিক রোগ বলার পক্ষেও নন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, এটি সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে। সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে, ঢাকার বাইরেই আক্রান্তের সংখ্যা বেশি। এ বছর ডেঙ্গুর সংক্রমণ বাড়ার ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞরা যেসব বিষয়কে দায়ী করছেন, তা হলোÑ স্থানীয় পর্যায়ে যথাযথভাবে মশক নিধন কার্যক্রম না চালানো, ছাত্র জনতার গণআন্দোলনের সময় সিটি করপোরেশনের মশক নিধন কার্যক্রমে ভাটা এবং নতুন দায়িত্ব নেওয়া প্রশাসকদের অল্প সময়ের মধ্যে পর্যাপ্ত প্রস্তুতির ঘাটতি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১ হাজার ১৬১ জন, যা ফেব্রুয়ারিতে একলাফে কমে নেমে আসে ৩৭৪ জনে। ডেঙ্গুর নিম্নগামী ধারাবাহিকতা বজায় থাকে মার্চেও। ওই মাসে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৩৩৬ জন। কিন্তু এপ্রিল থেকে বদলাতে থাকে প্রেক্ষাপট। এপ্রিল মাসে মোট শনাক্তের সংখ্যা দাঁড়ায় ৭০১ জনে, যা মে মাসে গিয়ে পৌঁছায় ১ হাজার ৭৭৩ জনে। জুন মাসে ছাড়ায় আক্রান্তের আগের বছরের রেকর্ড। ওই মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়ায় ৫ হাজার ৯৫১ জনে। যার ধারাবাহিকতা বজায় থাকে জুলাই, আগস্টেও। জুলাইয়ে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১০ হাজার ৬৮৪ এবং আগস্টে ১০ হাজার ৪৯৬ জন। তবে চলতি সেপ্টেম্বর মাসে আক্রান্ত হয় প্রায় ১৭ হাজার মানুষ। গত রোববার একদিনে বছরের সর্বোচ্চ আক্রান্ত হয় ৮৪৫ জন।
সম্প্রতি ডেঙ্গুর এ তীব্রতার বিষয়ে কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক ড. কবিরুল বাশার রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমরা দেখতে পাচ্ছি, এডিস মশার ঘনত্ব বাড়ছে। মশার ঘনত্ব যেহেতু বাড়ছে, যদি আমরা এখনই নিয়ন্ত্রণ করতে না পারিÑ সামনের দিনগুলোয় পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা দুই মাস আগে থেকে বলছিÑ সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গু পরিস্থিতি খারাপ হবে। কিন্তু স্বাভাবিক কার্যক্রম ছাড়া ডেঙ্গু প্রতিরোধে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এখনই মশা নিধনে জোরালো পদক্ষেপ না নিলে অক্টোবরে পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে।’
এদিকে ডেঙ্গুতে আক্রান্তদের অনেকেই সুস্থ হয়েও নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছেন। রাজধানীর মহাখালীর বাসিন্দা শারমীন সুলতানা তাদেরই একজন। ছয় মাসের গর্ভবতী থাকা অবস্থায় সেপ্টেম্বরের শুরুতে আক্রান্ত হন ডেঙ্গুতে। হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে প্রায় ২ সপ্তাহ চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হলেও এখনো পুরোপুরি সুস্থ হতে পারেননি। তিনি বলেন, একে তো গর্ভাবস্থা। তার ওপর ডেঙ্গু। তখনই শরীরে খুব চুলকানি হয়েছিল। কিন্তু সন্তানের নিরাপত্তায় ডাক্তার কোনো ওষুধ ব্যবহার করতে মানা করেন। এই অবস্থা এখনো আছে। এ ছাড়া খাবারে অনীহা, শারীরিক দুর্বলতা তো রয়েছেই।
একই কথা জানান, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে জীবন-মৃত্যুর সঙ্গে লড়া ৩ মাস বয়সি শিশু আফিফের বাবা সিজুল রহমান। তিনি বলেন, ‘আমার বাচ্চার অবস্থা এত খারাপ হয়েছিল, তাকে আইসিইউতে নিতে হয়েছে। এখন সুস্থ হলেও তার প্রায় সময়ই বমিসহ ঝিমুনির ভাব দেখা যায়। ডেঙ্গু হওয়ার আগে এমনটা হয়নি ওর। এ নিয়ে মানসিক আতঙ্কে ভুগছি। ঘরে সারা দিনই মশারি টাঙ্গিয়ে রাখি। কয়েল, স্প্রে কিছুই বাদ দিচ্ছি না। যদি সিটি করপোরেশনগুলো তাদের দায়িত্ব পালন করত তাহলে আমাদের এত দুর্ভোগ পোহাতে হতো না।’
তবে সম্প্রতি এডিস মশা নিধনে কিছুটা উদ্যোগী হয়েছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। এডিসের প্রকোপ বাড়ায় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে রাজধানীজুড়ে মশা নিধনে নেওয়া হয়েছে বিশেষ পরিকল্পনা। মশার প্রজনন উৎস সবচেয়ে বেশি ঢাকার দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। তাই এ অঞ্চলে শুরু হয়েছে চিরুনি অভিযান। প্রায় ৩ হাজার কর্মী কাজ করছেন মশা নিধনে। ঢাকার দক্ষিণ সিটির ১০টি ওয়ার্ডেও শুরু হয়েছে ‘বিশেষ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও মশক নিধন’ কার্যক্রম তথা চিরুনি অভিযান। ডিএসসিসির সব ওয়ার্ডেই দৈনন্দিন নিয়মিত কার্যক্রমের পাশাপাশি সংস্থাটির স্বাস্থ্য বিভাগ ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সমন্বয়ে ২, ১৮, ২৪, ২৫, ৩৪, ৪৯, ৬১, ৬২, ৬৩ ও ৬৯ নম্বর ওয়ার্ডে নিয়মিত চিরুনি অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে।
এসব অভিযানে সকালে লার্ভিসাইডিং কার্যক্রম ও বিকেলে এডাল্টিসাইডিং কার্যক্রমে শতাধিক মশককর্মী এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা অংশ নিচ্ছেন। একই রকমভাবে উত্তর সিটিতে মশা নিধনে পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছেন জানিয়ে উত্তরা ৯ নম্বর সেক্টরের বাসিন্দা আশিকুর রহমান বলেন, কয়দিন আগেও এলাকায় কোনো ফগার মেশিন দেখতে পাইনি। কিন্তু এখন প্রায় প্রতিদিনই নিয়মিত মশা মারার উদ্যোগ দেখতে পাচ্ছি। মশা থেকে বাঁচতে নিজের বাড়িঘর পরিষ্কার রাখা সবচেয়ে জরুরি হলেও সিটি করপোরেশনের এ উদ্যোগও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
সিটি করপোরেশনের তথ্যে জানা যায়, সারা দেশে সম্প্রতি ১৮ হাজার ৬১১টি স্থান পরিদর্শন করা হয়েছে। পরিদর্শন করা স্থানগুলোর মধ্যে সিটি করপোরেশন এলাকায় ৬৮২টি এবং ৭৭টি পৌরসভায় ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ৯ হাজার ৩৬৫টি স্থানে মশার প্রজননস্থল ধ্বংস ও লার্ভিসাইড স্প্রে করা হয়েছে। এ ছাড়া ডেঙ্গু রোগের প্রাদুর্ভাব মোকাবিলায় জনসচেতনতা বাড়াতে বিভিন্ন এলাকায় মাইকিং, লিফলেট ও পোস্টার বিতরণ করা হচ্ছে নিয়মিত।
চলতি বছর ডেঙ্গুর ধরন প্রসঙ্গে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক ডা. সালেহ মাহমুদ তুষার রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘গত কয়েক বছর আমরা সাধারণ ক্ল্যাসিকাল ডেঙ্গু ছাড়াও ডেঙ্গু শক সিনড্রোম দেখেছি, এক্সপান্ডেড ডেঙ্গু দেখেছি। তবে এ বছর ক্ল্যাসিকাল ডেঙ্গুর পরিমাণটাই বেশি। বেশির ভাগেরই জ্বর, শরীর ব্যথা, মাথাব্যথা এ ধরনের লক্ষণ বেশি। আগের বছর যেমনটা হয়েছে হঠাৎ করে প্রেশার কমে যাওয়া, রক্তক্ষরণ এবং অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়াÑ এ বছর তা কম পাচ্ছি।’
প্রতিবছর বর্ষাকালে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দেয়। ২০২৩ সালের জুন মাস থেকে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করে। ওই বছর দেশে ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেয়। এর মধ্যে ঢাকায় ১ লাখ ১০ হাজার ৮ জন এবং ঢাকার বাইরে চিকিৎসা নেয় ২ লাখ ১১ হাজার ১৭১ জন। ওই বছর আক্রান্তদের মধ্যে হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরে ৩ লাখ ১৮ হাজার ৭৪৯ জন। এ ছাড়া ২০২৪ সালে ১ হাজার ৭০৫ জন ডেঙ্গুতে মারা যান, যা দেশের ইতিহাসে এক বছরে ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ মৃত্যু। এর আগে ২০১৯ সালে দেশব্যাপী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিল ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন। ওই সময় চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীসহ প্রায় ৩০০ জনের মৃত্যু হয়েছিল।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন