ঢাকা রবিবার, ১৩ জুলাই, ২০২৫

চীনের হুমকি, নতুন সংকটে মিয়ানমার

বিশ্ব ডেস্ক
প্রকাশিত: জুলাই ৮, ২০২৫, ০৫:২৬ পিএম
ছবি- সংগৃহীত

বিশ্বের অর্ধেকের বেশি ভারী বিরল মাটির খনিজ আসে মিয়ানমারের কাচিন রাজ্যের খনি থেকে। এসব খনিজ চীনে পাঠানো হয় চুম্বক তৈরির জন্য, যা ইলেকট্রিক গাড়ি ও উইন্ড টারবাইনের মতো প্রযুক্তি পণ্যে ব্যবহৃত হয়।

কিন্তু এখন এই খনিজের সরবরাহ হুমকির মুখে। কারণ কাচিন রাজ্যের ভামো শহরের আশপাশে জান্তা সরকারের সেনাবাহিনী ও কাচিন ইন্ডিপেনডেন্স আর্মির (কেআইএ) মধ্যে তীব্র যুদ্ধ চলছে। চীনা সীমান্ত থেকে মাত্র ১০০ কিলোমিটার (৬২ মাইল) দূরে এই লড়াই শুরু হয়েছে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর থেকে।

বিষয়টি সম্পর্কে অবগত তিনজন ব্যক্তির মতে, চীনের প্রায় একচেটিয়া দখল রয়েছে এই ভারী বিরল খনিজ প্রক্রিয়াকরণে। আর সেই প্রভাব কাজে লাগিয়ে বেইজিং চাপে রাখছে দুই পক্ষকে। চীনা কর্মকর্তারা হুমকি দিয়েছেন যদি মিলিশিয়ারা (কেআইএ) গ্যারিসন শহর ভামোর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিতে চায়, তাহলে তারা ওই অঞ্চলে খনন করা খনিজ আর কিনবে না।

চীনের এই বার্তা স্পষ্ট করে দেয় বেইজিং তার ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করতে খনিজ সম্পদের ওপর নিজেদের প্রভাবকে কৌশলগতভাবে ব্যবহার করছে।

রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কেআইএ-এর দুইজন কর্মকর্তা বলেন, গত মে মাসে এক বৈঠকে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা এই হুমকি দিয়েছিল। তবে আলোচনা কোথায় হয়েছে, তা জানা যায়নি।

চীন তার হুমকি সত্যিই বাস্তবায়ন করেছে কি না তা এখনও নিশ্চিত করে বলতে পারেনি রয়টার্স। তবে যুদ্ধের কারণে কাচিন রাজ্যে খনির কাজ অনেকটাই কমে গেছে, আর এ বছর মিয়ানমার থেকে বিরল মাটির খনিজ রপ্তানিও উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে।

এই পরিস্থিতিতে চীন আরও একবার তার প্রভাব দেখিয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চীনা পণ্যের ওপর শুল্ক বসানোর পর প্রতিশোধ হিসেবে চীন এই বসন্তে খনিজ রপ্তানি সীমিত করেছিল। এতে বিশ্বজুড়ে খনিজ সরবরাহ শৃঙ্খলে অস্থিরতা তৈরি হয়।

বেইজিং এখন একইরকম কৌশল নিচ্ছে মিয়ানমারেও। তারা জান্তা সরকারকে একটি ‘অর্থনৈতিক গ্যারান্টর’ হিসেবে দেখছে এবং সেই সরকারকে টিকিয়ে রাখতে খনিজ সম্পদের নিয়ন্ত্রণকে ব্যবহার করছে।

চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় রয়টার্সকে জানিয়েছে, কেআইএ-এর সঙ্গে আলোচনায় কী বলা হয়েছে তারা তা নির্দিষ্টভাবে জানে না। তবে মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্র বলেন, ‘মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও কাচিন বাহিনীর মধ্যে শান্তি আলোচনা এবং যুদ্ধবিরতি হওয়া দরকার, যাতে দুই দেশের জনগণের স্বার্থ রক্ষা হয়।’

এদিকে কেআইএ-এর এক জ্যেষ্ঠ জেনারেল মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে কেআইএ-এর এক কর্মকর্তা জানান, বেইজিং শুধু হুমকি দেয়নি, একটা ‘লোভনীয় প্রস্তাব’ও দিয়েছে, যদি মিলিশিয়ারা ভামো শহরের (যেখানে জান্তার গুরুত্বপূর্ণ লজিস্টিক ঘাঁটি আছে) নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা বন্ধ করে তাহলে চীন কেআইএ-নিয়ন্ত্রিত এলাকায় সীমান্ত বাণিজ্য আরও বাড়াবে।

কিন্তু তিনি সতর্ক করে বলেন, ‘আমরা যদি এই প্রস্তাব না মানি তাহলে চীন কাচিন থেকে বিরল মাটি খনিজ কেনা বন্ধ করে দেবে।’ যদিও এর অর্থনৈতিক প্রভাব নিয়ে তিনি বিস্তারিত কিছু বলেননি।

মিয়ানমারভিত্তিক বিশ্লেষক ডেভিড ম্যাথিসনের মতে, চীন চায় না মিয়ানমারের পুরো গৃহযুদ্ধ থেমে যাক, বরং তারা চায় সংঘর্ষ নিয়ন্ত্রিত থাকুক, যাতে চীনের অর্থনৈতিক স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।

তার কথায়, ‘চীন এভাবে চাপ দিয়ে সংঘর্ষ একটু কমিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। তবে পুরো শান্তি নয়, কিন্তু নিজের স্বার্থ রক্ষায় যথেষ্ট।’

‘চীনকে অগ্রাহ্য’

গত অক্টোবরে কেআইএ কাচিন রাজ্যের প্রধান বিরল মাটি খনিজ অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পরপরই ভামো শহর নিয়ে তীব্র লড়াই শুরু হয়। খনি নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পর, কেআইএ খনি শ্রমিকদের ওপর কর বাড়ায় এবং দুটি গুরুত্বপূর্ণ খনিজ ডিসপ্রোজিয়াম ও টারবিয়ামের উৎপাদন কমিয়ে দেয়। ফলে খনিজের দাম হঠাৎ করে অনেক বেড়ে যায়।

চীনের কাস্টমস তথ্য অনুযায়ী, সরবরাহও অনেক কমে গেছে। ২০২৫ সালের প্রথম পাঁচ মাসে চীন মিয়ানমার থেকে মাত্র ১২ হাজার ৯৪৪ মেট্রিক টন বিরল মাটি খনিজ আমদানি করেছে, যা গত বছরের তুলনায় প্রায় অর্ধেক। যদিও এপ্রিল থেকে মে মাসে রপ্তানি কিছুটা (২০ শতাংশের বেশি) বেড়েছে।

বিশ্লেষকদের মতে, কেআইএ-তে ১৫ হাজারের বেশি কর্মী আছে। ১৯৬১ সালে কাচিন জাতিগোষ্ঠীর স্বায়ত্তশাসনের জন্য সংগঠনটি গঠিত হয়েছিল। কয়েক দশকের যুদ্ধে শক্তিশালী হয়ে ওঠা এই গোষ্ঠী স্থানীয় খনিজ, কর ও সম্পদ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে, যা তাদের মিয়ানমারের অন্যতম শক্তিশালী বিদ্রোহী গোষ্ঠীতে পরিণত করেছে।

দুইজন ঘনিষ্ঠ সূত্র জানিয়েছেন, কেআইএ-র যোদ্ধারা আত্মবিশ্বাসী যে তাদের ভামো দখলের ক্ষমতা আছে এবং চীন শেষ পর্যন্ত খনিজ আমদানি পুরোপুরি বন্ধ করবে না। কারণ বেইজিং এই খনিজের উপর অনেকটাই নির্ভরশীল।

