ইরান-ইসরায়েল সংঘাত এখন শুধু মধ্যপ্রাচ্যের সংকট নয় বরং ভারতের জন্যও এক বড় কূটনৈতিক ও কৌশলগত দুঃস্বপ্ন হয়ে উঠছে। চাবাহার বন্দরের উন্নয়ন, নর্থ-সাউথ ট্রান্সপোর্ট করিডোরের (আইএনএসটিসি) করিডোর গঠন ও ইরানের সঙ্গে শক্তিশালী জ্বালানি অংশীদারিত্ব সব মিলিয়ে ইরান ভারতের পশ্চিমমুখী ভূরাজনৈতিক কৌশলের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সংঘাত এই স্বপ্নে অন্ধকারের ছায়া ফেলেছে।
স্বপ্নের ‘চাবাহার’ এখন অনিশ্চয়তায়
চাবাহার বন্দর ভারতের জন্য কেবল একটি বন্দর নয়, বরং এটি পাকিস্তানকে পাশ কাটিয়ে আফগানিস্তান, মধ্য এশিয়া ও রাশিয়ার সঙ্গে বিকল্প সংযোগ তৈরি করার কৌশলগত সেতু।
চাবাহার বন্দরের শহিদ বেহেস্তি টার্মিনালের উন্নয়নে ভারত প্রায় ৮৫ মিলিয়ন ডলার অর্থাৎ প্রায় ৭৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। এই টার্মিনালের জন্য ভারত ক্রেন ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহ করেছে।
এই বন্দরের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে চাবাহার-জাহেদান রেললাইন, যার মাধ্যমে ভারী পণ্য পরিবহণ সহজতর হবে। ভারত ও ইরানের যৌথ এই রেল প্রকল্প প্রায় ৭০০ কিমি দীর্ঘ। একইসঙ্গে এটি আন্তর্জাতিক নর্থ-সাউথ ট্রান্সপোর্ট করিডোরের (আইএনএসটিসি) গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, যা ভারতকে রাশিয়া ও ইউরোপে পণ্য পাঠানোর এক সাশ্রয়ী ও দ্রুত গতির পথ দেবে।
আইএনএসটিসি হলো একটি ৭ হাজার ২০০ কিলোমিটার দীর্ঘ মাল্টিমোডাল ট্রান্সপোর্ট করিডোর, যার মাধ্যমে ভারত, ইরান, আফগানিস্তান, আর্মেনিয়া, আজারবাইজান, রাশিয়া, মধ্য এশিয়া এবং ইউরোপের মধ্যে পণ্য পরিবহণ করা হবে। চাবাহার বন্দর এই করিডোরের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
কিন্তু যুদ্ধের দামামা এই সমস্ত অবকাঠামো নির্মাণে বিলম্ব ঘটাতে পারে, এমনকি থামিয়ে দিতেও পারে। ভারতীয় প্রকৌশলী ও শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। অপারেশন সিন্ধুর মতো উদ্ধার মিশনের প্রয়োজনীয়তা এটাই স্পষ্ট করে যে পরিস্থিতি কতটা অনিশ্চিত।
বাণিজ্য ও জ্বালানিতে হুমকি
ইরানের সঙ্গে ভারতের একটি প্রধান যোগসূত্র ছিল অপরিশোধিত তেল আমদানি। ২০১৯ সালের আগে ইরান থেকে ভারতের মোট অপরিশোধিত তেলের চাহিদার প্রায় ১২ শতাংশ পূরণ হত। তবে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার ফলে ইরান থেকে তেল আমদানি অনেকটা কমে গেছে। তবুও, ভবিষ্যতে এই জ্বালানি সহযোগিতা পুনরায় চালু করার বিষয়ে আলোচনা অব্যাহত রয়েছে।
কিন্তু সংঘাতময় পরিস্থিতি সেই সম্ভাবনাও অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দিয়েছে। অর্থাৎ পারস্য উপসাগর, লোহিত সাগর বা সুয়েজ খালের মতো গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রপথ বিঘ্নিত হতে পারে, ফলে জাহাজ পরিবহণ খরচ ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম যদি ১০০ ডলার প্রতি ব্যারেলের ওপরে চলে যায়, তাহলে ভারতের অর্থনীতি প্রবল চাপে পড়বে।
জ্বালানি ছাড়াও ভারত-ইরান দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য, বিশেষ করে শুকনো ফল, রাসায়নিক ও সিমেন্টের মতো পণ্যে ব্যাঘাত দেখা দেবে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, কেরালা ও মহারাষ্ট্রের একাধিক আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যেই বিকল্প উৎস খোঁজার তৎপরতা শুরু করেছে।
সমুদ্রপথে সংকট
পারস্য উপসাগর, লোহিত সাগর এবং সুয়েজ খালের মতো সমুদ্রপথে যদি সামরিক সংঘাত ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে কেবল চাবাহার নয়, সমগ্র ভারতীয় সামুদ্রিক আমদানি-রপ্তানি ব্যবস্থাই বাধাগ্রস্ত হবে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, জাহাজ পরিবহণের খরচ ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে, ফলে ভারতের অভ্যন্তরীণ বাজারে দ্রব্যের দাম বাড়বে এবং মুদ্রাস্ফীতি আরও তীব্র হতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে ভারতীয় রুপির মান দুর্বল হলে আমদানি আরও ব্যয়বহুল হয়ে উঠবে।
কূটনৈতিক ভারসাম্যের কঠিন পরীক্ষা
ভারত-ইসরায়েল সম্পর্ক নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা এবং প্রযুক্তির স্তরে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। সেই সূত্রে ভারতের জন্য ইসরায়েলের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখাও কঠিন। অপরদিকে, ইরান দীর্ঘদিন ধরে ভারতের জ্বালানি নিরাপত্তা এবং আঞ্চলিক প্রভাব বৃদ্ধির সহযোগী।
এই দুই বিপরীতমুখী অংশীদারের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা ভারতের পররাষ্ট্রনীতির এক বড় কৌশলগত চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে। যদি ভারত একপক্ষকে বেশি গুরুত্ব দেয়, তাহলে অপরপক্ষ ক্ষুব্ধ হয়ে কৌশলগত দরজা বন্ধ করে দিতে পারে।
চাবাহার বন্দর, আইএনএসটিসি করিডোর ও জ্বালানি সহযোগিতা সবই এখন অনিশ্চয়তার কুয়াশায় ঢাকা পড়েছে। কারণ এই সংঘাত আর কেবল ‘ওদের’ নয়—এটি ভারতের ভবিষ্যৎ কৌশলগত স্বপ্নের দিক নির্ধারণ করে দিচ্ছে।




সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন