এহসান-উল-হক শামি। পাকিস্তান শাসিত লিপা উপত্যকার বাসিন্দা। ওই অঞ্চলের জনসংখ্যা প্রায় ৪০ হাজার এবং সেখানকার বেশির ভাগ মানুষই আইন অনুশীলন করেন। নিয়ন্ত্রণরেখা থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত শামির বাড়ি। ভারতীয় ও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মধ্যে ব্যাপক গুলিবিনিময়ে ২০১৯ সালে তার বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
তিনি সংবাদমাধ্যম বিবিসিকে জানিয়েছেন, একইভাবে ২০০২ ও ১৯৯৮ সালে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল তার বাড়ি। পেশায় আইনজীবী শামি বলেছেন, ভারত শাসিত কাশ্মীরের পেহেলগামের ঘটনার পর গতকাল শুক্রবারও পাকিস্তান ও ভারতের সেনাবাহিনীর মধ্যে গুলিবিনিময় হয়েছে। শামি জানিয়েছেন, বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার মধ্যবর্তী রাত সাড়ে ১২টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত দুই সেনাবাহিনীর মধ্যে গুলিবিনিময় চলে।
‘ভয়ে রাতে ঘুম হয়নি।’ বললেন ৫০ বছর বয়সি কালিয়া দেবী। ভারত শাসিত কাশ্মীরের জম্মু শহরের কাছে একটি কলেজে আশ্রয় নেওয়া কালিয়া দেবী। এসব মানুষ বলছেন, এমন আতঙ্কে তারা কখনো পড়েননি। ভারতের দাবি, এখন পর্যন্ত পাকিস্তানের হামলায় তাদের ১৩ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত ও ৫৯ জন আহত হয়েছে।
পাকিস্তানও পাল্টা অভিযোগ করেছে যে, ভারতের বিমান হামলায় তাদের অন্তত ৩১ জন নিহত ও ৫০ জন আহত হয়েছে। ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে উত্তেজনা চরমে পৌঁছেছে। কাশ্মীর সীমান্তে গোলাগুলি ও বিমান হামলার মুখে ভারতের আখনুর অঞ্চলের দুটি গ্রামের শত শত বাসিন্দাকে বৃহস্পতিবারের মতো শুক্রবারও সরিয়ে নেওয়া হয়। খবর রয়টার্স।
ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ পরিস্থিতিতে চরম আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন দুই দেশেরই সীমান্তবর্তী এলাকার বাসিন্দারা। বাধ্য হয়ে ঘরবাড়ি ও গবাদি পশু ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ছুটছেন অনেকে। জীবিকার তাগিদে জীবনের ঝুঁকি নিয়েও নিজ বাড়িতেই থাকছেন অনেকে। হামলার শঙ্কায় কাটছে প্রতিটি মুহূর্ত। যুদ্ধ বন্ধ এবং শান্তি ফেরার প্রত্যাশা তাদের।
শুক্রবারও জম্মু অঞ্চলে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। ভারত শাসিত কাশ্মীরের পুঞ্চ জেলার অসংখ্য মানুষ নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর তীব্র গোলাবর্ষণ থেকে বাঁচতে ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাতে শুরু করেছে। স্থানীয়রা জানান, পাকিস্তানে ভারতের বিমান হামলার পর সীমান্তে গোলাবর্ষণ তীব্র আকার নিয়েছে।
সোবিয়া নামের স্থানীয় এক নারী জানান, ‘আমি বিকট শব্দ শুনে আমার এক মাস বয়সি শিশুকে কোলে নিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে আসি। খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। সুফরিন আখতার নামে আরেকজন জানান, তাদের বাড়ির সামনে একটি গোলা আছড়ে পড়ার পর তিনি ও তার পরিবার বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসে। তিনি বলেন, ‘আমরা গাড়ি পাইনি। নিরাপদ স্থানে পৌঁছাতে মাইলের পর মাইল হাঁটতে হয়েছে। আমি সারা পথ কাঁদছিলাম, অনেক গোলাবর্ষণ হচ্ছিল।’
শুধু সোবিয়া বা সুফরিনই নন, আরও বহু মানুষ গত দুই দিনে পুঞ্চ থেকে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে। ভারতীয় কর্মকর্তারা জানান, পুঞ্চ ছাড়াও কুপওয়ারা, বারামুল্লা, রাজৌরি, মেন্ধার, নওশেরা, সুন্দরবানি, আখনুরসহ গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরগুলোয় বিনা উসকানিতে পাকিস্তান গুলিবর্ষণ করছে; তারা এর জবাব দিচ্ছেন। নতুন করে সংঘাতের কারণে নিয়ন্ত্রণ রেখার কাছাকাছি বসবাসকারী বেসামরিক মানুষ পড়েছে চরম দুর্দশায়। হতাহত হওয়ার পাশাপাশি তাদের সম্পদ ও গবাদি পশুর ক্ষতি হচ্ছে। কারফিউর কারণে কেউ স্কুল, হাসপাতাল ও বাজারে যেতে পারছে না।