২০২১ সালে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়। এরপর দেশজুড়ে সহিংস বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে এবং একের পর এক বিদ্রোহ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, যার মধ্যে কেআইএ অন্যতম। এখন এই সংঘর্ষের জটিলতা প্রভাব ফেলছে আন্তর্জাতিক খনিজ বাজারেও।

পরবর্তীতে জান্তা-বিরোধী বাহিনী কাচিনের কিছু এলাকা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিলেও বিদ্রোহীরা এখন চীনের চাপের মুখে পড়েছে, যেখানে বেইজিং সেনাবাহিনীর সঙ্গে আপস করতে বলছে।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্টিমসন সেন্টারের তথ্য অনুযায়ী, চীন মিয়ানমারের জান্তা সরকারকে জেট ফাইটার ও ড্রোন সরবরাহ করেছে। কারণ জান্তা ক্রমেই বিমান শক্তির উপর নির্ভরশীল হয়ে উঠছে।

মিয়ানমারে বড় বিনিয়োগকারী দেশ চীন গত বছর জান্তার সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে একটি যুদ্ধবিরতির ব্যবস্থা করে। এর মাধ্যমে তারা উত্তর-পূর্বাঞ্চলের শহর লাশিওতে জান্তার আঞ্চলিক সামরিক ঘাঁটি পুনরুদ্ধার করতে সহায়তা করে।

ভামো আক্রমণের বিষয়ে জানেন এমন কেআইএ-র এক কমান্ডার জানান, ভামোর দিকে উত্তর থেকে ২০০ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করে প্রায় পাঁচ হাজার কেআইএ যোদ্ধা ও মিত্র গোষ্ঠী এই অভিযানে অংশ নিয়েছেন।

অন্যদিকে, ২০২১ সালের অভ্যুত্থানের পর সেনাবাহিনী থেকে সরে আসা মেজর নাউং ইয়ো বলেন, যদি বিদ্রোহীরা ভামো দখল করতে পারে তাহলে সেনাবাহিনীর জন্য কাচিন ও আশপাশের অনেক এলাকায় ভূমি ও নদীপথে চলাচল বন্ধ হয়ে যাবে। এতে অনেক সামরিক ঘাঁটি বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে এবং উত্তর মিয়ানমারের বাণিজ্য পথেও সেনাদের নিয়ন্ত্রণ দুর্বল পড়বে।

রয়টার্স জানিয়েছে, জান্তা সরকারের মুখপাত্রের দপ্তর স্বীকার করেছে চীন হয়তো কেআইএ-র সঙ্গে আলোচনা করেছে। তবে চীন আসলে বিদ্রোহীদের অবরোধের হুমকি দিয়েছে কি না, সে প্রশ্নের জবাব দেয়নি।

এক বিবৃতিতে তারা বলেছে, ‘চীনের ওপর চাপ প্রয়োগ করা হয়ে থাকতে পারে, আর কেআইএ-কে কিছু সুবিধার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়ে থাকতে পারে।’ ভামো নিয়ে চলমান যুদ্ধ শুধু সামরিক নয়—এটি চীন, বিদ্রোহী গোষ্ঠী ও জান্তা সরকারের মধ্যকার একটি জটিল কৌশলগত লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে।

কাচিন ইন্ডিপেনডেন্স আর্মির এক কর্মকর্তার মতে, ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের শুরুতে চীনের সঙ্গে আলোচনার সময় বেইজিং প্রথমে বিদ্রোহীদের ভামো শহর থেকে সরে যাওয়ার পরামর্শ দেয়। কিন্তু সেই প্রস্তাবে সাড়া না দিয়ে, কেআইএ বরং লড়াই আরও জোরদার করে।

তবে এই যুদ্ধে কেআইএ বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছে। আন্তর্জাতিক প্রতিরক্ষা গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ মে মাসে জানায়, ভামোর যুদ্ধে কেআইএর অনেক সম্পদ ধ্বংস হয়েছে এবং শত শত যোদ্ধা হতাহত হয়েছে।

কর্মকর্তাটি আরও বলেন, বসন্তকালে আরও একটি আলোচনায় চীন আগের চেয়ে কড়া অবস্থান নেয়। তখন তাদের প্রতিনিধিরা কেআইএ-নিয়ন্ত্রিত খনি থেকে বিরল খনিজ ক্রয় বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দেয়।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক পরামর্শদাতা প্রতিষ্ঠান বেঞ্চমার্ক মিনারেল ইন্টেলিজেন্সের বিশ্লেষক নেহা মুখার্জি বলেন, কাচিন থেকে ভারী বিরল মাটি খনিজের সরবরাহ ব্যাহত হলে, বছরের শেষের দিকে বিশ্ব বাজারে ঘাটতির সম্ভাবনা তৈরি হবে। তিনি বলেন, ‘চীনের বাইরে এই খনিজের উৎস এমনিতেই সীমিত। ফলে এমন যেকোনো বিঘ্নে দাম আরও বেড়ে যাবে।’

ভামো দখলের লড়াই

কেআইএ-র এক কমান্ডার জানান, তারা ভামো শহরে জান্তার সেনাদের ছত্রভঙ্গ করে কয়েকটি ছোট ছোট পকেটে আটকে ফেলেছে। তবে জান্তার বিমানবাহিনী এখনো বড় সুবিধা নিয়ে আছে। তারা ভামো শহরের বহু এলাকা একের পর এক বিমান হামলা চালিয়ে ধ্বংস করেছে—এ কথা জানিয়েছেন কেআইএ’র কমান্ডার, এক কর্মকর্তা ও শহরের এক প্রাক্তন বাসিন্দা।

জান্তা সরকারের মুখপাত্র দাবি করেছে, এসব এলাকায় কেআইএ সামরিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করছিল, তাই হামলা চালানো হয়েছে। যদিও তারা এর পক্ষে কোনো প্রমাণ দেখায়নি।

অস্ট্রেলিয়ার স্ট্র্যাটেজিক পলিসি ইনস্টিটিউট-এর এক বিশ্লেষক স্যাটেলাইট ছবি বিশ্লেষণ করে বলেন, ভামোর বেশিরভাগ ধ্বংসই বিমান হামলার কারণে হয়েছে বলে মনে হচ্ছে।

ভামোর কাচিন মানবাধিকার কর্মী খোন জা জানান, এসব হামলায় শিশুসহ বহু সাধারণ মানুষ নিহত হয়েছে, ধ্বংস হয়েছে স্কুল ও উপাসনালয়। এমনকি তার নিজের বাড়িও বোমার আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

তিনি বলেন, ‘আমি জানি না, কেআইএ আর কতদিন চীনের চাপ সহ্য করতে পারবে।’ সীমান্তে কড়াকড়ির কারণে কাচিনে জ্বালানি ও ওষুধের সংকট দেখা দিয়েছে। তবু কেআইএ-র নেতারা বিশ্বাস করেন, ভামো দখল করলে যুদ্ধের গতি তাদের দিকে ঘুরে যাবে এবং জনগণের সমর্থনও আরও বাড়বে।

কমান্ডার ও কর্মকর্তারা বলেন, যদি কেআইএ ও তাদের মিত্র বাহিনী পুরো কাচিন রাজ্য নিয়ন্ত্রণে নিতে পারে, তাহলে চীনের আর কোনো উপায় থাকবে না তাদের বিদ্রোহীদের সঙ্গেই আলোচনা করতে হবে এবং জান্তাকে পাশ কাটিয়ে চলতে হবে।

কমান্ডার বলেন, ‘চীন যেহেতু বিরল খনিজের ওপর নির্ভরশীল, তারা এই পরিস্থিতি খুব বেশি দিন সহ্য করতে পারবে না।’