একবিংশ শতাব্দীতে বিশ্ব রাজনীতির চালচিত্রে বড় পরিবর্তন ঘটেছে। তবে এক জায়গায় প্রভাবের লড়াই আজও আগের মতোই তীব্র।
কার হাতে থাকবে বাণিজ্যপথের নিয়ন্ত্রণ? কে দেখাবে আধিপত্য প্রশান্ত মহাসাগর, ভারত মহাসাগর কিংবা আটলান্টিকে? প্রশ্নগুলোর উত্তর লুকিয়ে আছে বিশ্বের শীর্ষ নৌবাহিনীগুলোর শক্তি, কৌশল ও প্রযুক্তির ভাণ্ডারে।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুরু করে চীন, ভারত থেকে রাশিয়া- সমুদ্রপথে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার দৌড়ে কে কতটা এগিয়ে, তা এখন শুধু প্রতিরক্ষার নয়, বরং বৈশ্বিক ক্ষমতার প্রশ্ন।
এই প্রবন্ধে বিশ্বজুড়ে সবচেয়ে ক্ষমতাধর নৌবাহিনীগুলোর সক্ষমতা, কৌশলগত লক্ষ্য এবং আধুনিক ভূমিকা তুলে ধরা হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনী: বিশ্বব্যাপী অপ্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি
যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনী বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী ও প্রযুক্তিনির্ভর বাহিনী। এদের রয়েছে ১১টি পারমাণবিক শক্তিচালিত বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ, দুই শতাধিক জাহাজ ও বিশ্বজুড়ে স্থাপনকৃত ঘাঁটি।
মূল শক্তি: বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ, পারমাণবিক সাবমেরিন, বৈশ্বিক উপস্থিতি
মূল ভূমিকা: দ্রুত প্রতিক্রিয়া, প্রতিরোধ এবং সমুদ্রপথে কর্তৃত্ব
বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য রুট রক্ষা ও আন্তর্জাতিক সংকটে প্রতিক্রিয়ার ক্ষেত্রে এ বাহিনী এক নম্বরে রয়েছে।

চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মি নৌবাহিনী: দ্রুত বর্ধনশীল শক্তি
চীনের নৌবাহিনী জাহাজের সংখ্যায় বর্তমানে বিশ্বের বৃহত্তম। আধুনিক যুদ্ধজাহাজ, ডেস্ট্রয়ার ও নতুন বিমানবাহী জাহাজ নির্মাণের মাধ্যমে চীন তাদের সামুদ্রিক প্রভাব বাড়াচ্ছে।
মূল শক্তি: বিশাল জাহাজ বহর, আধুনিকায়ন, আঞ্চলিক উপস্থিতি
মূল লক্ষ্য: দক্ষিণ চীন সাগরে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা ও বৃহত্তর সামুদ্রিক প্রভাব বিস্তার
চীনের লক্ষ্য বিশ্বমঞ্চে একটি সামরিক পরাশক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা।

রাশিয়ার নৌবাহিনী: পারমাণবিক ও কৌশলগতভাবে শক্তিশালী
রাশিয়ার পৃষ্ঠতলের বহর কিছুটা পুরাতন হলেও, তাদের সাবমেরিন বাহিনী অত্যন্ত শক্তিশালী। এই বাহিনীতে পারমাণবিক সাবমেরিনসহ দীর্ঘপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রবাহী জাহাজ রয়েছে।
মূল শক্তি: সাবমেরিন, পারমাণবিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা, আঞ্চলিক কর্তৃত্ব
মূল ভূমিকা: কৌশলগত প্রতিরোধ, আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তার ও উত্তর মেরু অঞ্চলে উপস্থিতি
রাশিয়া সামরিক কৌশলে সমান্তরাল ও পারমাণবিক প্রতিরোধ ক্ষমতার ওপর জোর দিচ্ছে।
যুক্তরাজ্যের রয়্যাল নৌবাহিনী: চতুর ও বৈশ্বিক উপস্থিতি
যুক্তরাজ্যের নৌবাহিনী নতুন দুটি বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজসহ বিশ্বজুড়ে নিজেদের সামুদ্রিক উপস্থিতি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছে। এছাড়াও এদের আছে আধুনিক সাবমেরিন ও রণতরী।
মূল শক্তি: বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ, পরমাণু সাবমেরিন
মূল ভূমিকা: আন্তর্জাতিক জোটে অংশগ্রহণ, দ্রুত মোতায়েন ও বৈশ্বিক অভিযান
নৌ-সামরিক জোটে যুক্তরাজ্যের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

ভারতের নৌবাহিনী: উন্নয়নশীল গভীর সমুদ্রশক্তি
ভারত সামুদ্রিক নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার লক্ষ্যে নৌবাহিনীকে আধুনিক করে তুলছে। পারমাণবিক সাবমেরিন, বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজসহ নতুন নৌযানের মাধ্যমে এদের শক্তি দিন দিন বাড়ছে।
মূল শক্তি: বিমানবাহী জাহাজ, পারমাণবিক সাবমেরিন, ক্ষেপণাস্ত্রবাহী জাহাজ
মূল লক্ষ্য: ভারত মহাসাগর অঞ্চলে কর্তৃত্ব ও চীনের প্রভাব প্রতিহত করা
ভারত একটি পূর্ণাঙ্গ গভীর সমুদ্র সক্ষমতাসম্পন্ন বাহিনী গড়ে তুলতে চাচ্ছে।

ফ্রান্সের নৌবাহিনী: কৌশলগত ও প্রযুক্তিনির্ভর বাহিনী
ফ্রান্সের নৌবাহিনী বিশ্বজুড়ে উপস্থিতি বজায় রাখে। এদের আছে পারমাণবিক শক্তিচালিত বিমানবাহী জাহাজ ও সাবমেরিন বহর।
মূল শক্তি: পারমাণবিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা, বহুমুখী জাহাজ
মূল ভূমিকা: বৈশ্বিক নিরাপত্তা ও সামরিক জোটে অবদান
ফ্রান্স ইউরোপ ও আন্তর্জাতিক নৌ অভিযানগুলোতে অত্যন্ত সক্রিয়।
জাপানের নৌ আত্মরক্ষা বাহিনী: প্রযুক্তিনির্ভর ও প্রতিরক্ষামূলক
জাপানের সংবিধান অনুযায়ী আক্রমণাত্মক অভিযান সীমিত হলেও, তাদের নৌবাহিনী প্রযুক্তির দিক থেকে অত্যন্ত আধুনিক ও দক্ষ।
মূল শক্তি: আধুনিক ডেস্ট্রয়ার, সাবমেরিন, হেলিকপ্টারবাহী জাহাজ
মূল ভূমিকা: আত্মরক্ষা, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা, মিত্র দেশগুলোর সহায়তা
জাপান নিজের নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী করতে কৌশলগত পরিবর্তন করছে।

অতিরিক্ত উল্লেখযোগ্য কিছু নৌবাহিনীসমূহ
# দক্ষিণ কোরিয়া: অত্যাধুনিক জাহাজ ও সাবমেরিন, ভবিষ্যতে গভীর সমুদ্রে সক্ষমতা অর্জনের লক্ষ্য
# ইতালি ও জার্মানি: আধুনিক ও পরিশীলিত বহর, মূলত ভূমধ্যসাগরকেন্দ্রিক
# তুরস্ক: দ্রুত আধুনিকায়ন ও পূর্ব ভূমধ্যসাগরে সক্রিয় ভূমিকা

বিশ্বজুড়ে নৌবাহিনীর পরিবর্তনশীল ধারা
# ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরে গুরুত্ব বৃদ্ধি: সমুদ্রপথে আধিপত্য নিয়ে প্রতিযোগিতা বাড়ছে।
# সাবমেরিন যুদ্ধ: গোপনতা ও কৌশলগত প্রতিরোধে সাবমেরিন অপরিহার্য হয়ে উঠছে।
# মানববিহীন জলযান: নতুন প্রযুক্তিতে চালিত ড্রোন জাহাজ ও স্বয়ংক্রিয় সাবমেরিন ব্যবহারে জোর।
# নৌ কূটনীতি: মানবিক সহায়তা, যৌথ মহড়া ও মুক্ত সমুদ্রপথ রক্ষায় নতুন কৌশল

নৌশক্তি একটি জাতির সামরিক শক্তি ও বৈশ্বিক প্রভাবের অন্যতম প্রধান উপাদান। যুক্তরাষ্ট্রের সর্ববৃহৎ বাহিনী থেকে শুরু করে চীনের দ্রুত বর্ধনশীল ক্ষমতা, রাশিয়ার সাবমেরিন-কেন্দ্রিক কৌশল, কিংবা ভারতের উদীয়মান অবস্থান- সবই প্রমাণ করে যে, সমুদ্রপথে প্রভাব প্রতিষ্ঠা এখনো বৈশ্বিক রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু।
আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিশ্বের শীর্ষ নৌবাহিনীগুলো ভবিষ্যতের সমুদ্র যুদ্ধের জন্য নিজেদের প্রস্তুত করছে।