গাজায় যুদ্ধবন্ধে গত মাসের শেষের দিকে (২৯ সেপ্টেম্বর) ২০ দফা শান্তি প্রস্তাব ঘোষণা করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ঘোষণার পরপরই ট্রাম্পের প্রস্তাবে সায় জানায় ইসরায়েল। এ মাসের ৩ অক্টোবর ট্রাম্পের প্রস্তাবে সম্মতি জানায় ফিলিস্তিনি প্রতরোধ সংস্থা হামাসও। হামাসের সম্মতির পরের দিন গাজায় বোমা হামলা বন্ধ করতে ইসরায়েলকে নির্দেশ দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ৬ অক্টোবর মিসরের লোহিত সাগর তীরবর্তী পর্যটন শহর শারম আল শেখ-এ ট্রাম্পের প্রস্তাবের ওপর বৈঠক শুরু হয় ইসরায়েল, হামাস, মিসর, যুক্তরাষ্ট্র ও কাতারের প্রতিনিধিদের মধ্যে।
সেই বৈঠকে দুই দিনেরও বেশি সময় ধরে আলোচনা চলার পর ট্রাম্পের চুক্তির প্রাথমিক পর্যায় বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়ে স্বাক্ষর করল ইসরায়েল-হামাস। চুক্তিতে হামাসের হাতে বন্দি ২০ জীবিত বন্দির পাশাপাশি ২৮ জিম্মির মরদেহ ফেরত দেওয়ার কথা রয়েছে। বিপরীতে ইসরায়েলি কারাগারে বন্দি থাকা ২ হাজার ফিলিস্তিনিকে মুক্তি দেবে ইসরায়েল। এর মধ্যে ২৫০ জন যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত এবং ১ হাজার ৭০০ জনকে যুদ্ধ শুরুর পর আটক করা হয়।
চুক্তির আওতায় ফাতাহ নেতা মারওয়ান বারগুতিকে মুক্তির কথা থাকলেও শেষ মুহূর্তে এসে ফিলিস্তিনের অবিসংবাদিত এ নেতাকে মুক্তি দিতে অস্বীকৃতি জানায় ইসরায়েল, হামাসের দেওয়া বন্দিমুক্তির তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয় তার নাম। অথচ চুক্তিতে মধ্যস্থতাকারী যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি দেশটির মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক দূত স্টিভ উইটকিফ স্বাক্ষরিত বন্দিমুক্তির তালিকায় তার নাম ছিল বলে জানায় বারগুতির পরিবার।
কে এই মারওয়ান বারগুতি
মারওয়ান বারগুতি, যুদ্ধবিধ্বস্ত ফিলিস্তিনের অন্যতম জনপ্রিয় ও সিনিয়র নেতা। ফিলিস্তিনিদের কাছে তিনি ‘নেলসন ম্যান্ডেলা’ নামেই বেশি পরিচিত। ২০০২ সালের এপ্রিল মাসে ইসরায়েলি সেনাদের হাতে আটক হন তিনি। সেই থেকে আজ পর্যন্ত টানা ২৪ বছর তিনি কারাগারের লোহার শেকলেই বাঁধা।
১৯৫৯ সালের ৬ জুন রামাল্লার কোবার গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন বারগুতি। সে বছরই প্রতিষ্ঠিত হয় ফিলিস্তিনি জাতীয়তাবাদী এবং সামাজিক গণতান্ত্রিক দল ফাতাহ। ১৯৭৪ সালে ১৫ বছর বয়সে ফাতাহে যোগ দেন বারগুতি। এক সশস্ত্র সংগঠনের সদস্য হওয়ার দায়ে ১৯৭৮ সালে প্রথমবার কারাগারে যান। টানা চার বছর কারাভোগের সময় তিনি ইংরেজি ও হিব্রু শেখেন। পড়াশোনা অনেকটা এগিয়ে নেন সেখানেই। পরে ১৯৮৩ সালে মুক্তি পেয়ে বিরজেইত বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পড়াশোনা শুরু করেন। এ সময় আইনজীবী ফাদওয়া ইব্রাহিমের সঙ্গে পরিচয় হয়, যাকে তিনি ১৯৮৪ সালে বিয়ে করেন।
১৯৮৭ সালে প্রথম ইন্তিফাদায় (ফিলিস্তিনি গণআন্দোলন) নেতৃত্ব দিয়ে ফিলিস্তিনে ও ফাতাহর ভেতরে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। তবে সে বছরই তাকে জর্ডানে নির্বাসিত করা হয়। সাত বছর পর, ১৯৯৪ সালে অসলো চুক্তির মাধ্যমে তিনি ফিরে আসেন। ১৯৯৬ সালে ফিলিস্তিনি আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।
দ্বিতীয় ইন্তিফাদা ও গ্রেপ্তার
২০০০ সালের সেপ্টেম্বরে দ্বিতীয় ইন্তিফাদা শুরু হলে ফাতাহর সশস্ত্র শাখা তানজিমের নেতা হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন বারগুতি। তখন থেকে ইসরায়েলের কাছে ‘ওয়ান্টেড’ হয়ে ওঠেন তিনি।
প্রসঙ্গত, যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাম্প ডেভিডে মধ্যপ্রাচ্য শান্তি সম্মেলন ভেঙে যাওয়ার পর শুরু হয় এই আন্দোলন। ২০০২ সালের জানুয়ারিতে তিনি দ্য ওয়াশিংটন পোস্টে একটি মতামত নিবন্ধ লিখে ফিলিস্তিনি রাজনীতিতে তার শক্ত অবস্থান জানান দেন। এর মাত্র তিন মাস পরেই তাকে খুঁজে বের করে গ্রেপ্তার করা হয়। ২০০৪ সালের মে মাসে তাকে পাঁচটি হত্যার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করা হয় এবং পাঁচটি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন বারগুতি।
ফিলিস্তিনের ম্যান্ডেলা
ইতিহাস ও জীবনী পড়তে ভালোবাসেন বারগুতি। কারাগারে থেকেও তিনি বই পড়েন, যার মধ্যে রয়েছে ব্রিটিশ লেখক অ্যান্থনি স্যাম্পসনের লেখা নেলসন ম্যান্ডেলার জীবনী। কারাগারে থাকাকালীন ২৫৫ পৃষ্ঠার একটি বই লিখেছিলেন তিনি, যা গোপনে তার আইনজীবী ও পরিবারের মাধ্যমে বাইরে পাঠানো হয়। বইটিতে তিনি কারাগারের অভিজ্ঞতা বিস্তারিত তুলে ধরেন। তীব্র নির্যাতনের শিকার হয়েও ভেঙে পড়েননি বারগুতি। নেলসন ম্যান্ডেলা যেমন ২৭ বছর কারাবাসে থেকেও তার নেতৃত্বে অটল ছিলেন, ঠিক তেমনিভাবে অটল আছেন বারগুতিও। দীর্ঘ ২৪ বছর কারাবাসেও তিনি বিচলিত নন, বরং ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার পক্ষে তার অবস্থান আজও অটল।
রাজনৈতিক উত্তরাধিকার
বর্তমান ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের উত্তরসূরি হিসেবে বারগুতিকে অনেকেই সম্ভাব্য নেতা মনে করেন। ২০২৩ সালে ফিলিস্তিনি সেন্টার ফর পলিসি অ্যান্ড সার্ভে রিসার্চের এক জরিপে দেখা গেছে, নির্বাচনে দাঁড়ালে মাহমুদ আব্বাসকে সহজেই পরাজিত করতে পারেন বারগুতি। জরিপে প্রায় অর্ধেক মানুষ বারগুতিকে ভোট দিতে আগ্রহী বলে জানায়। আজও বারগুতি কারাগারে বন্দি। কিন্তু তার জনপ্রিয়তা তাকে করে তুলেছে ফিলিস্তিনি সংগ্রামের জীবন্ত কিংবদন্তি।
কিছু বিশ্লেষক ও চলচ্চিত্র নির্মাতারা মনে করেন, বারগুতির মুক্তি ফিলিস্তিনি জনগণের জন্য আশা এবং গাজা ও পশ্চিম তীরের দীর্ঘস্থায়ী সংঘাত সমাধানের সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে। মার্কিন সংগীতশিল্পী সোফিয়া স্কট বলেছেন, ‘আমি মনে করি, বারগুতি কোনো হুমকি নন বরং তিনি ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনি জনগণের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সংযোগ স্থাপন করতে পারেন।’
ফিলিস্তিনি প্রিজনার্স সোসাইটির প্রধান রায়েদ এমার বলেছেন, ‘বারগুতি ফিলিস্তিনি জনগণের মধ্যে শান্তি ও স্বাধীনতার চেতনাকে জীবন্ত রাখেন। তার মুক্তি ফিলিস্তিনের রাজপথে ব্যাপক প্রভাব ফেলবে।’
ইসরায়েলের সংবাদপত্র হারেৎজের সাংবাদিক গিদেওন লেভি বলেছেন, ‘বারগুতি হত্যা করার জন্য জন্ম নেননি। তিনি হিংস্র নন। কিন্তু ইসরায়েল তাকে এবং পুরো ফিলিস্তিনি জনগণকে চাপ প্রয়োগ করছে।’
২০১৬ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার আর্চবিশপ ও ১৯৮৪ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কারজয়ী দেশমন্ড টুটু বারগুতিকে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনীত করেন।
মারওয়ান বারগুতি কে? কেনই বা তিনি গুরুত্বপূর্ণ?
বহুধা বিভক্ত ফিলিস্তিনে বারগুতি একজন মধ্যপন্থী নেতা। ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদী কিংবা ইসলামপন্থি দু’দলের সঙ্গেই তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। তাদের অনেকের সঙ্গেই তার বন্ধুত্বের সূত্রপাত কারাগারে। পশ্চিমাদের সঙ্গে বন্ধুত্বে নাখোশ হামাসও বারগুতির মুক্তি চায়। এ কথা বলার কারণ, পশ্চিমাদের মধ্যেও বারগুতির বন্ধু আছেন।
ইয়াসির আরফাত ও মাহমুদ আব্বাস যখন লেবানন ও তিউনিসিয়ায় নির্বাসিত হন, তখন জনসমক্ষে আসেন বারগুতি। পশ্চিম তীরের প্রথম ‘ইন্তিফাদা’য় বারগুতি আবির্ভূত হলেন অন্যতম নেতা হিসেবে।
বারগুতিকে হত্যার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল
দ্য টাইমস বারগুতিকে তরুণ, আকর্ষণীয় নেতা হিসেবে উল্লেখ করেছিল। আরও বলেছিল, বারগুতিই আরাফাতের উত্তরসূরি। তবে আরাফাত ও তার সঙ্গীদের সঙ্গে বারগুতির একটি সুস্পষ্ট পার্থক্যও ছিল। আরাফাত দেশান্তরি হয়েছিলেন, সেখান থেকে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন।
অন্যদিকে বারগুতি পশ্চিম তীর ও গাজাতেই বেড়ে উঠেছেন। নিজেকে তিনি ফিলিস্তিনি রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো এক তরুণ বলে পরিচয় দিতেন। অধিকৃত এলাকায় জন্ম ও বেড়ে ওঠার বেদনা তিনি ভালোভাবে জানতেন। সর্বত্র দেখা যেত তাকে। শেষকৃত্য, শোকসভা থেকে শুরু করে প্রতিবাদ মিছিল পর্যন্ত সর্বত্র।
আবার ইসরায়েল সম্পর্কেও মারওয়ান বারগুতির ভালো ধারণা আছে। ইসরায়েলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের যে চর্চা, নানা বিষয়ে আলোচনা ও তর্কবিতর্কের সুযোগ, সেটি পছন্দ ছিল বারগুতির। তিনি ও তার মতো নবীন রাজনীতিকেরা সে সময় তাদের সরকারের ভেতরেও এই প্রথা চালুর পক্ষে ছিলেন।
একপর্যায়ে ইয়াসির আরাফাতের সঙ্গেও অপেক্ষাকৃত নবীন রাজনীতিকেরা দ্বন্দ্বে জড়িয়েছিলেন। একটি অধিবেশনে নবীন রাজনীতিকেরা আরাফাতের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। আরাফাত তখন হামাস ও ইসলামিক জিহাদ আন্দোলনের কয়েক শ নেতাকর্মীকে বোমা ছোড়ার অভিযোগে আটক করার নির্দেশ দেন।
নবীন রাজনীতিক মারওয়ান বারগুতি গ্রেপ্তারকৃতদের নাম প্রকাশে চাপ দেন। আরাফাত এমন দাবি-দফার মুখে আগে কখনো পড়েননি। সংগঠনের নেতাকর্মীদের তার প্রতি ছিল অগাধ আস্থা। অসলো চুক্তির পর বোমা হামলাকারীদের গ্রেপ্তারে যেখানে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র সন্তোষ প্রকাশ করেছে, সেখানে নবীন রাজনীতিকেরা চ্যালেঞ্জ করে বসবেন এ ছিল অকল্পনীয়।
অসলো শান্তিচুক্তির পর নতুন আশা ও স্বপ্ন দেখেছিলেন ফিলিস্তিনিরা। যদিও কোথাও কোথাও তখনো আত্মঘাতী বোমা হামলার মতো ঘটনা ঘটেছে। ইসরায়েলিদের মধ্যেও বড় অংশই এই চুক্তির বিরোধী ছিলেন।
