নেপালে জেন-জি আন্দোলনের পর দেশটির রাজনীতিতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে। অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা ও বহিরাগত চাপ মোকাবিলার মধ্যে দিয়ে সাবেক প্রধান বিচারপতি সুশীলা কার্কির নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে। তবে এখনও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদে কার নাম আসবে তা স্পষ্ট নয়। সরকার এ পদে সাবেক সচিব ও রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে আলোচনা চালাচ্ছে, কিন্তু সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়নি।
বিশ্লেষকদের মতে, যে-ই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিন না কেন, তাকে অসংখ্য জটিলতার সম্মুখীন হতে হবে। আগামী বছরের ৫ মার্চ জাতীয় নির্বাচন আয়োজন, সাম্প্রতিক বিক্ষোভে ধ্বংসপ্রাপ্ত অবকাঠামো পুনর্গঠন এবং একইসঙ্গে বহিরাগত কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ সামলানো নতুন সরকারের জন্য বড় পরীক্ষা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তারা বলছেন, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের জন্য ভারত ও চীনের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার সমর্থন নিশ্চিত করা অপরিহার্য।
বুধবার (১৭ সেপ্টেম্বর) দেশটির সংবাদমাধ্যম কাঠমান্ডু পোস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রধানমন্ত্রী সুশীলা কার্কি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন এবং স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আন্তর্জাতিক মহল ও উন্নয়ন অংশীদারদের কাছ থেকে শুভেচ্ছা বার্তা পেয়েছেন। তবে কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, অতীতের ভুল পদক্ষেপের কারণে নেপাল আজ গভীর সংকটে পড়েছে।
জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের সাবেক উপদেষ্টা শংকর দাস বৈরাগী বলেন, উদীয়মান ভূ-রাজনৈতিক পরিবর্তন বুঝতে ব্যর্থ হওয়ায় নেপালের পররাষ্ট্রনীতি দুর্বল হয়েছে। তার মতে, ‘পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা একমুখী নয়। আমাদের বোঝা উচিত, অন্য দেশগুলো আমাদের কীভাবে দেখে। স্বাগতিক দেশগুলোর পরিবর্তনশীল পরিস্থিতি সম্পর্কে আমাদের দূতাবাসগুলোকে আরও সক্রিয় হতে হবে।’
ত্রিভুবন বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর নেপাল অ্যান্ড সাউথ এশিয়ান স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক মৃগেন্দ্র বাহাদুর কার্কি সতর্ক করে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী কার্কিকে ঘিরে দালাই লামার অভিনন্দন বার্তা জনমনে সন্দেহ তৈরি করেছে।
তার ভাষায়, ‘চীন এই পরিবর্তনকে কীভাবে গ্রহণ করবে, ভারত, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের ভারসাম্য কীভাবে রক্ষা হবে—এই প্রশ্নগুলোর জবাব খুঁজে পাওয়া সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। পুনর্গঠনের জন্য নেপালের বহিরাগত সহায়তা দরকার, কিন্তু একটি শক্তির দিকে অতিরিক্ত ঝুঁকে পড়া পররাষ্ট্রনীতিকে ব্যাহত করতে পারে।’
অন্যদিকে, কোভিড-পরবর্তী সময়ে ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়ানো নেপালের পর্যটন খাত সাম্প্রতিক বিক্ষোভে আবারও সংকটে পড়েছে। কাঠমান্ডু-ভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক সেন্টার ফর সাউথ এশিয়ান স্টাডিজের পরিচালক নিশ্চল এন পান্ডে বলেন, ‘নভেম্বর-ডিসেম্বর আমাদের পর্যটনের মৌসুম। এই সময়ে নেপালের স্থিতিশীলতার বার্তা বিশ্বে পৌঁছে দিতে হবে।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষক সিডি ভাট্টা মনে করেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলির কূটনৈতিক পদক্ষেপ অনেকটা বর্তমান সংকটের জন্য দায়ী। তিনি বলেন, চীনে সামরিক কুচকাওয়াজে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেপালের দীর্ঘদিনের উন্নয়ন অংশীদার জাপানের কাছে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
সম্প্রতি অলি সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার (এসসিও) সম্মেলনে যোগ দিতে চীন সফর করেন এবং সেখানে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করেন।
ভাট্টার মতে, ‘এই সরকার যেহেতু আন্দোলনের ফল, তাই প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলা এখনই প্রয়োজন। অভ্যন্তরীণ রাজনীতির স্থিতিশীলতা ছাড়া বহিরাগত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। তবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ভূমিকা সীমিত থাকবে।’
সব মিলিয়ে, নেপালের নতুন সরকারের সামনে এখন দ্বৈত চ্যালেঞ্জ—দেশের ভেতরে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা এবং বাইরে আন্তর্জাতিক আস্থা অর্জন। কোন পথে সরকার এগোবে, সেটিই নির্ধারণ করবে কার্কির নেতৃত্বে নেপালের ভবিষ্যৎ।