আগামী রোববার হিমাচল প্রদেশের ধর্মশালায় ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের (আইপিএল) একটি ম্যাচ হওয়ার কথা ছিল। পাকিস্তানের সঙ্গে উত্তেজনার মধ্যে ভেন্যু পরিবর্তন করা হয়েছে। ভারতের ড্রোনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডি স্টেডিয়াম। সেখানে পাকিস্তান সুপার লিগের (পিএসএল) ম্যাচটি করাচিতে অনুষ্ঠিত হবে। বৃহস্পতিবার ভোরে ইসরায়েলের তৈরি ড্রোন দিয়ে পাকিস্তানে হামলা চালায় ভারত।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর উদ্ধৃতি দিয়ে বিবিসি জানিয়েছে, ‘ইসরায়েলের তৈরি ২৫টি ভারতীয় ড্রোন’ তারা ভূপাতিত করেছে। ড্রোন হামলায় পাকিস্তানের এক বেসামরিক নাগরিক নিহত ও চার সেনাসদস্য আহত হন। পাকিস্তান সেনাবাহিনী এক বিবৃতিতে দাবি করেছে, সফট-কিল ও হার্ড-কিল পদ্ধতিতে ইসরায়েলের তৈরি এসব ‘হেরোপ ড্রোন’ ভূপাতিত করা হয়েছে। এগুলোর ধ্বংসাবশেষ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে সংগ্রহ করা হচ্ছে।
ভারত-পাকিস্তানের ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার মধ্যে আরবসাগরে টহল বাড়িয়ে পাকিস্তানি লক্ষ্যবস্তুর বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছে ভারতের নৌবাহিনী। শুক্রবার (৯ মে) পৃথক দুই প্রতিবেদনে দেশটির নৌবাহিনী সূত্রের বরাত দিয়ে এসব তথ্য জানায় দ্য নিউ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস ও এনডিটিভি। এই সূত্র জানায়, সাম্প্রতিক উত্তেজনার জের ধরে আরবসাগরে নাশকতার পরিকল্পনা করছে পাকিস্তানÑ এমন গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারতের নৌবাহিনী।
পাকিস্তানের সঙ্গে উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে ভারতের সব বন্দর, শিপিং টার্মিনাল ও শিপইয়ার্ডে নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। রয়টার্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সম্প্রতি উত্তপ্ত সীমান্ত পরিস্থিতির বিবেচনায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। গতকাল শুক্রবার আলজাজিরার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যের পেহেলগামে হামলাকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানের সঙ্গে সৃষ্ট উত্তেজনার আবহে আগ্নেয়াস্ত্রের উৎপাদন বাড়িয়ে দিয়েছে ভারতীয় অস্ত্র কোম্পানিগুলো। বৃহস্পতিবার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গ।
ভারতের সমরাস্ত্র উৎপাদনকারী কোম্পানি কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে ব্লুমবার্গের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমান উত্তেজনা পরিস্থিতিতে সব ভারতীয় কোম্পানি তাদের অস্ত্র, গোলাবারুদের উৎপাদন পূর্ব নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৫ শতাংশ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।পাকিস্তানের সঙ্গে উত্তেজনার মধ্যে ভারত তার টেরিটোরিয়াল আর্মি মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এরই মধ্যে টেরিটোরিয়াল আর্মির ৩২টি ইনফ্যান্ট্রি ব্যাটালিয়নের মধ্যে ১৪ সক্রিয়ভাবে মোতায়েন করেছে দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। এই বাহিনী ২০২৮ সাল পর্যন্ত দেশের নানা প্রান্তে কাজ করবে। স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে, ভারতের সক্রিয় সামরিক সদস্য প্রায় ১৪ দশমিক ৭৫ লাখ এবং আধা সামরিক বাহিনীতে আরও ১৬ লাখ সদস্য রয়েছেন। অন্যদিকে পাকিস্তানের সক্রিয় সামরিক সদস্যসংখ্যা ৭ লাখের কম এবং আধা সামরিক বাহিনী প্রায় ২ দশমিক ৯ লাখ।
কূটনীতিকে কাজে লাগিয়ে ভারতের সঙ্গে উত্তেজনা বন্ধ হওয়ার জন্য অপেক্ষা করবে পাকিস্তান। কিন্তু কূটনীতি ব্যর্থ হলে ভারতে পাল্টা হামলা চালানো হবে বলে জানিয়েছেন পাকিস্তানের এক কর্মকর্তা। পারমাণবিক শক্তিধর দুই দেশের উত্তেজনা প্রশমনে যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব এবং অন্যান্য দেশ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
পাকিস্তানি এই কর্মকর্তা মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনকে গতকাল শুক্রবার বলেছেন, ‘পাকিস্তান কূটনীতিকে সুযোগ দিচ্ছে।’ তিনি অভিযোগ করেন, ভারত দাবি করেছিল, পাকিস্তান তাদের ১৫টি শহরে মিসাইল ছুড়েছে, যা সত্যি নয়। এর মাধ্যমে ভারত ‘হাইপ’ তোলার চেষ্টা করছে বলে দাবি তার।