তবে ২০০০ সালের গ্রীষ্মে ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি ভেস্তে যাওয়ার পর বারগুতি হতোদ্যম হয়ে পড়েন। তিনি ক্ষোভ-বিক্ষোভের পাশাপাশি নতুন ধরনের সশস্ত্র সংগ্রামপূর্ণ দ্বিতীয় ইন্তিফাদার সম্ভাবনা দেখছিলেন। ওই বছর সেপ্টেম্বরে ইসরায়েলের বিরোধীদলীয় নেতা অ্যারিয়েল শ্যারন জেরুজালেমের হারাম আল শরিফে প্রবেশ করেন, যেখানে আল আকসা মসজিদের অবস্থান। ফিলিস্তিনিরা এতে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।
বারগুতিও এবার অসলো শান্তিচুক্তি প্রত্যাখ্যান করলেন। ২০০০ সালে তিনি দ্বিতীয় ইন্তিফাদার নেতৃত্ব দেন। তিনি অধিকৃত পশ্চিম তীর ও গাজা থেকে ইসরায়েলিদের বল প্রয়োগ করে বের করে দেওয়ার পক্ষে অবস্থান নেন। অনলবর্ষী বক্তৃতায় উদ্বুদ্ধ করেন ফিলিস্তিনিদের। তবে তিনি ইসরায়েলের ভেতর বেসামরিক নাগরিকদের ওপর হামলার ঘোর বিরোধী ছিলেন। বারগুতি অভিযোগ করেন, ইসরায়েল বরাবর শান্তির চেয়ে জমিকে এগিয়ে রেখেছে। শান্তিচুক্তি ব্যর্থ হওয়ার জন্য দায়ী তারাই।
দ্বিতীয় ইন্তিফাদার সময় ফাতাহর অন্যতম নেতা ও দলটির সশস্ত্র শাখা তানজিমের প্রধান হিসেবে বারগুতি ইসরায়েলি ফাঁড়ি অভিমুখে মিছিল-সমাবেশ শুরু করেন। পাল্টাপাল্টি আক্রমণ চলতে থাকে। একই সময়ে ফাতাহ ও তানজিমের পাশাপাশি আরও বেশ কিছু সশস্ত্র গোষ্ঠীর উত্থান ঘটে। এর মধ্যে অন্যতম ছিল আল আকসা মার্টার্স ব্রিগেড। ব্রিগেড ইসরায়েলি সেনা ও বসতি স্থাপনকারী ছাড়াও ইসরায়েলে বেসামরিক নাগরিকদের নিশানা করে আত্মঘাতী বোমা হামলা চালায়।
ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ বারগুতির বিরুদ্ধে এই ব্রিগেড প্রতিষ্ঠার অভিযোগ তোলে। তিনি এই অভিযোগ অস্বীকার করলেও ব্রিগেডের কর্মকাণ্ডের ভূয়সী প্রশংসা করেন। ২০০১ সালে বারগুতিকে নিশানা করে ইসরায়েলিরা মিসাইল ছোড়ে। একটুর জন্য তিনি বেঁচে যান, মিসাইল গিয়ে পড়ে তাঁর দেহরক্ষীর গাড়ির ওপর। এরপরই এক বিবৃতিতে ব্রিগেড জানায় বারগুতি তাদের নেতা।
ওই বছর এপ্রিলে বারগুতিকে রামাল্লা থেকে গ্রেপ্তার করে ইসরায়েলি সেনারা। পরবর্তী আগস্টে তাকে ইসরায়েলি আদালতে প্রথমবারের মতো তোলা হয়। ‘সন্ত্রাসী’ সংগঠনের হামলায় ২৬ জন নিহত হওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত হন তিনি। বিচার চলাকালীন বারগুতি ইসরায়েলি আদালতের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তার আইনজীবীদের যুক্তি ছিল বারগুতি কেবল একজন রাজনৈতিক নেতা। তিনিই বরং ফিলিস্তিনকে দখলে নেওয়ার দায়ে ইসরায়েলকে কাঠগড়ায় নিতে চান।
দ্বিতীয় ইন্তিফাদার পক্ষে ২০০২ সালে ওয়াশিংটন পোস্টে বারগুতির একটি মতামত প্রকাশিত হয়। সেখানে তিনি লেখেন, ফিলিস্তিনিদের অবশ্যই আত্মরক্ষার অধিকার আছে। তিনি আরও লেখেন, ‘আমি এবং ফাতাহ (যে দলের আমি সদস্য) ইসরায়েলের ভেতরে বেসামরিক জনগণকে নিশানা করে হামলা চালানের বিরোধী। কারণ ইসরায়েল আমাদের ভবিষ্যৎ প্রতিবেশী। কিন্তু সেই সঙ্গে দ্ব্যর্থহীনভাবে আমি বলতে চাই, আত্মরক্ষা, ইসরায়েলি দখলদারি থেকে দেশরক্ষা ও স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করার শতভাগ অধিকার আমার আছে।’
বারগুতির কথা ছিল পরিষ্কার। একাধিক লেখায় তিনি বলেছেন, যদি অবরুদ্ধ অবস্থায় ফিলিস্তিন ইসরায়েলের সঙ্গে সমঝোতা করবে বলে আশা করা হয়, তাহলেও ইসরায়েলের কাছ থেকে আশা করতে হবে যে ফিলিস্তিনিরা দখলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ অব্যাহত রাখবেন। এর মধ্যেই আলোচনা চলবে।
কারাগারে থেকেও সংগঠকের ভূমিকায়
কারাগারে থেকেও বারগুতি ফিলিস্তিনের রাজনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। ২০০৩ সালের জুনে ফিলিস্তিনে বিবাদমান সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে তিনি অস্ত্রবিরতি নিশ্চিত করতে পেরেছিলেন। তবে যুদ্ধবিরতি স্থায়ী হয়নি। দুই মাস পর এক ফিলিস্তিনির আত্মঘাতী বোমা হামলা ও আকাশ থেকে ইসরায়েলি হামলায় হামাসের একজন রাজনৈতিক নেতা নিহত হন।
২০০৬ সালে বারগুতি প্রিজনার্স ডকুমেন্টের খসড়া প্রণয়ন করেন। সবকটি দলের কারাবন্দি নেতারা ১৯৬৭ সালের আগের সীমারেখা অনুসরণে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠন ও শরণার্থী প্রত্যাবাসনের দাবি জানান। ২০০৭ সালে ফিলিস্তিনের জন্য একটি ঐকমত্যের সরকার গঠনে ‘মক্কা চুক্তি’ প্রণয়নেও যুক্ত হন বারগুতি।
এ সময়েই ফাতাহর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন বারগুতি। ইয়ং গার্ডের সাবেক আরও দুই সদস্য গাজার সেই শক্তিশালী মানুষ মোহাম্মদ দাহলান এবং আরাফাতের সাবেক সহযোগী জিবরিল রজবও তার সঙ্গে সদস্যপদ পান। তাদের প্রত্যেকের বয়স এখন পঞ্চাশ ও ষাটের কোটায়। কারাগার থেকে মারওয়ান বারগুতির লেখা কিছু চিঠি বাইরে বেরিয়ে গেছে। সেই চিঠিতে তিনি বলেছেন, ইসরায়েলের সঙ্গে সরাসরি আপস-মীমাংসায় সংকটের সমাধান হবে না।
২০১৫ সালে গার্ডিয়ানে মারওয়ান বারগুতির যে লেখা প্রকাশিত হয়, তাতে তিনি বলেন, মূল সমস্যা ইসরায়েল শান্তি প্রতিষ্ঠায় নয়, দখলে মনোযোগী। দখলকেই তারা এগিয়ে রেখেছে। আপস-মীমাংসার একটা ধুয়া তুলে তারা তাদের ঔপনিবেশিক প্রকল্পকে এগিয়ে নিচ্ছে। বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্র এ কথা জানে। তারপরও তারা না বোঝার ভান ধরে বসে আছে। অতীতের ব্যর্থ উদ্যোগকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে হাজির করছে। বলার চেষ্টা করছে, ওই উদ্যোগ মেনে নিলেই মুক্তি ও শান্তি দুইই মিলবে।
বিপ্লবের সহযোগী স্ত্রী ফাদওয়া বারগুতি
দুই দশক ধরে কারাগারে থেকেও বারগুতি প্রাসঙ্গিকতা হারাননি। এই কৃতিত্বের অনেকটাই দিতে হবে তার স্ত্রী আইনজীবী ও ফিলিস্তিন মুক্তি আন্দোলনের একনিষ্ঠ কর্মী ফাদওয়া বারগুতিকে।
ফাদওয়া ও বারগুতি রামাল্লা শহরের বাইরে কোবার গ্রামে একসঙ্গেই বেড়ে উঠেছেন। ফাদওয়া তার গ্রামে ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়া প্রথম নারী। ১৮ বছর বয়সে তিনি ওমেন্স ইউনিয়ন ফর সোশ্যাল ওয়ার্কের প্রতিষ্ঠাকালীন সর্বকনিষ্ঠ সদস্য হন। এখন এ সংগঠন পরিচালনার দায়িত্বে আছেন। সংগঠনটির কাজ ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ আন্দোলনে নারীদের অধিকতর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।
বারগুতি ১৮ বছর বয়সে যখন ইসরায়েলি কারাগারে ৫ বছরের জন্য জেল খাটতে যান, তখন ফাদওয়ার বয়স ১৪। কয়েক বছর পর ফাদওয়ার কাছে তিনি জেলফেরত এক ফিলিস্তিনিকে দিয়ে খবর পাঠান। তাকে উদ্ধৃত করে ফাদওয়া বলেন, ‘সে এসে বলল, মারওয়ান বারগুতি আমাকে ভালোবাসে। সে চায় আমি যেন তার জন্য অপেক্ষা করি।’
শেষ পর্যন্ত বারগুতি যখন মুক্তি পেলেন, তখন খুবই অদ্ভুত প্রস্তাব নিয়ে এলেন। বললেন, তিনি টাকাপয়সা, ধনদৌলত, বাড়িঘর বোঝেন না। তিনি তার হৃদয় ফিলিস্তিনের মুক্তি আন্দোলনের কাছে সঁপে দিয়েছেন। সেই সঙ্গে এই প্রতিশ্রুতি দিলেন, যখন ফিলিস্তিন মুক্ত হবে, তখন তারা একটি সুন্দর ও স্বাভাবিক জীবন কাটাবেন। কিন্তু ফাদওয়াকে ফিলিস্তিন মুক্ত হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। প্রস্তাবটি ভেবে দেখার জন্য এক সপ্তাহ সময়ও দিলেন।
ফাদওয়া কিন্তু সিদ্ধান্ত নিতে একমুহূর্তও দেরি করেননি। তিনি বলেন, ‘আমার এক সপ্তাহ সময় লাগবে না। ফিলিস্তিন শুধু তোমার না, আমারও, আমাদের সবার। ফিলিস্তিনিদের মুক্তির এই আন্দোলনে আমি আমৃত্যু তোমার পাশে থাকব।’ এই দম্পতি চার সন্তানের মা-বাবা। একটি সন্তান জন্মের সময়ও ফাদওয়া বারগুতিকে কাছে পাননি।
বারগুতির এই দুই দশকের কারাজীবনে বাইরের জগতের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপনের কাজটি চালিয়ে গেছেন ফাদওয়া। তার মারফতেই বারগুতি জানিয়েছেন, তিনি এখন সম্পূর্ণভাবে প্রতিরোধের পক্ষে। ২০১৭ সাল থেকে বিভিন্ন কারাগারে বারগুতি বন্দিদের নিয়ে অনশন করেছেন। এ নিয়ে দ্য নিউইয়র্ক টাইমসে অতিথি কলামে বারগুতি লিখেছেন। সহযাত্রী হিসেবে পাশে পেয়েছেন স্ত্রী ও অগণিত ফিলিস্তিনিকে।
গত আগস্টে ফাদওয়া বারগুতি যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ কূটনীতিক, আরব বিশ্ব ও ইউরোপীয় বেশ কিছু দেশের প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠকে বসেন। বারগুতি যেন প্যালেস্টিনিয়ান অথরিটির প্রধান আব্বাসের পর দায়িত্ব নিতে পারেন, তা নিয়ে তারা আলোচনা করেছেন। এসব বৈঠকে জর্ডান ও মিসরের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, আরব লিগের মহাসচিবেরাও ছিলেন। তবে বৈঠকের ফলাফল সম্পর্কে প্রকাশ্যে কিছু জানানো হয়নি।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন