ঢাকা রবিবার, ২০ জুলাই, ২০২৫

মার্কিন বাঙ্কার বাস্টার বোমা ধ্বংসের কৌশল বের করল চীনা বিজ্ঞানীরা

বিশ্ব ডেস্ক
প্রকাশিত: জুলাই ১৯, ২০২৫, ০৯:১০ পিএম
বি-২ স্টিলথ বোমারু বিমান থেকে পড়ছে জিবিইউ-৫৭ এমওসি বোমা। ছবি- সংগৃহীত

সম্প্রতি ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনা ধ্বংসের উদ্দেশ্যে হামলা চালিয়ে বিশ্বব্যাপী তোলপাড় ফেলে দিয়েছিল আমেরিকা। প্রথমবারের মতো জিবিইউ-৫৭ ম্যাসিভ অর্ডন্যান্স পেনিট্রেটর (এমওসি) বাঙ্কার বিধ্বংসী বোমা ব্যবহার করেছিল পেন্টাগন। আর কয়েক ঘণ্টা ধরে বোমাগুলো আকাশে উড়িয়েছিল বি-২ স্টিলথ বোমারু বিমান। ওই হামলায় যৎসামান্যই ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করেছে তেহরান। তবে ওয়াশিংটন আর তেল আবিবের দাবি ছিল ঠিক বিপরীত।

আধুনিক বোমা বা ক্ষেপণাস্ত্রের তুলনায় বাঙ্কার ধ্বংসকারী ভয়ংকর এই বোমাগুলোর গতি অনেকটাই কম। ধীরে ধীরে উড়ে আসে, তবে এদের ওয়ারহেড বিশাল এবং শক্ত বর্মে মোড়ানো থাকে। যেসব ছোট দেশগুলোর বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থা শক্তিশালী নয়, তারা এই বোমাগুলোর আঘাত আসতে দেখে শুধু অসহায়ভাবে তাকিয়েই থাকতে পারে। গত ২২ জুন মার্কিন বি-২ স্টিলথ বোমারু বিমানের হামলার সময় খুব কম প্রতিরোধ দেখা গেছে।

এই পরিস্থিতিতে চীনা গবেষকরা দুর্বল জায়গায় আঘাত হানতে একটি বিকল্প প্রতিরক্ষা কৌশলের প্রস্তাব দিয়েছেন। কারণ বোমাটির সামনের অংশটি পুরু বর্মে আবৃত হলেও পাশের স্টিলের আবরণ অনেক পাতলা, মাত্র কয়েক সেন্টিমিটার। ফলে একটি বা দুটি বিমান বিধ্বংসী গোলাই সেটিকে ধ্বংস করতে পারে।

তাদের মতে, গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় অপেক্ষাকৃত সস্তা বিমান বিধ্বংসী কামান মোতায়েন করা যেতে পারে। তবে এই কামানগুলোকে টিকে থাকতে হবে, রাডারে লক্ষ্যবস্তু শনাক্ত করতে হবে এবং ইলেকট্রনিক যুদ্ধের প্রতিকূলতা মোকাবিলার সক্ষমতাও থাকতে হবে।

সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট জানায়, চীনা গবেষকরা তাদের নিজস্ব অস্ত্র নয়, বরং কম্পিউটার সিমুলেশনে সুইস তৈরি ওরলিকন জিডিএফ বিমান-বিধ্বংসী বন্দুক ব্যবহার করেছেন। এই বন্দুক মধ্যপ্রাচ্যে, বিশেষ করে ইরানে ব্যাপকভাবে মোতায়েন রয়েছে। জিডিএফ বন্দুক মাত্র দুই সেকেন্ডে ৩৬টি গোলা ছুড়তে সক্ষম। প্রায় ১ হাজার ২০০ মিটার (০.৭ মাইল) দূরে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করার ক্ষেত্রে এর সাফল্যের সম্ভাবনা প্রায় ৪২ শতাংশ।

চীনের অস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান নরিঙ্কোর অধীনস্থ নর্থওয়েস্ট ইনস্টিটিউট অব মেকানিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর গবেষক কুই জিংইয়ের নেতৃত্বে একটি গবেষণা দল এই পদ্ধতিটি নিয়ে কাজ করেছে। তারা এটি ১৪ এপ্রিল জার্নাল অব গান লঞ্চ অ্যান্ড কন্ট্রোল নামের চীনের শীর্ষ অস্ত্র গবেষণা সাময়িকীতে প্রকাশ করে।

গবেষণায় বলা হয়, স্মার্ট বোমাগুলোর সামনের ডিম্বাকৃতি অংশ আঘাতের দিক পরিবর্তন করে ফেলায় সামনে থেকে সহজে ভেদ করা যায় না। তবে পাশের দিকগুলো তুলনামূলকভাবে দুর্বল এবং সেগুলো ভেদ করা সম্ভব। এজন্য আঘাতের কোণ অবশ্যই ৬৮ ডিগ্রির নিচে রাখতে হবে।

তবে লক্ষ্যবস্তু ১ হাজার ৫০০ মিটারের বেশি দূরে থাকলে গোলাগুলি ভেদ করতে পারে না। কিন্তু ১ হাজার ২০০ মিটারের মধ্যে থাকলে বোমার ভেতরের নিষ্ক্রিয় বিস্ফোরক তাপ ও ছিদ্রের কারণে সক্রিয় হয়ে বিস্ফোরিত হতে পারে। গণনাগুলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্যবহৃত বর্ম-ভেদ সূত্রের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে। বিজ্ঞান খুব জটিল নয়, তবে কৌশলটা গুরুত্বপূর্ণ।

এই কৌশলকে গবেষকরা বলেছেন ‘স্নাইপার ফায়ার কন্ট্রোল’। এর মানে হলো স্মার্ট বোমা উড়ে আসার সময় তার নির্দিষ্ট কোনো দুর্বল স্থানে বন্দুকের গোলাগুলি লাগাতে হবে। এই লক্ষ্যবিন্দুটি যত কাছাকাছি থাকবে, বন্দুকের ব্যারেল তত কম সমন্বয়ে স্থির অবস্থায় থাকতেও পারবে, ফলে লক্ষ্যভেদের সম্ভাবনাও বাড়বে।

ওরলিকন জিডিএফ বিমান-বিধ্বংসী বন্দুক। ছবি- সংগৃহীত

কুইয়ের গবেষণা দল তাদের প্রতিবেদনে লিখেছে, ‘এই স্নাইপার-ধরনের প্রতিরক্ষা কৌশলের বেশ কিছু সুবিধা রয়েছে।’ তাদের মতে, এই পদ্ধতিতে সার্ভো সিস্টেমের উপর নির্ভরতা কমে এবং পুনরাবৃত্তিমূলক জটিল গণনার প্রয়োজন হয় না, ফলে প্রতিক্রিয়ার সময় এক মিলিসেকেন্ডেরও কমে নেমে আসে। ‘এটি বর্তমান প্রযুক্তি দিয়েই তৈরি ও কার্যকর করা সম্ভব’ বলে জানিয়েছে গবেষক দলটি।

তবে বাস্তব যুদ্ধক্ষেত্র কঠিন ও নিষ্ঠুর। বিমান বাহিনী বড় ধরনের সামরিক অভিযান চালিয়ে আগে থেকেই এসব বিমান-বিধ্বংসী বন্দুকগুলো ধ্বংস করতে পারে। আর স্মার্ট বোমাগুলোর হঠাৎ কৌশল পরিবর্তন আগেভাগে করা সব পূর্বাভাসকে ব্যর্থ করে দিতে পারে। এমনকি ১ হাজার ২০০ মিটারের আক্রমণ-সুযোগও চোখের পলকে শেষ হয়ে যেতে পারে।

এই গবেষণার সঙ্গে যুক্ত নন বেইজিং-ভিত্তিক একজন পদার্থবিদ সতর্ক করে বলেন, ‘যেটা চীনে কাজ করে, সেটা অন্য কোথাও কাজ নাও করতে পারে।’