জম্মু-কাশ্মীরের সাম্বা সেক্টরে একটি বড় ধরনের অনুপ্রবেশের চেষ্টা প্রতিহতের দাবি করেছে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)। অভিযানে সাতজন সন্ত্রাসী নিহত হয়েছে এবং পাকিস্তানের একটি সামরিক পোস্ট ধ্বংস করা হয়েছে বলে জানিয়েছে বিএসএফ। পাকিস্তান আটটি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে বলে দাবি করেছে ভারত। এ ছাড়া এফ-সিক্সটিনসহ দুটি যুদ্ধবিমান ভূপাতিতের দাবি করেছে দেশটির গণমাধ্যম। হামলার আশঙ্কায় ১৫ শহরে ব্ল্যাকআউট করা হয়েছে।
তবে হামলার দাবি অস্বীকার করেছে পাকিস্তান। দেশটির পক্ষে জানানো হয়, সীমান্তে ভারতের ৪০ থেকে ৫০ সেনা নিহত হয়েছে। সিএনএন, এনডিটিভিসহ আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো এসব তথ্য জানিয়েছে। ভারতীয় প্রতিরক্ষা সূত্র সিএনএনকে জানিয়েছে, পাকিস্তান থেকে ভারত শাসিত কাশ্মীরের দিকে আটটি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হয়েছে। বিমান প্রতিরক্ষা ইউনিট এগুলোকে বাধা দিয়েছে।
চীনের তৈরি যুদ্ধবিমান ব্যবহার করে গত মঙ্গলবার দিবাগত রাতে ভারতের অন্তত দুটি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে পাকিস্তান। যুক্তরাষ্ট্রের দুজন কর্মকর্তা বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে এ কথা বলেছেন। রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, এ ঘটনা চীনের তৈরি অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমানের কার্যকারিতার একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হয়ে উঠেছে। প্রতিবেদনটির বিষয়ে ভারতের বিমানবাহিনীর এক মুখপাত্রের কাছে মন্তব্য জানতে চেয়েছিল রয়টার্স। জবাবে তিনি বলেছেন, তার কোনো মন্তব্য নেই।
পাকিস্তানের পাঞ্জাবের কয়েকটি জেলায় শুক্রবার আরও ছয়টি ড্রোন গুলি করে নামিয়েছে পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনী। নিরাপত্তা ও মিলিটারি সূত্রের বরাতে দেশটির গণমাধ্যম সামা টিভি জানিয়েছে, এ নিয়ে ভারতের ৭৭টি ড্রোন ধংস করেছে পাকিস্তান, যার মধ্যে রয়েছে ইসরায়েল নির্মিত ছয়টি ড্রোন। পাকিস্তানের সামরিক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বৃহস্পতিবার দেশের বিভিন্ন এলাকায় ভারতের ছয়টি ড্রোন গুলি করে নামানো হয়েছে। শুক্রবার আরও ছয়টি। দেশটির তিনটি শহরে ইসরায়েল নির্মিত ছয়টি ড্রোন ভূপাতিত করা হয়েছে বলে জানিয়েছে জিও নিউজ।
বাণিজ্যিক বিমান সংস্থাগুলোকে পাকিস্তানের আকাশসীমা এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিয়েছে পাকিস্তান সরকার। দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ এ তথ্য জানিয়েছেন। এদিকে, লুফথানসা এয়ারলাইনস এই সপ্তাহের শুরুতে জানিয়েছে, তারা ‘পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত’ পাকিস্তানের আকাশসীমায় বিমান চলাচল স্থগিত রাখছে। সূত্র: ডন নিউজ, পিটিভি, বিবিসি
ভারত সরকারকে ‘সিনেমা’ থেকে ‘বাস্তব’ জগতে ফিরে আসার আহ্বান জানিয়েছে পাকিস্তান। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর মিডিয়া উইং আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) মহাপরিচালক লেফটেন্যান্ট জেনারেল আহমেদ শরিফ চৌধুরী এই আহ্বান জানান।
ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্বে ‘স্বার্থ না থাকায়’ যুক্তরাষ্ট্র হস্তক্ষেপে বিরত থাকবে বলে জানিয়েছেন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স। সামরিক সংঘাত যুদ্ধে রূপ নেওয়ার শঙ্কা প্রকাশ করেছেন তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইপ এরদোয়ান। অন্যদিকে, দুই পক্ষকেই ধৈর্য ধারণের আহ্বান ইরানি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর। এদিকে, পাল্টাপাল্টি গোলাবর্ষণের পর সীমান্তের দুই প্রান্ত এখন থমথমে।
ভারতের জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যের পেহেলগামে সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী হামলা ঘিরে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যে উত্তেজনা শুরু হয়েছে, তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মার্কো রুবিওর সঙ্গে টেলিফোনে বৈঠক করেছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ।