জুলাই অভ্যুত্থানে গণহত্যার দায়ে আওয়ামী লীগের বিচার ও দলটির রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধের সুস্পষ্ট রোডম্যাপের (পথনকশা) দাবিতে যমুনা এলাকা হঠাৎই উত্তাল হয়ে ওঠে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বাসভবনের সামনে গত বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে অবস্থান নেন জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতাকর্মীরা।
গত রাত থেকে গতকাল শুক্রবার সারা দিন স্লোগানে উত্তাল ছিল যুমনা, পল্টন, বায়তুল মোকাররমসহ শাহবাগ এলাকা।
এ সময় অবস্থান কর্মসূচি থেকে সরকারের প্রতি এনসিপির নেতারা নানা হুঁশিয়ারি দেন। আ.লীগ নিষিদ্ধের দাবির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছে জামায়াত, এবি পার্টিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। একই সাথে, আ.লীগ নিষিদ্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত ‘শাহবাগ ব্লকেড’ কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। আ.লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে স্লোগানে স্লোগানে আবারও উত্তাল হয়ে উঠেছে রাজধানীর শাহবাগ মোড়। এদিকে, কর্মসূচি ঘিরে শাহবাগসহ রাজধানীজুড়ে সৃষ্টি হয়েছে যানজট।
আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে এনসিপির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহর নেতৃত্বে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের সামনে অবস্থান কর্মসূচি শুরু হয় গত বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে। কর্মসূচিতে সবাইকে অংশ নিতে আহ্বান জানান জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। মাঝরাত থেকেই উত্তাল হতে থাকে যমুনা এরিয়া। কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া নেতারা নানা হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন।
এনসিপির পাশাপাশি বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীরাও রাতে বিক্ষোভে যোগ দেন। গত বৃহস্পতিবার রাত ১টার পর হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মী যমুনার সামনে যান। রাত দেড়টার দিকে আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির কিছু নেতাকর্মী সেখানে উপস্থিত হন। রাত ২টার দিকে সেখানে যান ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় নেতারা।
রাতভর বিক্ষোভ চলার পর গতকাল শুক্রবার সকালে সেখানে যোগ দেন জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীরা। গতকাল সকাল সাড়ে ৮টার দিকে হাসনাত আবদুল্লাহ ও এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী ঘোষণা দেন, বাদ জুমা যমুনার পূর্ব পাশে ফোয়ারার সামনে বড় জমায়েত করা হবে।
এই ঘোষণা দেওয়ার সময় উপস্থিত ছিলেনÑ জামায়াতে ইসলামীর ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সেক্রেটারি জেনারেল শফিকুল ইসলাম মাসুদসহ ইসলামপন্থি কয়েকটি দলের নেতাকর্মীরা। ঘোষণার পর সেখানে মঞ্চ তৈরির কাজ শুরু হয়। গতকাল দুপুর ১২টার দিকে যমুনার সামনে থেকে সরে ফোয়ারার সামনের মঞ্চের সামনে অবস্থান নেন আন্দোলনকারীরা। জুমার নামাজের পর এই মঞ্চের সামনে বড় জমায়েত হয়।
এনসিপি ছাড়াও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, এবি পার্টি, জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্রশিবির, ইসলামী ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশ, খেলাফত ছাত্র মজলিসসহ বিভিন্ন সংগঠন ও দলের নেতাকর্মীরা এই কর্মসূচিতে যোগ দেন। দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের কয়েকজন সেখানে বক্তব্য দেন। পরে হাসনাত আবদুল্লাহ শাহবাগ অবরোধের ঘোষণা দেন। সমাবেশস্থলে ‘আওয়ামী লীগ নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’, নিষিদ্ধ করতে হবে, আওয়ামী লীগ, আওয়ামী লীগ’ ইত্যাদি বিভিন্ন স্লোগান দিতে দেখা যায়।
এনসিপিসহ বিভিন্ন নেতাদের হুঁশিয়ারি:
কর্মসূচি থেকে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে ‘শাহবাগ ব্লকেড’ কর্মসূচির ঘোষণা দিয়ে (এনসিপি) দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, বাংলাদেশের অগ্রগতি সেদিন থেকে শুরু হবে, যেদিন বাংলাদেশে টাইটেল পাবে, বাংলাদেশ উইদআউট আওয়ামী লীগ। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কানে আমাদের আওয়াজ পৌঁছেনি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে আহতদের আওয়াজ পৌঁছে না, আহতদের আর্তনাদ পৌঁছে না, আমরা এখান থেকে গিয়ে শাহবাগে অবরোধ করব। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি না করা পর্যন্ত আমরা জায়গা ছাড়ব না।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম হুঁশিয়ারি দেন, আমাদের লড়াই মাত্র শুরু হয়েছে। এই কর্মসূচির ব্যাপ্তি এক দিনও হতে পারে, এক মাসও হতে পারে। যতক্ষণ না আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের ঘোষণা আসছে, ততক্ষণ আমাদের রাজপথে থাকতে হবে।’
সমাবেশ থেকে আমার বাংলাদেশ পার্টির (এবি পার্টি) সদস্যসচিব মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সর্বদলীয় সভা ডেকে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে হবে। একই সঙ্গে বিগত বছরগুলোতে যারা গুম-খুন ও অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িত, তাদের উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। তিনি বলেন, আ.লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে আমাদের আবারও রাস্তায় নামতে হয়েছে, যা অত্যন্ত দুঃখজনক। আমরা দুঃখিত যে, আজ আবার রোদের মধ্যে কষ্ট করে ঘাম ঝরিয়ে আমাদের এ দাবি জানাতে হচ্ছে।
মানবতার শত্রু আ.লীগকে দ্রুত নিষিদ্ধের দাবি করে এক বিবৃতিতে হেফাজতে ইসলামের আমির আল্লামা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী ও মহাসচিব আল্লামা সাজেদুর রহমান বলেছেন, আমরা বিনা বিচারে গণহত্যাকারী আওয়ামী স্বৈরাচারের দোসরদের পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ প্রদানের তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি। সফল রক্তাক্ত গণঅভ্যুত্থানের বৈধতার ভিত্তিতে এ অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে। কিন্তু নজিরবিহীন জনসমর্থন থাকা সত্ত্বেও জুলাই বিপ্লবের প্রথম দাবি শাপলা চত্বর ও জুলাইয়ের গণহত্যাকারী আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার ক্ষেত্রে গড়িমসি করছে সরকার।
জামায়াতের ঢাকা দক্ষিণের সেক্রেটারি ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ বলেন, দুপুরের মধ্যে সব রাজনৈতিক দলকে ডেকে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করতে হবে। আমরা আজ (শুক্রবার) দুপুর পার করতে চাই না। অবিলম্বে সব রাজনৈতিক দল-মতকে নির্বিশেষে ডেকে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। আমিরে জামায়াত ডা. শফিকুর রহমান আপনাদের সালাম দিয়েছেন। আমরা আশা করি, এই সরকার ছাত্র-জনতার দাবি পূরণ করবে।
গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান বলেছেন, আওয়ামী লীগের রাজনীতি ও নির্বাচন করার কোনো সুযোগ নেই। গণহত্যার বিচার ও আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের জন্য কয়েক দফা দাবি জানালেও অন্তর্বর্তী সরকার তাতে কর্ণপাত করেনি।
বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি জাহিদুল ইসলাম বলেছেন, শহিদের রক্তে রঞ্জিত ‘জুলাই স্পিরিটের’ সঙ্গে যারাই প্রতারণা করবে, তারাই আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হবেন।
শাহবাগে এনসিপি, পল্টনে গণঅধিকার:
আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবিতে রাজধানীর শাহবাগ মোড় অবরোধ করেছেন আন্দোলনকারীরা। গতকাল শুক্রবার বিকেল পৌনে ৫টার দিকে শাহবাগ মোড় অবরোধ করেন তারা। হাসনাত আব্দুল্লাহর ঘোষণার পর আন্দোলনকারীরা মিছিল নিয়ে শাহবাগ মোড় অবরোধ করেন। সেখানে অবস্থান নিয়ে তারা আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবিতে বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকেন। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের পার্শ্ববর্তী সড়ক থেকে সমাবেশ শেষে আন্দোলনকারীরা শাহবাগ মোড় অবরোধ করলে সেখানে হাজারো মানুষ জমায়েত হয়। আন্দোলনকারীরা দাবি করেন, ফিরে এসেছে ২০২৪ সালের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময়ের উত্তাল দিনগুলো।
অন্যদিকে, একই দাবিতে রাজধানীর পল্টন মোড় অবরোধ করে আন্দোলন করে গণঅধিকার পরিষদ। এ সময় রাস্তা বন্ধ করে তারা স্লোগান দিতে থাকেন, ‘ব্যান্ড ব্যান্ড হবে, আওয়ামী লীগ ব্যান্ড হবে’, ‘শেখ হাসিনার ফাঁসি চাই’, ‘শেখ হাসিনার ঠিকানা এই বাংলায় হবে না’।
বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ঐকমত্য:
আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিতে চলমান এনসিপির আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করেছেন জামায়াতে ইসলামীর ঢাকা দক্ষিণের সেক্রেটারি ডা. শফিকুল ইসলাম মাসুদ। তিনি জানান, আমিরে জামায়াত ডা. শফিকুর রহমান আন্দোলনকারীদের সালাম জানিয়েছেন এবং আশা প্রকাশ করেছেন যে সরকার ছাত্র-জনতার দাবি পূরণ করবে। সহমত প্রকাশ করে গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর বলেন, বিচার সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত নির্বাহী আদেশে আওয়ামী লীগের সব কার্যক্রম নির্বাহী আদেশে নিষিদ্ধ করতে হবে।
একাত্মতা পোষণ করেছেন নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সভাপতি ও নতুন রাজনৈতিক দল জনতা পার্টি বাংলাদেশের (জেপিবি) সভাপতি চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন। মানবতার শত্রু আ.লীগকে দ্রুত নিষিদ্ধের দাবি করে একমত হয়েছেন হেফাজতে ইসলামের আমির আল্লামা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী ও মহাসচিব আল্লামা সাজেদুর রহমান। এ ছাড়া সহমত পোষণ করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল সংগঠন বিবৃতি দিয়েছে।
শাহবাগসহ রাজধানীজুড়ে যানজট:
আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিতে গতকাল শুক্রবার অবরোধের ফলে শাহবাগের চারপাশের রাস্তায় যানজট সৃষ্টি হয়। সায়েন্সল্যাব, নিউমার্কেট, টিএসসিসহ বাংলামোটর রাস্তার যানবাহন চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। তবে আন্দোলনকারীরা তাদের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত এই অবরোধ কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।
এ বিষয়ে শাহবাগ থানার ওসি খালিদ মনসুর বলেন, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে আন্দোলনকারীরা শাহবাগ মোড় অবরোধ করেছেন। ঘটনাস্থলে পর্যাপ্তসংখ্যক পুলিশ সদস্য মোতায়েন রয়েছে।
উল্লেখ্য, দীর্ঘ ১৬ বছর আওয়ামী লীগের শাসনের বিরুদ্ধে জন-অসন্তোষ থেকে জন্ম নেওয়া ২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর রাজনৈতিক পালাবদলের এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়। সময় গড়াতেই আবারও আ.লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে সরব হয়ে উঠেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সংগঠন।