ঢাকার মধ্যবাড্ডায় ক্যাবল টিভি ও ইন্টারনেট ব্যবসায়ী এবং গুলশান থানা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক কামরুল আহসান সাধনকে গত রোববার রাত ১০টার দিকে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। বাড্ডা গুদারাঘাট এলাকার একটি চায়ের দোকানের সামনে বসে থাকার সময় দুই যুবক হেঁটে এসে এলোপাতাড়ি গুলি চালায়।
পুলিশ জানায়, এই ঘটনায় জড়িত ৪ যুবকের মধ্যে ২ জন সরাসরি জড়িত। দুজনকে শনাক্ত করা হয়েছে। তবে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে তারা এই ঘটনায় রাজনৈতিক চাপে পড়েছে। যার কারণে সাধন হত্যার ঘটনা উন্মোচন করতে কিছুটা বেগ পেতে হচ্ছে। পুলিশ বলছে, শরীরে গুলির পাঁচ চিহ্ন ছিল। হত্যার প্রকৃত কারণ জানার অপেক্ষায় রয়েছি আমরা।
সাধন হত্যা মামলার তদন্তে ঢিলেঢালা কেন?
এদিকে সাধন হত্যার পর পুলিশের নানা ধরনের বক্তব্যের পর গুলশান থানা বিএনপির নেতারা ও সাধনের পরিবারের সদস্যরা ক্ষুব্ধ হয়ে বলছেন, সাধন হত্যা মামলার তদন্তে এত ঢিলেঢালা কেন? আসামি ধরতে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। বিএনপি নেতা সাধনের মৃত্যু ঘিরে রহস্য দানা বাঁধছে।
তাদের দাবি, সাধন হত্যার পেছনে কোনো মাফিয়া জড়িত হলে পুলিশ কেন বিষয়টি পরিষ্কার করে বলছে না। পরিবারের দাবি, এই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে কারা? আমরা জানতে চাই।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে গুলশান থানা বিএনপির এক যুগ্ম আহ্বায়ক ক্ষুব্ধ হয়ে রূপালী বাংলাদেশকে জানান, সাধন হত্যার মামলার তদন্ত ঢিলেঢালা কেন? এ মৃত্যু ঘিরে রহস্য এবং নেপথ্যে কারা? সেটা জানতে চাই।
পুলিশের এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা রূপালী বাংলাদেশকে জানান, অবশ্যই এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। হতে পারে মাফিয়াদের সাথে দেনদরবার, এলাকার আধিপত্য বিস্তার কিংবা ব্যবসা-বাণিজ্য, এসব কারণেও হত্যাকাণ্ড ঘটতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
তবে পুলিশের এই কর্মকর্তা জানান, এ ঘটনায় পুলিশকে রাজনৈতিক চাপ দেওয়া হচ্ছে। যার কারণে সাধন হত্যার ঘটনা উন্মোচন করতে কিছুটা বেগ পেতে হচ্ছে। তবে অবিলম্বে অপরাধীদের আটক করবে পুলিশ।
শরীরে গুলির পাঁচ চিহ্ন: সাধনের ঘাড়, পিঠ, বুক ও পেটে গুলিবিদ্ধ হয়। দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া হলেও চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। নিহতের স্ত্রী দিলরুবা আক্তার বাড্ডা থানায় অজ্ঞাতদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। ওই মামলার পর ময়নাতদন্তে তার শরীরে পাঁচটি গুলির চিহ্ন পাওয়া গেছে।
চিকিৎসকেরা তার শরীরের ভেতর থেকে গুলির একটি অংশও উদ্ধার করেছেন, যা পরীক্ষার জন্য ফরেনসিকে পাঠানো হয়েছে। তারা জানান, গুলির ক্ষতচিহ্ন পাঁচটির মধ্যে দুটি ছিল ঘাড়ে, দুটি ডান ও বাম বুকে এবং একটি হাতে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা মনে করছেন, যেকোনো বিষয় নিয়ে পূর্বশত্রুতার কারণে এই হত্যাকাণ্ড ঘটতে পারে। তবে অনেকেই অনেক কথা বলছেন, এ হত্যাকাণ্ড আসলে কোন দিকে মোড় নেবে, তদন্তের পরই তা জানা যাবে।
ঘটনাটি ঘটে গত রোববার রাত ১০টার পরপরই। মধ্যবাড্ডা গুদারাঘাট ৪ নম্বর রোডের একটি চায়ের দোকানে তিন বন্ধুর সঙ্গে বসে আড্ডা দিচ্ছিলেন কামরুল আহসান। হঠাৎ করেই গুলশান লেকপাড় থেকে দুই তরুণ হেঁটে এসে খুব কাছ থেকে তাকে লক্ষ্য করে গুলি চালান। পরে হামলাকারীরা একটি গলি দিয়ে দৌড়ে লিংক রোডের দিকে পালিয়ে যান। আশপাশের লোকজন দ্রুত কামরুলকে আগারগাঁওয়ে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
ঘটনার সময় সাধনের সঙ্গে ছিলেন জাকির হোসেন রূপক, আবুল হোসেন ও কামরুল ইসলাম বাবলু। সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণে দেখা যায়, হত্যার কয়েক মিনিট আগেই গুদারাঘাটের একটি গলিতে চার যুবককে একসঙ্গে কথা বলতে দেখা যায়। ধারণা করা হচ্ছে, সরাসরি হামলায় অংশ নেন দুজন, পাশে আরও দুজন ছিলেন।
এ বিষয়ে গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) তারেক মাহমুদ বলেছিলেন, সাধনকে হত্যার ঘটনার আগে দুর্বৃত্তরা সেখানে ঘোরাঘুরি করছিল বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। এখনই তেমন কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ সরাসরি তোলা যাচ্ছে না। তদন্ত সম্পূর্ণ হলে ঘটনার মোড় অন্যদিকেও ঘুরতে পারে।
নিহতের আত্মীয় পরিচয়ে জিহাদ হোসেন জানান, সাধন তার খালু। স্ত্রী দিলরুবা আক্তারকে নিয়ে মধ্যবাড্ডার গুদারাঘাট এলাকায় থাকতেন তিনি। পেশায় ছিলেন ডিশ ও ইন্টারনেট ব্যবসায়ী।
জিহাদ বলেন, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ময়নাতদন্ত শেষে কামরুল আহসান সাধনের দাফন সম্পন্ন হয় উত্তরা কবরস্থানে। তিনি সাধন হত্যার বিচারের দাবি জানিয়ে বলেন, সাধনের মৃত্যুর নেপথ্যে কে বা কারা এটা জানা জরুরি।
সাধনের স্ত্রী দিলরুবা আক্তার বলেন, ২২ বছর একসঙ্গে ছিলাম। আমাদের কোনো সন্তান ছিল না, কিন্তু কোনো দুঃখও ছিল না। আমরা একে অপরের প্রাণের পাখি ছিলাম। তবে আমার স্বামীর হত্যার ঘটনায় এ পর্যন্ত কেউ গ্রেপ্তার হলো না কোন সেটা চিন্তার বিষয়। তা ছাড়া আমরা জানতে চাই, এই খুনের ঘটনা নিয়ে এত ধোঁয়াশা কেন? ঘটনার পর কামরুল আহসানের স্ত্রী বাদী হয়ে বাড্ডা থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।
গোয়েন্দারা বলছেন, বাড্ডা এলাকায় সক্রিয় তিনটি অপরাধী চক্রের জিসান গ্রুপ, মেহেদী গ্রুপ ও রবিন-ডালিম-মাহবুব গ্রুপ। সাধন যেহেতু ডিশ ইন্টারনেট ব্যবসা করত সেহেতু তারও অপরাধী চক্রদের সাথে দেনদরবার হতো। কোনো একটা ইস্যু নিয়ে সাধন খুন হয়েছে হয়তো।
পুলিশ ও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, তাদের সঙ্গে মিলেমিশে চাঁদাবাজি করেন এই চক্রগুলোর সদস্যরা। এসব অবৈধ টাকার ভাগ যায় রাজনৈতিক নেতাদের পকেটে। তাই খুনের ঘটনা বন্ধ হয় না। আবার রাজনৈতিক ব্যক্তিরাও প্রতিপক্ষের কাউকে হত্যা করতে এদের কাজে লাগিয়ে থাকেন সাধনের ক্ষেত্রে হয়তো এমনটাই হয়েছে।
বাড্ডা থানার ওসি সাইফুল ইসলাম বলেন, সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে সরাসরি হত্যায় অংশ নেন দুজন, পাশে আরও দুজন ছিলেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। অর্থাৎ, মোট চারজন ঘটনার সময় উপস্থিত ছিলেন। তারা গুলি ছুড়ে দ্রুত স্থান ত্যাগ করেন।
তিনি আরও বলেন, পুলিশ এ বিষয়ে খুবই পরিশ্রম করছেÑ কেন, কীভাবে এবং কারা এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে তা উদঘাটনের জন্য।
সাধন হত্যার ঘটনায় রাজনৈতিক কোনো চাপ আছে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে ওসি বলেন, ‘কিছুটা চাপে আছি। আবার এক হিসেবে চাপ নেই বললেই চলে।’
আপনার মতামত লিখুন :