রাজধানীর ক্যান্টনমেন্ট থানা এলাকায় চিহিুত সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ ও দখলবাজদের দৌরাত্ম চরমে পৌছেছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ক্যান্টনমেন্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আব্দুল আলিম ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে নিজেই সন্ত্রাসীদের প্রশ্রয় দিচ্ছেন। ওসি আলিমের বিরুদ্ধে ঘুষ গ্রহণ, স্বেচ্ছাচারিতা, লকাপে রেখে মারধর ও হেনস্তা এবং ভূমিদস্যুদের পক্ষ নিয়ে নিরপরাধদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা রেকর্ড করার অভিযোগ উঠেছে।
এ বিষয়ে পুলিশ সদরদপ্তরের আইজিপির কমপ্লেইন মনিটরিং সেল ও ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের(ডিএমপি) কমিশনার বরাবর লিখিত অভিযোগ করেছে মাটিকাটা এলাকার ভুক্তভোগী মো. শাহজাদা মিয়া ও মো. আরিফুল আলী।
ভুক্তভোগী মো. শাহজাদা মিয়া অভিযোগ করেছেন, ক্যান্টমেন্ট থানাধীণ দক্ষিণ মানিকদী হোল্ডিং নাম্বার ৫১২ যৌথ মালিকানায় ৮ কাঠা জমির উপর ১০তলা নিমার্ণাধীন আবাসিক ভবণের কেয়ারটেকার হিসাবে কর্মরত আছি। উল্লেখিত আসামীগণের সাথে আমার ভবন মালিকদের জোয়ার সাহার মৌজাস্থিত সিটি দাগ নং ৩৪৩০১, ৩৪৩০৪,৩৪৩০৬ নং দাগের সীমানা নিয়া দীর্ঘ দিন যাবত বিরোধ চলিয়া আসিতেছে।
গত ৭ মে বেলা সোয়া ১০টার দিকে পূর্ব শত্রুতার জের ধরে মো. মাসুদ ভবন নিমার্ণ কাজে নিয়োজিত দুইজন কর্মী মো. আরজু (৫৫) ও মো. প্রিন্স নিমার্ণধীন ভবনের প্রবেশ পথ দিয়ে স্বাভাবিক চলাচলের সময় তাদের কে অকাথ্য ভাষায় গালাগালি ভয়ভীতি এবং প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে তাদেরকে কিল ঘুষি পরে লাঠি দিয়ে আঘাত করলে তার ডাক চিৎকার শুনলে অন্যান্য নিমার্ণ শ্রমিক এগিয়ে আসলে মাসুদ তাদের কে আবার দেখে নিবে বলে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে চলে যায়।
এই ঘটনায় স্থানীয় আর্মি ক্যাম্পে আসামী মাসুদের বিরুদ্ধে মৌখিক অভিযোগ করলে উল্লেখিত আসামীগণ আরো ক্ষিপ্ত হয়ে গত ১৩ মে বিকাল পৌনে ৫টার দিকে ঘটনাস্থলে দেশিয় অস্ত্র সস্ত্রে সজ্জিত হয়ে আমাদের লোহার গেট ভেঙ্গে নির্মাণনাধীন ভবণে প্রবেশ করে নির্মাণ কাজে নিয়োজিত শ্রমিকদের এলোপাতাড়ি মারধর করে নীলা পুলা জখম করে এসময় মো. মেজবা এবং মো. হাসিব হাতে থাকা লাঠি দিয়ে ৪ টি সিসি ক্যামেরা ভাচুর শুর করে এবং নজরুল ইসলাম এবং মো. জামির আলী ভবন নির্মাণ কাজে ব্যবহারের জন্য কঝজগ কোম্পানীর ৪ টন ২০ মিলি, ২ টন ১২ মিলি এবং ১.৫ টন ১০ মিলি রড ও ১০০ ব্যাগ সিমেন্ট নিয়া যায়।
তাদের এহেন কর্মকান্ডের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করার জন্য অত্র নির্মাণধীণ ভবনের একজন শেয়ার হোল্ডারের ভাই মো. তাজ উদ্দিন ভূইয়া (৩২) এগিয়ে আসলে মো. রাশেদ তার হাতে থাকা চাপাতি দিয়ে হত্যার উদ্দেশ্যে মো. তাজ উদ্দিন এর মাথার বামপাশের কপালের ঠিক একটু উপরে হত্যার উদ্দেশ্যে স্বজোরে কোপ দিলে মাথায় ১ ইঞ্চি পরিমাণ গর্ত সৃষ্টি করে এবং মাথায় লম্বালম্বি ৩ ইঞ্চি প্রসহ মারাত্মক জখম করে।
মাসুদ, নজরুল ইসলাম, মো. জামির আলী, রনি ওরফে টিকটিকি রনি, মেজবাহ, হাসিব, নাজমা সবাই একত্রিত হয়ে মো. তাজ উদ্দিনকে তার মাথার পিছনে দেশীয় রড এবং ইট দিয়ে এলোপাতালি আঘাত করলে মারাত্মকভাবে জখম হয় এবং রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। মাসুদ গলা চেপে ধরে এবং কিল ঘুষি লাথি মারতে থাকে নাজমা বাম পকেট থেকে ২০ হাজার টাকা এবং আসামী রণি ডান পকেট থেকে একটি মুঠোফোন নিয়ে যায়।
পরবর্তীতে আমিসহ আশে পাশের লোকজন এগিয়ে গেলে আসামীরা দৌড়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় আমাকে বলে তোকে এবং তোর মালিকদের কে প্রাণে মেরে ফেলবো। তৎপরবর্তীতে আমি তাজ উদ্দিনকে উদ্ধার করে কুর্মিটোলা জেনারেল হসপিটালে নিয়ে যাই সেখানে প্রাথমিকভাবে মাথায় সেলাই করে এবং প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে আরো উন্নত চিকিৎসার জন্য আগারগাঁও নিউরো সাইন্স হসপিটালে স্থানান্তর করি এবং বর্তমানে তার অবস্থা আশংখাজনক।
পুলিশ সদরদপ্তর ও ডিএমপিতে অভিযোগে জানানো হয়েছে, উক্ত ঘটনায় আমি ক্যান্টনমেন্ট থানায় বেলা ৩টার দিকে মামলা করতে যাই থানায় গিয়ে ডিউটি অফিসারকে বলি আমি এজহার দায়ের করবো, তিনি বললেন ওসি সাহেব থানার বাহিরে আছেন আপনি অপেক্ষা করেন। আমি ওসি সাহেবের জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। পরবর্তীতে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে সন্ত্রাসী রাশেদ এবং ৩টি মটর সাইকেলে অজ্ঞাত আরো ৫ জন এসে কলার চেপে ধরে আমাকে কিল ঘুষি চর থাপ্পর শুরু করে বলে এত বড় সাহস থানায় মামলা করতে আসচোছ। তার পরক্ষণে ওসি এসে আমাকে নানা প্রকার হয়রানী ও হেনস্তা শুরু করে প্রথমে স্বজোরে ধাক্কা দিয়ে থানার লকাপে ঢুকিয়ে দেয়।
লকাপে থাকাবস্থায় আব্দুল আলিম নানা প্রকার ভয়ভীতি এবং হয়রানী করতে থাকেন। আমাকে লকাপে রেখে সন্ত্রাসী রাশেদ কে মামলা রেডি করতে বলে এবং আমার মালিকের বিরুদ্ধে মামলা করে। আমাকে সারারাত লকাপে রাখে। পরদিন সকাল ৯টা দিকে ডিউটি অফিসার জানায় আপনার মামলা এন্ট্রি করা হয়েছে আপনি যেতে পারেন। এই বলে আমাকে লকাপ থেকে বের করে দেয়। আমি সন্ত্রাসী রাসেদ এবং তার সহযোগীদের মারধোর, ওসি কর্তৃক নানা প্রকার হেনস্তার স্বীকার হয়ে গুরুত্বর অসুস্থ হয়ে পড়ি। তারপর থানা থেকে বের হয়ে আমি কুর্মিটোলা জেনারেল হসপিটালে চিকিৎসা গ্রহণ করি।
অন্যদিকে, আরেক ভুক্তভোগী মো. আরিফুল আলী অভিযোগে বলেছেন, গত ২০২৪ সালের ২৮ অক্টোবর তাকেসহ ১৬ জনকে আসামি করে ক্যান্টনমেন্ট থানায় একটি মিথ্যা মামলা রেকর্ড করেন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। অথচ সেই বাদী বাবুল হোসেন নিজেই একজন চিহ্নিত চাঁদাবাজ ও ভূমিদস্যু সন্ত্রাসী।
গত বছরের ২৩ অক্টোবর সেনাবাহিনীর সদস্যরা বাবুল হোসেনকে হাতেনাতে চাঁদা দাবির অভিযোগে তাকে আটতের পর ক্যান্টনমেন্ট থানায় হস্তান্তর করে। আর তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির মামলাও দায়ের করা হয়। উক্ত মামলায় জামিনে বেরিয়ে এসে তিনি উল্টো একটি সাজানো অভিযোগে আরিফুলসহ ১৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। ক্যান্টনমেন্ট থানার ওসি সাজানো মিথ্যা অভিযোগ তদন্ত না করেই মামলা হিসেবে গ্রহণ করেন।
পুলিশ সদরদপ্তরে অভিযোগে বলা হয়েছে, ক্যান্টনমেন্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী দীলিপ কুমার আগারওয়াল ও আসলাম সেরনিয়াবাদের অন্যতম সহযোগি। আর অনলাইন গ্রুপের এমডি আখতারুজ্জামানের কাছ থেকেও অবৈধ সুবিধা নিয়ে মামলার চার্জশিট থেকে নাম বাদ দিয়েছেন।
