গাজায় জরুরি চিকিৎসাসেবা গ্রহণকারী শিশুরা আসন্ন সময়ে আরও গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে বা এমনকি মারা যাওয়ার ঝুঁকিতেও রয়েছে—এমন সতর্কবার্তা দিয়েছেন চিকিৎসকরা। কারণ উপত্যকায় জ্বালানি দ্রুত ফুরিয়ে আসছে আর হাসপাতালগুলো বাধ্য হয়ে ইনকিউবেটরসহ গুরুত্বপূর্ণ সরঞ্জাম বন্ধ করে দিচ্ছে।
দক্ষিণ গাজার খান ইউনিসের নাসের হাসপাতালে নবজাতক ইউনিটে ইনকিউবেটরের সারির মাঝ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হাসপাতালের শিশু ইউনিটের প্রধান ডা. আহমেদ আল-ফাররা প্রতিটি শিশুর অবস্থা তুলে ধরেন এনবিসি নিউজের একটি দলের কাছে।
এক নবজাতকের দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, ‘এই শিশুটি পূর্ণকালীন জন্মানো। আপনি দেখতে পাচ্ছেন, সে সম্পূর্ণভাবে যান্ত্রিক ভেন্টিলেশনের ওপর নির্ভরশীল। যদি বিদ্যুৎ বন্ধ হয়ে যায়… এই শিশুটি বাঁচবে না।’ শিশুটির শরীর ছোট, ডায়াপারে মোড়ানো এবং নাকে অস্ত্রোপচারের টেপ দিয়ে লাগানো একটি অক্সিজেন টিউব।
তার এই বক্তব্য যুদ্ধের শুরুর দিকের সেই দুঃসহ স্মৃতি ফিরিয়ে আনে, যখন উত্তর গাজার হাসপাতালে শিশুদের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছিল।
জাতিসংঘের মানবিকবিষয়ক সমন্বয় অফিস (ওসিএইচএ) বুধবার সতর্ক করে বলেছে, গাজায় জ্বালানি শেষ হয়ে আসায় নাসের হাসপাতালসহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র ‘আসন্ন বন্ধের’ মুখে। হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা ও নবজাতক ইউনিটের মতো অংশগুলোর বন্ধ হয়ে যাওয়া সরাসরি রোগীদের মৃত্যুর কারণ হতে পারে।
ওসিএইচএ জানায়, গত প্রায় ১৩০ দিন ধরে ‘ইসরায়েল’ গাজায় জ্বালানির সরবরাহ পুরোপুরি নিষিদ্ধ করে রেখেছে, যার ফলে পানীয় জল, স্যানিটেশন ও স্বাস্থ্যসেবাও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মে মাসে ‘ইসরায়েল’ খাদ্য ও ওষুধসহ কিছু জরুরি পণ্যের প্রবেশের অনুমতি দিলেও তা ছিল খুবই সীমিত এবং মৌলিক চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল।
জ্বালানি সংকটের বিষয়ে মন্তব্যের অনুরোধে ‘ইসরায়েলি’ প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর মুখপাত্র ডেভিড মেনসার বলেন, ‘গাজার শিশুদের জন্য আসল হুমকি জ্বালানির ঘাটতি নয়, বরং হামাস।’ তিনি দাবি করেন, ‘হামাস হাসপাতালের জন্য নয়, সন্ত্রাসের জন্য জ্বালানি চুরি করে।’ তবে গাজায় আরও জ্বালানি প্রবেশ করতে দেওয়া হবে কি না, এই প্রশ্নের জবাবে তিনি কিছু বলেননি।
এদিকে, ‘ইসরায়েলি’ সামরিক বাহিনীর ফিলিস্তিন সংক্রান্ত দপ্তর সিওজিএটি তাৎক্ষণিকভাবে কোনো মন্তব্য করেনি।
নাসের হাসপাতালের নার্সিং পরিচালক ডা. মোহাম্মদ সাকের এনবিসি নিউজকে জানান, হাসপাতালে এখন মাত্র ৩ হাজার লিটার (৭৯০ গ্যালন) ডিজেল অবশিষ্ট আছে, অথচ প্রতিদিন কার্যকরভাবে হাসপাতাল পরিচালনার জন্য প্রয়োজন ৪ হাজার ৫০০ লিটার (১ হাজার ১৯০ গ্যালন)। তিনি বলেন, বিদ্যুৎ সংরক্ষণের জন্য হাসপাতাল ইতোমধ্যে কিছু বিভাগ বন্ধ করে দিয়েছে এবং কেবল গুরুত্বপূর্ণ ইউনিটগুলোতে বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে।
সাকের বলেন, ‘পরিস্থিতি অত্যন্ত ভয়াবহ। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বিদ্যুৎ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যেতে পারে, যার অর্থ বহু রোগী বিশেষ করে আইসিইউ ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিভাগে থাকা রোগী মৃত্যুর ঝুঁকিতে পড়বে।’
‘ইসরায়েলি’ হামলায় ব্যাপক ক্ষতির পর গাজার হাসপাতালগুলো দীর্ঘদিন ধরে সংকটে পড়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সোমবারের সর্বশেষ তথ্যে বলা হয়েছে, ভূখণ্ডের ৩৬টি হাসপাতালের মধ্যে কোনোটি পূর্ণমাত্রায় কার্যকর নয়। এর মধ্যে ১৮টি ভাগে সেবা দিচ্ছে এবং বাকি ১৮টি একেবারেই বন্ধ।
এই সংকটে ডা. সাকের আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, তারা যেন গাজার হাসপাতালগুলোতে জরুরি ভিত্তিতে জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করেন, যাতে ‘শিশুদের জীবন রক্ষা করা যায়’।
এদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্র নীতিবিষয়ক প্রধান কাজা ক্যালাস বৃহস্পতিবার এক্স-এ এক পোস্টে জানান, ইইউ কর্মকর্তারা ‘ইসরায়েলে’র সঙ্গে একটি নতুন চুক্তিতে পৌঁছেছেন, যার আওতায় গাজায় সীমিত পরিসরে খাদ্য ও জ্বালানি প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হবে।
তিনি বলেন, এই চুক্তির ফলে ‘আরও বেশি ক্রসিং খোলা, ত্রাণ ও খাদ্যবাহী ট্রাক গাজায় প্রবেশ, গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো মেরামত এবং ত্রাণকর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা’ সম্ভব হবে।
বার্তা সংস্থা এপি জানিয়েছে, ভিয়েনায় এক সম্মেলনে ‘ইসরায়েলে’র পররাষ্ট্রমন্ত্রী গিদিওন সা’আরও এই চুক্তির বিষয়টি স্বীকার করেছেন।