চীন সীমান্তের কাছাকাছি উত্তর কোরিয়ার একটি নতুন ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটির সন্ধান মিলেছে। বুধবার (২০ আগস্ট) প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের (সিএসআইএস) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘সিনপুং-ডং’ নামে পরিচিত ঘাঁটিটি পূর্ব এশিয়ার বেশিরভাগ অংশ এবং এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্যও ‘সম্ভাব্য পারমাণবিক হুমকি’ তৈরি করতে পারে।
ঘাঁটিটি চীন সীমান্ত থেকে মাত্র ২৭ কিলোমিটার (প্রায় ১৭ মাইল) দূরে অবস্থিত। ধারণা করা হচ্ছে, এখানে সর্বোচ্চ নয়টি পর্যন্ত পারমাণবিক-সক্ষম আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র (আইসিবিএম) এবং তাদের মোবাইল লঞ্চার মজুত রাখা যেতে পারে। এটি উত্তর কোরিয়ার সেই ১৫ থেকে ২০টি গোপন ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটির মধ্যে একটি, যেগুলো দেশটি কখনো আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেনি।
স্যাটেলাইট চিত্র বিশ্লেষণ, উত্তর কোরীয় শরণার্থী ও কর্মকর্তাদের সাক্ষাৎকার, গোপন নথি এবং ওপেন-সোর্স ডেটার ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি প্রস্তুত করা হয়েছে। প্রতিবেদনে সতর্ক করা হয়েছে, এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলো সরাসরি পূর্ব এশিয়া এবং মার্কিন মূল ভূখণ্ডের জন্য গুরুতর পারমাণবিক হুমকি তৈরি করছে।
কিম জং উনের নেতৃত্বে উত্তর কোরিয়া গত কয়েক বছরে দ্রুত সামরিক শক্তি বাড়িয়েছে। আধুনিকীকরণের পাশাপাশি তারা নতুন অস্ত্র তৈরি করেছে এবং এমনকি এমন আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা করেছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের যেকোনো স্থানে আঘাত হানতে সক্ষম। এসব পদক্ষেপ জাতিসংঘের কঠোর নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করলেও পিয়ংইয়ং তা অব্যাহত রেখেছে।
ইউক্রেন যুদ্ধে মস্কোর সঙ্গে উত্তর কোরিয়ার সহযোগিতা বাড়ার পর বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, এর বিনিময়ে রাশিয়া উত্তর কোরিয়ার সামরিক প্রযুক্তি ও সরবরাহ ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করতে পারে।

সিনপুং-ডং ঘাঁটিটি একটি সরু পাহাড়ি উপত্যকায় অবস্থিত, যার আয়তন প্রায় ২২ বর্গকিলোমিটার (প্রায় পাচঁ হাজার ৪৩৬ একর)। অর্থাৎ নিউ ইয়র্কের জন এফ. কেনেডি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের চেয়েও বড়। সীমান্তের এত কাছে ঘাঁটি তৈরির কৌশলটিকে বিশেষজ্ঞরা ভৌগোলিকভাবে সুবিধাজনক বলে মনে করছেন। কারণ যুক্তরাষ্ট্র বা মিত্ররা এটিকে লক্ষ্য করলে যেকোনো প্রতিক্রিয়া চীনের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে, যা রাজনৈতিকভাবে জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে।
সিউলের ইওহা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক লেইফ-এরিক ইজলি বলেন, ‘চীনের এত কাছে ঘাঁটি তৈরি করে উত্তর কোরিয়া আসলে বেইজিংয়ের সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়াকে আক্রমণ প্রতিরোধের কৌশল হিসেবে ব্যবহার করছে। তবে এসব ঘাঁটির অস্তিত্ব প্রকাশ পেলে চীনা পর্যবেক্ষকরাও পিয়ংইয়ংয়ের কৌশল নিয়ে বিরক্ত হতে পারেন।’
প্রতিবেদনে বলা হয়, ঘাঁটির নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০০৪ সালে এবং ২০১৪ সাল থেকে এটি সক্রিয় রয়েছে। তখন থেকেই এটি সুরক্ষিত এবং নিয়মিতভাবে সম্প্রসারিত হচ্ছে। যদিও এখানে কোনো ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র মজুত আছে তা নিশ্চিত নয়। তবে গবেষকদের ধারণা, এটি পারমাণবিক-সক্ষম হোয়াসং-১৫ বা হোয়াসং-১৮ আইসিবিএম কিংবা নতুন কোনো মডেল দ্বারা সজ্জিত হতে পারে। ঘাঁটিতে মোবাইল লঞ্চারও রয়েছে, যেগুলো দ্রুত অবস্থান পরিবর্তন করে হামলা চালাতে সক্ষম।
প্রতিবেদন অনুসারে, সংকট বা যুদ্ধের সময় এসব লঞ্চার ও ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি থেকে বের হয়ে বিশেষ ওয়ারহেড স্টোরেজ ইউনিটের সঙ্গে যুক্ত হবে এবং পূর্ব-নির্ধারিত বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে গিয়ে হামলা চালাতে পারবে। স্যাটেলাইট চিত্রে ঘাঁটির প্রবেশদ্বার চেকপয়েন্ট, সদর দপ্তর ভবন, গুদাম, ক্ষেপণাস্ত্র সহায়ক স্থাপনা এবং আবাসিক ভবন শনাক্ত করা গেছে। অনেক স্থাপনা ইচ্ছাকৃতভাবে গাছপালা দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে, যাতে সেগুলো সহজে শনাক্ত করা না যায়।
সিএসআইএস প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই ঘাঁটি উত্তর কোরিয়ার ‘ক্ষেপণাস্ত্র বেল্ট’-এর অংশ, যার মধ্যে আরও কয়েকটি গোপন ঘাঁটি রয়েছে। এসব ঘাঁটি একসঙ্গে মিলে পিয়ংইয়ংয়ের ক্রমবর্ধমান ক্ষেপণাস্ত্র কৌশল এবং কৌশলগত স্তরের পারমাণবিক প্রতিরোধ ও আক্রমণ ক্ষমতার মূলভিত্তি গড়ে তুলছে।
বর্তমানে উত্তর কোরিয়ার কাছে আনুমানিক ৪০ থেকে ৫০টি পারমাণবিক ওয়ারহেড রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, শুধু এই অঞ্চলে নয়, বরং মার্কিন মূল ভূখণ্ডেও সেগুলো পৌঁছে দেওয়ার সক্ষমতা পিয়ংইয়ংয়ের হাতে রয়েছে। কিম জং উন সম্প্রতি তার বক্তব্যে দেশটির পারমাণবিক কর্মসূচি জোরদার করার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছেন এবং হুমকি দিয়েছেন যে, উত্তর কোরিয়া আক্রান্ত হলে দক্ষিণ কোরিয়াকে ধ্বংস করতে এ অস্ত্র ব্যবহার করা হবে।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন