প্রায়ই বৃদ্ধ বাবার কাছ থেকে টাকা নিতেন এমদাদুল হক বাদল (৫৬)। কখনো টাকা দিতে দেরি হলে বাবাকে হুমকিসহ বাসায় ভাঙচুর করতেন বখে যাওয়া এই বড় ছেলে। এবার টাকা দিতে দেরি হওয়ায় বাবাকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার চেষ্টা চালান বাদল। ছেলের দেওয়া আগুনে চিরদিনের জন্য বাম চোখ হারিয়েছেন প্রকৌশলী বাবা আব্দুল লতিফ (৭৫)। গত ১৫ এপ্রিল মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর উত্তর বাড্ডার একটি বাড়িতে নির্মম এই ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ভুক্তভোগীর ছোট ছেলে বাড্ডা থানায় একটি মামলা করেছেন।
পুলিশ অভিযুক্ত ছেলেকে গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠায়। তবে মামলা তুলে নিতে অভিযুক্ত বড় ছেলের বউ জিন্নাত রেহানা রত্নাসহ স্থানীয় নেতা (দুই-তিনজন) পরিচয়ে হুমকি দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীরা। প্রাণভয়ে অসুস্থ শরীরেও বাসায় থাকতে পারছেন না প্রকৌশলী আব্দুল লতিফ। শুধু বাবাকে নির্যাতনই নয়, অস্ত্র মামলাসহ বেশ কিছু অভিযোগও বাদলের বিরুদ্ধে রয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। ফলে শঙ্কা আর অনিশ্চয়তায় দিন কাটছে ভুক্তভোগী পরিবারটির।
জানা গেছে, প্রকৌশলী আব্দুল লতিফের উত্তর বাড্ডার চ-৯৫/৪ নম্বর বাড়ির তৃতীয় তলায় বউ ও মেয়ে নিয়ে বাস করেন বড় ছেলে এমদাদুল হক বাদল। আর বাড়ির দ্বিতীয় তলায় বাস করেন আব্দুল লতিফ ও তার ছোট ছেলে এনামুল হক বাপ্পি। বাড়িটি সিসি ক্যামেরা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।
পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়েছেন, বাদল আগে থেকেই বখে যাওয়া। একটি অস্ত্র মামলায় এক বছর ধরে জামিনে রয়েছেন তিনি। প্রতি মাসেই তিনি তার বাবার কাছ থেকে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা নিতেন। কখনো নিজের মেয়ের ভর্তি বাবদ ১৫ হাজার টাকা, আবার বিভিন্ন রকম অজুহাতে বাবার কাছ থেকে টাকা হাতাতেন বাদল। টাকা না দিলে বা টাকা দিতে এক-দুই দিন দেরি হলেই আব্দুল লতিফকে গালমন্দ, হুমকি-ধমকি দিতেন তিনি। এপ্রিল মাসটি ঈদের পর হওয়ায় ভাড়াটিয়ারা অনেকেই বাসা ভাড়ার টাকা দেননি। ফলে হাত খালি ছিল আব্দুল লতিফের। কিন্তু এমদাদুল হক বাদল যথারীতি বাবার কাছে টাকা চান। সেই টাকা না দিতেই বাধে বিপত্তি।
ঘটনার দিন একটি বাঁশের টুকরো নিয়ে বাড়ির নিচে গ্যারেজে ঢোকেন বাদল। বাঁশের মাথায় লোহা লাগানো ছিল। সেই লোহায় কাপড় পেঁচিয়ে গ্যারেজের মোটরসাইকেলের তেল নিয়ে আগুন জ্বালান। সেই আগুনে বাড়ির নিচতলার সিসি ক্যামেরা দুবার পোড়ানোর চেষ্টা চালান। এর আগেই কেয়ারটেকার বিষয়টি জানান বাবা লতিফকে।
এদিকে মনিটরে বাসায় বসে আগুন লাগানোর দৃশ্য দেখছিলেন বৃদ্ধ বাবা। একপর্যায়ে বাঁশে লাগানো আগুন নিয়ে ওপরে উঠতে থাকেন বাদল। বৃদ্ধ বাবা ভেবেছিলেন, তাকে দেখলে হয়তো ছেলে শান্ত হবে। কিন্তু বিধি বাম, দরজা খুলে বের হতেই বাবার গায়ে আগুন দেন ছেলে।
ঘটনার দিন আগুন লাগানো বেশ কয়েকটি সিসিটিভি ফুটেজ এসেছে এই প্রতিবেদকের কাছে। একটি ১২ সেকেন্ডের ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, গোল গলার গেঞ্জি ও গ্যাবাইডিং প্যান্ট পরিহিত অবস্থায় বাদল বাঁশের মাথায় আগুন জ্বালিয়ে নিচতলার সিঁড়ি দিয়ে ওপরের দিকে উঠছেন। পেছনে পেছনে হলুদ গেঞ্জি ও লুঙ্গি পরিহিত অবস্থায় বাসার কেয়ারটেকার উঠছিলেন। অপর একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, একটি বাজারের ব্যাগ নিয়ে এক নারী দ্বিতীয় তলা থেকে ওপরের দিকে যাচ্ছেন। এ সময় সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি ও লুঙ্গি পরা অবস্থায় বৃদ্ধ আব্দুল লতিফ লাঠি ভর দিয়ে দরজা খুলে বের হতেই বাঁশের মাথায় আগুন দেখতে পেয়ে ছেলেকে লাঠি উঁচিয়ে না করেন।
এরই মধ্যে মুখমণ্ডলে আগুন লাগালে দ্রুত দুই হাত দিয়ে সরিয়ে দেন আব্দুল লতিফ। এরপর ফের তার গায়ে আগুন দেন বাদল। তার চিৎকার শুনে পাশের ফ্ল্যাট থেকে ছোট ছেলে ও ছেলের বৌ দৌড়ে আসেন। এর আগেই সিঁড়িকোঠার মেজেতে লুটিয়ে পড়েন বৃদ্ধ আব্দুল লতিফ। আগুনে তার মুখমণ্ডল ও শরীরের বিভিন্ন স্থান পুড়ে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় বাম চোখ। এ ঘটনায় ছোট ছেলে এনামুল হক বাপ্পি বাদী হয়ে বাড্ডা থানায় একটি মামলা করেছেন।
মামলার এজহার সূত্রে জানা গেছে, এমদাদুল হক বাদল তার বৃদ্ধ বাবাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকেন। এ সময় তার বাবা গালিগালাজ করতে নিষেধ করেন। এতে বাদল ক্ষিপ্ত হয়ে নিজের হাতে থাকা বাঁশের লাঠির মাথায় কাপড় প্যাঁচানো আগুনের ফুলকি দিয়ে হত্যার উদ্দেশে বৃদ্ধ বাবার মুখমণ্ডলে আগুন লাগিয়ে দেন। এতে বাম চোখে গুরুতর রক্তাক্ত জখম হয়ে দৃষ্টি নষ্ট হয়ে যায়।
ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে আব্দুল লতিফ ফ্লোরে পড়ে গেলে বাদল ফের শরীরে আগুন লাগিয়ে দিলে বাম হাতসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে পুড়ে ক্ষত হয়। আব্দুল লতিফের চিৎকারে কেয়ারটেকার সামাদুল, ছোট পুত্রবধূ রুমা আক্তার ও ছোট ছেলে এনামুল হক বাপ্পিসহ স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে প্রথমে স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে যান। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য আগারগাঁও চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ভর্তি করেন। চোখে অস্ত্রোপচার ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন আব্দুল লতিফের বাম চোখ চিরদিনের জন্য নষ্ট হয়ে গেছে।
মামলায় ভুক্তভোগীর ছোট ছেলে উল্লেখ করেছেন, এ ঘটনার পর থেকে তার বড় ভাইয়ের স্ত্রী, তাকে, তার বাবা ও বোনদের বিভিন্ন ধরনের ভয়ভীতি ও হুমকি দিয়ে আসছেন। প্রাণভয়ে বাসায় থাকছেন না বৃদ্ধ বাবা আব্দুল লতিফ।
ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, মামলা হওয়ার পরে বাদল জেলে থাকলেও মামলার দ্বিতীয় আসামি বাদলের স্ত্রী রত্না প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তিনি একজন স্থানীয় লোক এবং বাড্ডা থানা বিএনপির রাজনীতি করেন এমন দুই ব্যক্তিকে দিয়ে মামলা তুলে নিতে হুমকি দিয়ে আসছেন। তারা ভুক্তভোগীকে প্রেশার দিচ্ছেন মামলা তুলে নিয়ে ছেলের (অভিযুক্ত বাদল) সম্পত্তির ভাগ বুঝিয়ে দিতে। তারপর সেই সম্পদ বিক্রি করে (বাবার সম্পত্তি) ক্ষতিপূরণ দেবেন বাদল। মামলা তুলে নিতে ভয়ভীতির কারণে গত ৫ মে সংশ্লিষ্ট থানায় একটি জিডি করেছেন বৃদ্ধের ছোট ছেলে এনামুল হক বাপ্পি।
জিডিতে তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘মামলার দ্বিতীয় আসামি জিন্নাত রেহানা রত্না এখন জামিনে আছেন, তিনি প্রতিনিয়ত আমাদের বিভিন্ন মাধ্যমে হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন মামলা তুলে নেওয়ার জন্য। কিছু অজ্ঞাত এবং বিএনপির রাজনীতি করে এমন নেতার পরিচয়ে আমাদের বাসার নিচে এসে কেয়ারটেকার সামাদুলকে হুমকি-ধমকি দিয়ে গেছেন, যাতে মামলা তুলে নেওয়া হয়।’ তখন তারা বাসায় ছিলেন না বলে দাবি করেছেন বাপ্পি।
এ সময় তারা বলে গেছেন, বিষয়টি সামাজিকভাবে সালিশের মাধ্যমে শেষ করে দেবেন। তাদের মতামত অনুযায়ী কাজ না করলে সমস্যায় পড়তে হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়ে গেছেন। এ ছাড়া তার বাবাকে কোথায় রাখা হয়েছে, সেই সন্ধানও চাইছেন অজ্ঞাত ওই ব্যক্তিরা। ফলে ভয়ভীতি আর শঙ্কায় দিন কাটছে ভুক্তভোগী পরিবারটির।
এনামুল হক বাপ্পি বলেন, ‘আইনের ওপর আমার পূর্ণ আস্থা আছে বলেই মামলাটি করেছি। আমি চাই মামলাটা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে। কিন্তু এভাবে হুমকি-ধমকি দিয়ে গেলে আমাদের স্বাভাবিক জীবন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বাসায় থাকতেও ভয় হচ্ছে এই ভেবে যে কখন কী হয়ে যায়। যেহেতু আমি পরিবারসহ উত্তর বাড্ডার বাসায় থাকি। এমনকি মামলার প্রথম সাক্ষী সামাদুলও এখন ভয় পাচ্ছে আমাদের বাসায় থাকার জন্য। মামলার দ্বিতীয় আসামি ইচ্ছে করেই এরকম কাজ করে যাচ্ছেন, যেন সমগ্র বিচারকাজ বাধাগ্রস্ত হয় এবং একটা বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়।’
এ বিষয়ে বাড্ডা থানার ওসি মো. সাইফুল ইসলাম রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, উত্তর বাড্ডার ওই ঘটনায় আসামিকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। আসামি বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন। মামলার তদন্ত চলমান।
ভুক্তভোগী পরিবারটির নিরাপত্তাসংক্রান্ত এক প্রশ্নের উত্তরে ওসি মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘তাদের নিরাপত্তাসংক্রান্ত কোনো ঝুঁকি নেই। আমি নিজেই ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। আমরা তাদের পাশে আছি। এ সংক্রান্ত কোনো সমস্যা হলে অবশ্যই আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
আপনার মতামত লিখুন :