এ ছাড়া, ইসিবি চত্বরের একটি ফ্ল্যাট নিয়ে চলমান মামলায় আদালতের স্থিতাবস্থা থাকলেও, জনৈক শাকিলকে দখল দিতে সহায়তা করার অভিযোগ করা হয়েছে। আবার ভুক্তভোগী পরিবারকে ভয়ভীতি দেখানো হয় এবং থানার কনস্টেবলের উৎকোচ আদায় করার অভিযোগ করা হয়েছে।
ভুক্তভোগি আরিফুল আলী জানান, পুলিশ যদি দুর্বৃত্তের পক্ষ নেয়, তবে সাধারণ মানুষ কোথায় যাবে? তিনি ওসি’র বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত পূর্বক তার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মিথ্যা মামলা হতে অব্যাহতির দাবি জানান। এ ব্যাপারে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগের চেস্টা করা হলেও তার সাথে কথা বলা সম্ভব হয়নি। ভুক্তভোগী মো. শাহজাদা মিয়া ক্যান্টমেন্ট থানায় মারধোর এবং ওসি কর্তৃক হেনস্তার বিষয়টি আমলে নিয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আইজিপি ও ডিএমপি কমিশনারের প্রতি অনুরোধ করেছেন।
ওসি আলিম ক্যান্টেনমেন্ট থানার দায়িত্বে আসার পর থেকেই বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। তার বিভিন্ন কায়দায় ঘুষ গ্রহনের একাধিক অভিযোগ পাওয়া গেছে। শুধুমাত্র ঘুষ বাণিজ্য করে অল্পদিনেই বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন। তিনি এতোটাই বেপরোয়া যে সিনিয়র কর্মকর্তাদের নির্দেশনাও মানেন না। নিজের থানা এলাকার বাইরের রাজধানী একাধিক এলাকায় ওসি আলিমের ঘুষের চক্র বিস্তৃত। নিজস্ব সিন্ডিকেট করে টাকা রোজগারে মরিয়া হয়ে উঠেছেন।
আওয়ামী লীগ আমলের সুবিধাভোগী ওসি আলিম ৫ আগস্টের পর নিজেকে বৈষম্যর শিকার দাবি করে ডিএমপিতে পোস্টিং নিয়েছেন। বাড়ি বগুড়ায় হওয়া নিজেকে বঞ্চিত দাবি করে আসছেন। সিনিয়র কর্মকর্তাদের নির্দেশনা না মেনে নিজেই নিজের ইচ্ছামাফিক চলছেন। এতে পুলিশের সুনাম ক্ষুন্ন হচ্ছে। ক্যান্টনমেন্ট থানা এলাকায় ওসি আলিমের উপস্থিতির কারণে স্থানীয় সেবাবঞ্চিত হচ্ছেন। সেবাপ্রার্থীরা বেশিরভাগ সময় ওসিকে না পেয়ে ফেরত যান।
এছাড়াও এলাকার সাধারণ মানুষের সাথে ওসির সম্পর্ক ভালোনা। এরআগে, মো. রাকিব হোসেন নামের এক ভুক্তভোগী ডিএমপি কমিশনার বরাবর অভিযোগ করলে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার(এডিসি) মুঈদ মোহাম্মদ রুবেল তদন্ত করেন। তদন্তে ওসি আব্দুল আলিমের বিরুদ্ধে দাখিল করা সব অভিযোগের অধিকাংশ বিষয়ে সত্যতা পাওয়া যায়।
ওসি আলিমের নানাবিধ অপরাধের বিষয়ে ডিএমপি ও পুলিশ সদর দপ্তরের একাধিক অভিযোগ জমা হওয়ার পর পুলিশের পক্ষে গোপন তদন্ত করা হয়েছে। তদন্তে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- কনস্টেবল পদে ভর্তি হলেও ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় আউটসাইড ক্যাডেট এসআই পদে নিয়োগ লাভ করেন।
জন্মস্থান বগুড়া জেলা হওয়ায় তিনি বিগত সরকারের সময় বৈষম্যের শিকার হয়েছেন বলে দাবি করেন। এখন তিনি নিজেকে বিএনপির লোক হিসাবে পরিচয় দিয়ে আসছেন। ক্যান্টনমেন্ট থানার ওসি হওয়ার পর থেকে ক্ষমতার অপব্যবহার করতে শুরু করেন। সন্ধ্যার পর তিনি প্রায়ই ক্যান্টনমেন্ট থানা এলাকার বাইরে থাকেন। আড্ডা দেন গুলশান বাঘা ক্লাবসহ অভিজাত হোটেলে।
ইতঃপূর্বে তিনি গুলশানের ডিপ্লোম্যাটিক সিকিউরিটি বিভাগে রিজার্ভ অফিসার (আরও) ছিলেন। ওই সময় থেকে আব্দুল আলিম একটি বলয় তৈরি করেন। ক্যান্টনমেন্ট থানায় কর্মরত অফিসার ও ফোর্সদের সঙ্গে তার আচরণ পেশাদার নয়।
আপনার মতামত লিখুন :