বাণিজ্যিক বিমান ভ্রমণ আজ সবার কাছে স্বাভাবিক মনে হলেও এর ইতিহাস খুব বেশি পুরোনো নয়। মাত্র ৭৩ বছর আগে। ১৯৫২ সালের ২ মে বিকেল ৩টায় বিশ্বের প্রথম ভাড়ায় যাত্রীবাহী বিমান আকাশে ওড়ে।
ডি হ্যাভিল্যান্ড ডিএইচ১০৬ ধূমকেতু ১এ মডেলের বিমানটি লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দর থেকে উড্ডয়ন করে জোহানেসবার্গের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। প্রায় ২৩ ঘণ্টায় এবং পাঁচটি স্টপেজ শেষে এটি সাত হাজার মাইল পথ অতিক্রম করে গন্তব্যে পৌঁছায়।
এই উড্ডয়ন বিমান চলাচলের ইতিহাসে এক নতুন যুগের সূচনা করে। প্রপেলারচালিত বিমানের তুলনায় এটি ছিল অনেক দ্রুত ও আরামদায়ক। পিস্টন ইঞ্জিনের অবিরাম শব্দ ও কম্পনের বদলে প্রথমবারের মতো যাত্রীরা মসৃণ জেট ইঞ্জিনের অভিজ্ঞতা পান।
ব্রিটিশ নির্মাতা ডি হ্যাভিল্যান্ড মার্কিন প্রতিদ্বন্দ্বী বোয়িংয়ের আগে এই কৃতিত্ব অর্জন করলেও এর সাফল্য স্থায়ী হয়নি। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই একের পর এক দুর্ঘটনার কারণে ধূমকেতুর পুরো বহরকে স্থগিত করে তদন্তে পাঠানো হয়।

লন্ডনের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত ডি হ্যাভিল্যান্ড বিমান জাদুঘর বর্তমানে এই ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী। দীর্ঘ প্রচেষ্টায় সেখানে একটি মূল ধূমকেতু ১এ মডেলের বিমান সংরক্ষণ করা হয়েছে। ১৯৮৫ সালে কেবল ধাতব কাঠামো হিসেবে পাওয়া ধ্বংসপ্রায় বিমানটি জাদুঘরের স্বেচ্ছাসেবকরা ধাপে ধাপে পুনর্নির্মাণ করেন। বর্তমানে এটি প্রায় আগের রূপে দাঁড়িয়ে আছে, যদিও ডানা যোগ করা হয়নি জায়গার সীমাবদ্ধতার কারণে।
ধূমকেতুর অভ্যন্তরও সতর্কতার সঙ্গে পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে। ১৯৫০-এর দশকের আসল নকশা অনুযায়ী কেবিনে রাখা হয়েছে আরামদায়ক আসন, প্রশস্ত লেগরুম, ধূমপায়ীদের জন্য অ্যাশট্রে এবং বড় আয়তাকার জানালা। সেই সময়ে পুরুষ ও নারীদের জন্য আলাদা বাথরুমের ব্যবস্থা ছিল এবং খাবার পরিবেশন হতো সঠিক প্লেটে ধাতব কাটলারি দিয়ে।
প্রথম শ্রেণির অংশটি আধুনিক প্রাইভেট জেটের মতো বিলাসবহুলভাবে সাজানো হয়েছিল। তবে এটি ছিল অত্যন্ত ব্যয়বহুল। জোহানেসবার্গগামী প্রথম ফ্লাইটের টিকিটের দাম ছিল ১৭৫ পাউন্ড, যা আজকের হিসাবে প্রায় ৪ হাজার ৪০০ পাউন্ডের (বাংলাদেশি মুদ্রায় ৭ লাখ ২২ হাজার ২৫১ টাকা) সমান।

যদিও আরাম ও নকশায় ধূমকেতু যুগান্তকারী ছিল, এর প্রকৌশলগত ত্রুটি বিপর্যয় ডেকে আনে। ১৯৫৩ সালের মার্চে কানাডিয়ান প্যাসিফিক এয়ারলাইন্সের একটি ধূমকেতু উড্ডয়নের সময় বিধ্বস্ত হয়। একই বছরে ভারতে আরেকটি দুর্ঘটনায় ৪৩ জন নিহত হন। ১৯৫৪ সালে মাঝ আকাশে দুটি ধূমকেতু ভেঙে পড়ে ৫৬ জনের প্রাণহানি ঘটায়।
তদন্তে দেখা যায়, উচ্চতায় বারবার চাপ পরিবর্তনের কারণে বিমানের ত্বক ও রিভেটের চারপাশে ফাটল তৈরি হচ্ছিল, যা ফিউজলেজ ভেঙে পড়ার কারণ হয়।

ধূমকেতুর এই ব্যর্থতা থেকেই আধুনিক যাত্রীবাহী জেটের নিরাপত্তা প্রকৌশলে বড় পরিবর্তন আসে। পরবর্তী সংস্করণগুলোতে শক্তিশালী রোলস-রয়েস ইঞ্জিন ও উন্নত ফিউজলেজ ব্যবহৃত হলেও তখন বোয়িং ৭০৭ এবং ডগলাস ডিসি-৮ বাজার দখল করে নেয়। ডি হ্যাভিল্যান্ডের বাণিজ্যিক সাফল্যের যুগ দ্রুতই শেষ হয়ে যায়।
ডি হ্যাভিল্যান্ড মিউজিয়ামে সংরক্ষিত ধূমকেতুটি এখন বিমান ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক। জাদুঘরের পুনর্নির্মিত কেবিনে প্রবেশ করলে মনে হয় যেন ১৯৫২ সালের সেই প্রথম উড্ডয়নের সময়ে ফিরে গেছেন। অবসরপ্রাপ্ত প্রকল্পনেতা এডি ওয়ালশ বলেন, ‘ধূমকেতু তার সমস্যার জন্য বিখ্যাত হলেও এটি আসলে তার সময়ের অসাধারণ উদ্ভাবন। কেউ যদি প্রথম পদক্ষেপ না নিত আজকের বাণিজ্যিক বিমান ভ্রমণ সম্ভব হতো না।’
ধূমকেতুর স্বল্পস্থায়ী যাত্রা প্রমাণ করে, প্রযুক্তির অগ্রগতি প্রায়শই ব্যর্থতা ও ত্যাগের মধ্য দিয়েই আসে। এই জেটই আধুনিক বিমান চলাচলের ভিত্তি গড়ে দেয়, আর তার ইতিহাস আজও স্মরণ করিয়ে দেয় আকাশ জয়ের সেই শুরুর গল্প।
আপনার মতামত লিখুন :