ন্যাটো শীর্ষ সম্মেলনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কিছুটা দ্বিধা প্রকাশ করেন যে, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ এখনো চলছে। তিনি স্বীকার করেন, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ‘কঠিন প্রতিপক্ষ’, এবং বলেন, ‘আমি ভেবেছিলাম সহজে এর সমাধান হবে, কিন্তু এটা অন্য যেকোনো যুদ্ধের তুলনায় অনেক কঠিন।’
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের দ্রুত যুদ্ধ সমাপ্তির আশায় অনেক ইউক্রেনীয়ও একসময় আশাবাদী ছিল। কিন্তু সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে, এই যুদ্ধ সহজে শেষ হওয়ার নয়। পশ্চিমা সহায়তা সত্ত্বেও যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার শঙ্কা ইউক্রেনের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
অর্থনৈতিক চাপ ও ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা
বর্তমানে পশ্চিমা অর্থসহায়তার উপর নির্ভর করে ইউক্রেনের অর্থনীতি কোনোমতে টিকে আছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভবিষ্যতে এই সহায়তা পর্যাপ্ত নাও হতে পারে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি চুক্তিতে ইউক্রেনের খনিজ সম্পদ উন্নয়নের পরিকল্পনা গৃহীত হয়েছে, তবে সেটি বাস্তবায়ন হতে সময় লাগবে কয়েক বছর।
ট্রাম্পের যুদ্ধ-সমাপ্তির প্রত্যাশা ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত কিছুটা আশাবাদ তৈরি করেছিল। ইউক্রেনের সরকারি বন্ডের দামও তখন উচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল। কিন্তু যখন যুদ্ধ থামার পরিবর্তে আরও বেড়ে যায় এবং ট্রাম্পের মনোযোগ অন্য ইস্যুতে সরে যায়, তখন সেই আশা ভেঙে পড়ে।
প্রেসিডেন্টের কার্যালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, ‘২০২৫ সালের মাঝামাঝি যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনার ভিত্তিতে আমরা পরিকল্পনা করেছিলাম। এখন, চলতি বছরের জন্য কোনো ইতিবাচক অর্থনৈতিক প্রত্যাশা নেই।’ সরকারের মনোযোগ এখন অর্থনৈতিকভাবে টিকে থাকার উপায় খোঁজার দিকে।
বাজেট ঘাটতি ও আন্তর্জাতিক সহায়তা
প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি সম্প্রতি জানিয়েছেন, ইউক্রেনের বার্ষিক বাজেট সহায়তা হিসেবে প্রায় ৪০ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন, যা পশ্চিমা মিত্রদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে দাবি করেছেন। কিন্তু এই সহায়তা আসন্ন বছরে এর অর্ধেকই পূরণ করতে পারবে বলে ধারণা।
অর্থমন্ত্রী সের্হি মার্চেনকো সংসদে বলেন, ইউক্রেনকে ২০২৬ সাল পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে হবে। তিনি সতর্ক করেন, এর ফলে রাজস্ব ঘাটতি মোকাবেলায় সরকারি বাজেট থেকে বড় কাটছাঁট করতে হতে পারে।
স্থানীয় গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, তিনি বলেছেন, “এই পরিসংখ্যানগুলো সত্যিই গুরুতর।”
যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ইউক্রেনকে প্রায় ১৬ বিলিয়ন ডলার দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। কিন্তু এখন সংস্থাটি তাদের পূর্বের অনুমানগুলো নতুন করে পর্যালোচনা করছে। তাদের সাম্প্রতিক বিশ্লেষণে ধরে নেওয়া হয়েছিল, যুদ্ধ চলতি বছরের শেষদিকে শেষ হবে।
কিয়েভ স্কুল অব ইকোনমিক্সের সভাপতি টিমোফি মাইলোভানভ বলেন, “যদি সেই ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়, তাহলে আইএমএফ বড় সমস্যায় পড়বে। মার্কিন সহায়তা এখন আর নিশ্চিত নয়, ইউরোপীয় সহায়তাও সীমিত। খরচ বাড়ছে, অথচ এই সহায়তা দীর্ঘমেয়াদে টিকবে কি না তা নিয়েও সন্দেহ আছে। এই পরিস্থিতিতে কোনো স্থিতিশীলতা নেই।”
ইউক্রেনের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক স্থিতিশীলতা বিভাগের সাবেক প্রধান ভিটালি ভাভ্রিশচুক বলেন, “সরকার খুব একটা খরচ কমাতেও পারছে না। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে কাটছাঁটের সুযোগ নেই। ২০২৫ সালে ন্যূনতম মজুরি বাড়ানো হয়নি, সরকারি চাকরিজীবীদের আয়ও খুব সামান্য বেড়েছে।”
তিনি আরও বলেন, ‘এই বছর এবং আগামী বছরে ইউক্রেনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৩ শতাংশেরও নিচে থাকবে, যা বেশ দুর্বল। সবকিছু একত্রে বিবেচনা করলে, চিত্রটা মোটেও আশাব্যঞ্জক নয়।’
বিনিয়োগে অনীহা
যুদ্ধের অনিশ্চয়তার কারণে ইউক্রেনে বেসরকারি বিনিয়োগ কমে গেছে। অনেক উদ্যোক্তা ব্যবসা চালিয়ে যেতে ইউক্রেনেই আছেন, তবে তারা মূলত রক্ষণাত্মক কৌশল নিচ্ছেন। এক ইউক্রেনীয় ব্যবসায়ী জানান, ‘আমরা কেবল টিকে থাকার জন্য বিনিয়োগ করছি। বৃহৎ বিনিয়োগ পরিকল্পনা কেবল ইউক্রেনের বাইরেই রাখছি।’
সামান্য আশার আলো
যদিও সামগ্রিক পরিস্থিতি উদ্বেগজনক, কিছু খাত যেমন ব্যাংকিং, নবায়নযোগ্য জ্বালানি এবং সামরিক উৎপাদন ভালো করছে। ইউক্রেন ইতোমধ্যেই প্রতিরক্ষা খাতে দেশীয় ও বিদেশি উৎস থেকে প্রায় ৪৩ বিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করেছে এবং ইউরোপে অস্ত্র উৎপাদন লাইন স্থাপনের চেষ্টা করছে।
যুক্তরাষ্ট্র-ইউক্রেন খনিজ চুক্তি
মে মাসে ইউক্রেন ও যুক্তরাষ্ট্র একটি গুরুত্বপূর্ণ খনিজ চুক্তিতে পৌঁছায়। এটি ইউক্রেনের জন্য বড় সুযোগ বলেও মনে করা হচ্ছে। যদিও বিরোধীরা আশঙ্কা করছেন, চুক্তির আরও দুটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ প্রকাশ হয়নি, যেখানে হয়তো ইউক্রেনের জন্য দীর্ঘমেয়াদি বাধ্যবাধকতা লুকিয়ে থাকতে পারে।
জাতীয় ব্যাংকের প্রাক্তন কর্মকর্তা ভিটালি ভাভ্রিশচুক বলেন, ‘এখনো সবকিছু পরিবর্তনের সম্ভাবনা রয়েছে। ইউক্রেন সরকার কীভাবে পরিস্থিতি সামাল দেয়, সেটাই নির্ধারণ করবে ভবিষ্যৎ।’
সামগ্রিকভাবে, ইউক্রেনের অর্থনীতি এখন একটি সংকটময় পথে হাঁটছে। যুদ্ধের সমাপ্তি অনিশ্চিত এবং আন্তর্জাতিক সহায়তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল—এমন বাস্তবতায় কিয়েভ অর্থনৈতিকভাবে টিকে থাকার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।
আপনার মতামত লিখুন :