ঢাকা শনিবার, ১০ মে, ২০২৫

হদিস মিলছে না এসপি নাজমুলের

মোস্তাফিজুর রহমান সুমন
প্রকাশিত: মে ৯, ২০২৫, ১০:৪৩ পিএম
রূপালী বাংলাদেশ

আদালতে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা এবং গণমাধ্যমে নানা অপকর্ম ও দুর্নীতির খবর প্রকাশ হওয়ার পর থেকে এসপি (সাবেক এডিসি) নাজমুল ইসলাম সুমনের কোনো হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। গত ২৬ এপ্রিল থেকে কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকায় পুলিশ মোবাইল ফোনেও তার খোঁজ পাচ্ছে না। ঢাকার একটি আদালতে নাজমুলের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পর আত্মগোপনে চলে যান, কর্মস্থল বরিশাল রেঞ্জে যোগদান করেনি। মূলত গ্রেপ্তার এড়াতে আত্মগোপনে থাকা নাজমুল দেশ ছেড়ে পালাতে তৎপর রয়েছে বলে তার ঘনিষ্ঠ সূত্র নিশ্চিত করেছে।

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ ও স্বৈরাচার শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে গত দেড় দশকে যেসব পুলিশ কর্মকর্তা নীতিবহির্ভূত অন্যায়ের সঙ্গে জড়িত ছিল তার মধ্যে নাজমুল ইসলাম অন্যতম। বিরোধী দল বা মত দমনে কঠোর ভূমিকা পালন করা এই পুলিশ কর্মকর্তা অনিয়ম, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি এবং ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিপুল অবৈধ সম্পদের মালিক হয়েছেন।

বরিশাল রেঞ্জের ডিআইজি মো. মঞ্জুর মোর্শেদ আলম রূপালী বাংলাদেশকে জানান, পুলিশ সুপার (এসপি) মো. নাজমুল ইসলাম স্বাস্থ্যগত কারণ দেখিয়ে হোয়াটসঅ্যাপ ও ডাকযোগে চিঠি পাঠিয়ে ছুটি নেওয়ার পর ছুটি শেষ হলেও কর্মস্থলে যোগদান করেননি। কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকায় বাহিনীর নিয়ম অনুযায়ী সদর দপ্তরকে অবহিত করে পত্র দেওয়া হয়েছে। এখন করণীয় ঠিক করবে কর্তৃপক্ষ। ছাত্র-জনতা হত্যা মামলাসহ একাধিক মামলার আসামি এবং গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারীকৃত পুলিশ কর্মকর্তা নাজমুল কীভাবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন জানতে চাইলে মোর্শেদ আলম জানান, এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ নিয়ম অনুযায়ী ব্যবস্থা নিয়ে থাকে। এখানে আমার কিছুই করার নেই।

একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) সাইবার ক্রাইম ইউনিটের সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার (এডিসি) নাজমুল ইসলাম সুমন ক্ষমতার অপব্যবহার করে কোনো সুন্দরী নারীকে বিশেষ করে বিনোদন জগতের তারকাদের পছন্দ হলেই ডেকে পাঠাতেন। পাঁচ তারকা হোটেল বা রিসোর্টে নিয়ে বিশেষ সময় কাটাতেন। এবং অন্যদের কাছেও যেতে বাধ্য করতেন।

নাজমুলের অপর্কমের ডান হাত ছিল মডেল-অভিনয়শিল্পী রাসেল খান। আরও ছিল কণ্ঠশিল্পী অন্তর রহমান। তারা দুজনের বিরুদ্ধে উঠতি মডেল, অভিনয়শিল্পী ও কণ্ঠশিল্পীদের সাপ্লাই দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। নাজমুলের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে সাধারণ পরিবারে জন্ম নেওয়া মডেল রাসেল আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন। প্রায়ই গাড়ির মডেল বদল করেন তিনি। গ্রামে গড়েছেন আলীশান বাড়ি।

সূত্র জানায়, নাজমুলের অপকর্মের সহযোগিতার জন্য ব্যক্তিগত দুটি সাইবার টিম গঠন করা হয়েছিল। তার একটি টিম শোবিজ শিল্পীদের ফেসবুক আইডি হ্যাক করত। পরবর্তী সময়ে নাজমুলের শরণাপন্ন হলে আইডি ঠিক করে দিয়ে ব্যক্তিগত তথ্য নিয়ে ব্যক্তিগত ফায়দা নিত। এসব কাজ হতো মডেল অন্তু করিমের ধানমন্ডি অফিসে। সেখান থেকেই নাজমুলের কাছে আসতেন। স্বৈরাচার ঘরানার পুলিশের পদোন্নতি হলেই মদের পার্টি দিতেন নাজমুল। সেই আয়োজনে থাকত নারীদের আনাগোনা। বিশেষ করে শোবিজের উপস্থিতি থাকত। এসব পার্টিতে দাওয়াত দিয়ে তাদের হাজির করতেন মডেল রাসেল ও কণ্ঠশিল্পী অন্তর রহমান।

এমনই এক চাঞ্চল্যকার তথ্য জানিয়ে দৈনিক রূপালী বাংলাদেশকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ভুক্তভোগী গায়িকা বলেন, ‘একদিন কণ্ঠশিল্পী অন্তর রহমান দাওয়াত দেন। বলেন নাজমুল ভাইয়ের পার্টি। আমিও সরল মনে সেখানে যাই। সেদিন মনির নামে এক পুলিশ সদস্য পদোন্নতি পাওয়ায় পার্টি দেন নাজমুল ভাই। সেখানে গেলে ওই পুলিশের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। সবাই নিজেদের মতো করে আনন্দ করছে। ভেতরে সিগারেটের ধোঁয়ায় থাকতে না পেরে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই। হঠাৎ করে পেছন থেকে একজন এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে এবং আমার বিশেষ স্থানে হাত রাখে, তাৎক্ষণিক নিজেকে সরিয়ে নিই। ঘুরে তাকাতেই দেখি মনির নামে ওই পুলিশ সদস্য। তাকে সরাসরি বলে দিই, এসব আমি পছন্দ করি না। আমার শরীরে হাত দেবেন না। আমি কাউকে কিছু না বলেই সেখান থেকে বেরিয়ে যাই। এরপর আর কখনো এমন অনুষ্ঠানে যাইনি।’ এমন আরও কিছু অভিযোগ জানিয়েছেন একাধিক শোবিজ শিল্পী।

নাজমুল ইসলাম সুমন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) সাইবার ক্রাইম ইউনিটের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ২০২৩ সালের নভেম্বরে সিনিয়রদের ডিঙিয়ে পুলিশ সুপার হিসেবে পদোন্নতি বাগিয়ে নেন। সেখান থেকেই কর্মরত ছিলেন একই স্থানে। ৫ আগস্টের পর ওএসডি করে তাকে বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশে বদলি করা হয়। তবুও বরিশালে যোগদান না করে ডিএমপিতে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছিলেন। গত মার্চে নাজমুল রূপালী বাংলাদেশকে জানিয়েছিলেন, ঊর্ধ্বতনদের অনুমতি নিয়েই ডিএমপিতে দায়িত্ব পালন করছি।

উল্লেখ্য, গত ১২ মার্চ ‘ছাত্রদলের ট্যাগ লাগাতে কোটি টাকার মিশন!’ শিরোনামে রূপালী বাংলাদেশে নাজমুলের অপকর্মের ফিরিস্তি প্রকাশ করা হয়। সে সময় সংবাদ প্রকাশ না করতে নানা মাধ্যমে রূপালী বাংলাদেশের প্রতিবেদককে চাপ সৃষ্টিও করেন। এরপর বরিশালে যোগদান করেই আবার ছুটিতে চলে যান।

এদিকে, হত্যাচেষ্টা, প্রতারণা ও চাঁদাবাজির অভিযোগে দায়ের করা মামলায় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সাবেক উপকমিশনার নাজমুল ইসলাম সুমনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন আদালত। ডিএমপির সাইবার ইউনিটের সাবেক এই অতিরিক্ত উপকমিশনারের বিরুদ্ধে ঢাকা মহানগর প্রথম অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত এই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। পরোয়ানা কার্যকরে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনারকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। নাজমুল ইসলাম সুমনের বিরুদ্ধে মামলাটি দায়ের করেছিলেন অভিনেত্রী মেহের আফরোজ শাওনের মা।

নাজমুলের বিরুদ্ধে বিএনপি-জামায়াতসহ বিরুদ্ধ মত দমনের অভিযোগ রয়েছে। নাজমুল সাইবার ক্রাইমের এডিসি থাকাকালে ক্ষমতার অপব্যবহার করে আওয়ামী সরকারের অনলাইন পাহারাদারের ভূমিকা পালন করতেন। বিশেষ করে তৎকালীন সরকারের বিরুদ্ধে কেউ পোস্ট দিলে কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ায় সমালোচনা করলে, তাকে ধরে এনে মামলা, নির্যাতন এবং ভয়ভীতি দেখিয়ে পোস্ট মুছে ফেলতে বাধ্য করতেন। সাংবাদিকরা সরকারবিরোধী কিংবা নাজমুলের পছন্দের কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে রিপোর্ট করলে, তাকে তুলে নিয়ে হুমকি-ধমকি দিতেন। গণমাধ্যমে কর্মরত একজন সাংবাদিককে গোয়েন্দা কর্মকর্তা নাজমুল ভয়ভীতি ও হুমকি দিচ্ছেন, সেই রেকর্ডও রয়েছে। অকথ্য ভাষায় গালাগালের সেই রেকর্ডটি শুনলে যে কারো গা শিউরে উঠবে।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে নাজমুল ইসলাম সুমনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তার ব্যক্তিগত নাম্বার বন্ধ পাওয়া গেছে। যদিও গত ১১ মার্চ তিনি রূপালী বাংলাদেশকে বলেছিলেন, পেশাগত জীবনে নিয়মের বাইরে কোনো কাজ করিনি।