ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দলীয় শৃঙ্খলা বজায় রাখতে আরও কঠোর হচ্ছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি। সম্প্রতি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দলের ভাবমূর্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষায় কঠোর অবস্থানে থাকতে শীর্ষ নেতাদের নির্দেশনা দিয়েছেন।
বিএনপির শুলশান অফিসের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র রূপালী বাংলাদেশকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে। সূত্রটি জানায়, যত বড় ত্যাগী নেতাই হোন না কেন, অপরাধ করলেই সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তারেক রহমান শীর্ষ নেতাদের জানিয়েছেন, সাংগঠনিক বিশৃঙ্খলা ঠেকাতে দলের শীর্ষ নেতাদের ঐক্যবদ্ধসহ শক্ত অবস্থানে থাকতে হবে। তা ছাড়া ৫ আগস্টের পর সারা দেশে বিএনপির দলীয় সাংগঠনিক বিশৃঙ্খলা অনেকটা ভেঙে পড়েছে। অনেক সময় বিএনপির নেতাকর্মীরা ‘আধিপত্য রক্ষায়’ নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বে জড়াচ্ছেন। এতে ঘটছে খুনোখুনির মতো ঘটনা। এসব কারণে যে কোনোভাবে বিশৃঙ্খলা এড়াতে বিএনপির শীর্ষ নেতাদের কঠোর হতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
বিএনপির পল্টন অফিসের একটি সূত্রে জানা গেছে, গত ৯ মাসে ৫ হাজারের বেশি নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে দলীয় বিশৃঙ্খলার অপরাধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে দলটি। এদিকে সারা দেশে বিচ্ছিন্নভাবে বেশ কিছু জায়গায় ‘মব’ সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে।
বিএনপি সাংগঠনিকভাবে এসবের বিরুদ্ধে থাকলেও তৃণমূল নেতারা মবের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে, যার কারণে দেশব্যাপী সমালোচনার শিকার হচ্ছে দল। নেতাদের দাবি, সরাসরি এসবের বিরুদ্ধে কাজ করছে বিএনপি। দলটি জানিয়েছে, যত বড় ত্যাগী নেতাই হোন না কেন, বিএনপির নাম ব্যবহার করে কেউ অপরাধ করলে দল তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেত বাধ্য হবে।
‘আধিপত্য রক্ষায়’ অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে বিএনপি: এদিকে গত মঙ্গলবার ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) নগর ভবনে বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেন সমর্থিত শ্রমিক দলের দুই গ্রুপের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এ সময় ধাওয়া ও পাল্টা ধাওয়া এবং সংবাদ সংগ্রহের সময় এক সাংবাদিককে ছুরি দেখিয়ে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, জাতীয়তাবাদী শ্রমিক ইউনিয়নের এক পক্ষের সাধারণ সম্পাদক আরিফুজ্জামান প্রিন্স দলবল নিয়ে নগর ভবনে ঢোকার সময় শ্রমিক ইউনিয়নের আরেক পক্ষের সভাপতি আরিফ চৌধুরীর অনুসারীদের মধ্যে ধাওয়া ও পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এতে দুই পক্ষের কয়েকজন আহত হয়েছেন। তবে তাদের নাম জানা যায়নি। যদিও এসব বিষয়ে দলটির দপ্তর থেকে বলা হয়েছে, এ ঘটনায় যারা জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত সাপেক্ষে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এদিকে সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলায় অটোস্ট্যান্ড নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে বিএনপির দুই পক্ষের দ্বন্দ্বে কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে দুজন খুন হন। এ ঘটনায় দলীয় বিশৃঙ্খলা ভঙ্গ ও ফৌজদারি অপরাধে যুক্ত থাকায় বিএনপির নয়াপল্টন কার্যালয় থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন এবং অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় বেশ কয়েকজনকে অব্যাহতিসহ সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে বিএনপি।
গত ২৮ মে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিএনপির দুই গ্রুপের সংঘর্ষে কলিম উদ্দিন নামে এক স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা নিহত হন। আহত হন শাখাওয়াত নামে অপর এক যুবদল কর্মী। তাদের ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করা হয়। এ ঘটনায় যারা জড়িত ছিলেন, বিএনপি তাৎক্ষণিকভাবে তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেছেন, দীর্ঘদিনের একজন কর্মীকে তো সহজেই কেউ দল থেকে বহিষ্কার বা তার সদস্যপদ স্থগিত করতে চায় না। যখন একজন নেতা বা কর্মীর বিরুদ্ধে বহিষ্কারাদেশ প্রদান করা হয়, তখন সবকিছু দেখে এবং জেনে-বুঝে যৌক্তিকভাবেই সেটা দেওয়া হয়, যা অন্যদের জন্য একটা সতর্কসংকেত। আশা করি, এতে অন্যরা সাবধান হবেন। আমরা দলের ভাবমর্তি রক্ষায় কঠোর অবস্থানে রয়েছি।
এ বিষয়ে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমদ বলেছেন, বিএনপি কোনো মব সন্ত্রাস পছন্দ করে না। মবের ঘটনায় দলের কেউ জড়িত থাকলে তদন্ত করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তা ছাড়া সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ঠেকাতে বিএনপিকে কঠোর হতে বলেছেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান।
তিনি বলেন, ‘আমরা মব’ কালচারে বিশ্বাস করি না, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য অবিরাম সংগ্রাম করে যাচ্ছি। যদি বিএনপির কোনো নেতাকর্মী যে কোনো অপরাধের ঘটনায় জড়িত থাকে, তদন্ত করে তার বিরুদ্ধে ডিসিপ্লিনারি অ্যাকশন (শৃঙ্খলাবিরোধী ব্যবস্থা) নেওয়া হবে। এটা আমাদের অবস্থান। কোনোভাবেই কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এই কঠোর অবস্থানের কথা জানিয়ে দলীয় নেতাকর্মীদের উদ্দেশে তারেক রহমান বলেছেন, কমিটি গঠন কিংবা আধিপত্য বিস্তারসহ কোনো ধরনের সাংগঠনিক বিশৃঙ্খলাই বরদাশত করা হবে না। যত বড় ত্যাগী নেতাই হোন না কেন, যতই মামলা কিংবা জেল-জুলুমের শিকার হোন না কেন, অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকলে সাংগঠনিক ব্যবস্থার পাশাপাশি প্রয়োজনে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থাও নেওয়া হবে।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, রাজধানী থেকে শুরু করে দেশের সর্বত্রই কঠোর দৃষ্টি রাখছেন তারেক রহমান। রেখেছেন শক্তিশালী মনিটরিং ব্যবস্থাও। তারই অংশ হিসেবে অভিযোগ পাওয়ামাত্রই র্যাপিড অ্যাকশনে যাচ্ছে দলের কেন্দ্রীয় দপ্তর। পাশাপাশি প্রমাণ মিললে করা হচ্ছে বহিষ্কার, না হয় পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে শোকজ লেটার। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য কিংবা জাতীয় নির্বাহী কমিটির নেতা, কেউই এ তালিকা থেকে বাদ যাচ্ছেন না।
এ বিষয়ে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী বলেন, দলের নাম ভাঙিয়ে দখল, চাঁদাবাজি, হুমকি-ধমকি, মানুষের সঙ্গে দুর্ব্যবহার, অনিয়ম-দুর্নীতি থেকে শুরু করে যে কোনো ধরনের অপকর্মের বিষয়ে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। এসব বিষয়ে অত্যন্ত সচেতন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান।
তিনি কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও কথা বলছেন এবং এ বিষয়ে তীক্ষè দৃষ্টি রাখছেন। তা ছাড়া তিনি দেশের যে কোনো প্রান্ত থেকে কোনো অভিযোগ এলেই সেটি আমলে নিয়ে যাচাই-বাছাই করছেন। ন্যূনতম কোনো সংশ্লিষ্টতা পেলেই তার কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হচ্ছে। অপরাধ প্রমাণিত হলে বহিষ্কারাদেশ দেওয়া হচ্ছে। পদ-পদবি স্থগিতও করা হচ্ছে।
রিজভী আহমেদ আরও বলেন, এ ব্যাপারে আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের কঠোর নির্দেশনা রয়েছে। যত বড় নেতাই হোন না কেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেলে কাউকেই ছাড় দেওয়া হচ্ছে না। সাংগঠনিকভাবে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এমনকি আমাদের দলীয় নেতাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থার পাশাপাশি আইনি ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, জনপ্রশাসন, পুলিশ ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে টার্গেট করে বিএনপির নাম ভাঙিয়ে কেউ কেউ ফায়দা লোটার চেষ্টা করছেন। বিশেষ করে প্রশাসন, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে খবরদারি করার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। এমন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত খবরদারি সম্পর্কে সচেতন থাকার জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসহ সবাইকে সচেতন থাকার অনুরোধ করছি। কারণ এসব ব্যক্তি কেউই বিএনপির প্রতিনিধিত্ব করেন না।
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট আবদুস সালাম আজাদ বলেছেন, অনেক জায়গায় সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে, যেটা ৫ আগস্টের আগে ঠিক ছিল। এসব বিবেচনা করে আমাদের বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এ ব্যাপারে কঠোর নির্দেশনা নিতে বলছেন। যে-ই শৃঙ্খলা ভঙের চেষ্টা করবেন, তার বিরুদ্ধেই সাংগঠনিকভাবে ব্যবস্থা নিতে কঠোর হবে দল। এরই মধ্যে অনেকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, তবে দলের বাইরে থেকেও অনেকে ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্য ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে। এদের ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক থাকতে দলের নেতাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
আপনার মতামত লিখুন :