শুক্রবার, ০৬ জুন, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


রহিম শেখ

প্রকাশিত: জুন ৪, ২০২৫, ০১:০১ এএম

বাজেটে আয়ের হিসাব শুধু ‘কাগজে-কলমে’

রহিম শেখ

প্রকাশিত: জুন ৪, ২০২৫, ০১:০১ এএম

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

দেশের বিদ্যমান অর্থনৈতিক সংকট, মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক ঋণের চাপ, রাজনৈতিক চাপ, রাজস্ব ঘাটতিসহ বহুবিধ চাপের মধ্যে থেকেও ‘ব্যতিক্রমী বাজেট’ দেওয়ার কথা জানিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেছেন, অথনীতির ভারসাম্য রক্ষা করতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু সংকট মোকাবিলায় প্রস্তাবিত বাজেটে তেমন দিক-নির্দেশনা চোখে পড়েনি।

বাজেটের আকার ধরা হয়েছে ৭ লাখ ৯৭ হাজার ৭০০ কোটি টাকা, যা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১৫.২ শতাংশের সমান। অর্থাৎ দেশের সামগ্রিক উৎপাদনের তুলনায় বাজেটের আকার বড়, কিন্তু তার বাস্তবায়ন সক্ষমতা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন রয়েছে। রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৪১ হাজার ২০০ কোটি টাকা, যার প্রায় পুরোটাই তুলতে হবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে। 

বাস্তবতা হলো, বিগত কয়েক বছর ধরে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা কখনোই অর্জিত হয়নি। চলতি অর্থবছরেও ফেল করেছে এনবিআর। ফলে এই উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যপূরণ নিয়ে বাজেট বাস্তবায়নে শঙ্কা শুধু বাড়ছেই।

অর্থ উপদেষ্টা কেন প্রস্তাবিত বাজেটকে ‘ব্যতিক্রমী বাজেট’ বলে অভিহিত করেছেন তা মোটা দাগে কয়েকটি কারণ অধ্যাতিকভাবে উল্লেখ করেছেন। অর্থ উপদেষ্টার মতে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকট, আইএমএফের চাপ এবং রাজস্ব আহরণে দীর্ঘদিনের দুর্বলতা মিলে সরকারকে এক প্রকার সংযত বাজেট দিতে বাধ্য করেছে। বলা হচ্ছে, এই বাজেট রাজস্ব আহরণ ও ব্যয়ের মধ্যে ভারসাম্য রাখার প্রয়াস। কিন্তু এই ভারসাম্য যদি দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির কষ্টকে উপেক্ষা করে কেবল ‘পরিসংখ্যানগত’ হয়, তাহলে তা কার্যকর বাজেট নয়, বরং একটি ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ দস্তাবেজে পরিণত হয়।

বাজেট প্রস্তাবে আয়কর রেহাইসীমা ১২ লাখ টাকা পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে, যা অনেকের কাছে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য এটি কিছুটা স্বস্তির সংবাদ। তবে এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে যেভাবে ভ্যাট ও শুল্ক আরোপ এবং মূল্যস্ফীতির অভিঘাত দেখা যাচ্ছে, তাতে এই স্বস্তি কতটা টেকসই হবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। বিভিন্ন ভোগ্যপণ্য, রেস্টুরেন্ট সেবা, জামাকাপড়, বিস্কুট, মিষ্টি প্রভৃতি দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় জিনিসের ওপর ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে, যা সরাসরি সাধারণ ভোক্তার কাঁধে অতিরিক্ত চাপ তৈরি করবে। ফলে করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়লেও বাস্তবে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়বে অন্তত দ্বিগুণ হারে।

বাজেটের বক্তব্য ও হিসাবি অঙ্কে কিছুটা দুর্বলতা দেখা গেছে। যেমন বড় প্রকল্প ও অবকাঠামো নির্মাণেই বাজেটের বড় অংশ বরাদ্দ রাখা হয়েছে। অথচ স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষি ও সামাজিক নিরাপত্তার খাতে বাড়তি গুরুত্ব দেখা যায়নি। এমনকি ভর্তুকি কমিয়ে দেওয়ার ঘোষণা এসেছে, যা কৃষকদের জন্য একটি নেতিবাচক বার্তা।

এই বাজেটকে ব্যতিক্রমী বললে, সেটি হয়তো সরকারের অর্থনৈতিক সংকোচনের বাস্তবতা মেনে নেওয়ার দিক থেকে। কিন্তু সাধারণ জনগণের দৃষ্টিতে এটি ব্যতিক্রম নয়। এটি সেই চেনা বাজেট, যা পরোক্ষ কর বাড়িয়ে রাজস্ব বাড়ানোর চেষ্টা করে, কিন্তু মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের বাস্তব কার্যক্রমে যথাযথ মনোযোগ দেয় না। নীতিগত ও কাঠামোগত সংস্কারের যে প্রত্যাশা ছিল, সেটিও অনুপস্থিত।

এ ছাড়া বাজেটে ভর্তুকি কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিদ্যুৎ, গ্যাস ও সারের ভর্তুকিতে কাটছাঁট করা হয়েছে, যা কৃষক ও সাধারণ ভোক্তা উভয়ের জন্যই দুশ্চিন্তার বার্তা। গত বছরের তুলনায় এই খাতে বরাদ্দ কমানো হয়েছে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। অন্যদিকে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ খুব সামান্য পরিমাণে বাড়ানো হয়েছে (এবারের বরাদ্দ ১ লাখ ২৬ হাজার ২৭২ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ১৫.৮৪ শতাংশ), কিন্তু উপকারভোগীর সংখ্যা বা নতুন কর্মসূচি তেমনভাবে বাড়েনি। বাস্তবে উপকারভোগীর তুলনায় বাজেট বৃদ্ধির হার অনেক কম, ফলে প্রকৃত অর্থে নিরাপত্তা কার্যক্রমের প্রসার ঘটছে না।

অবশ্য বাজেটে কিছু ইতিবাচক দিকও আছে, যেমন আয়কর রেহাইসীমা ৩ লাখ থেকে বাড়িয়ে ৩.৫ লাখ করা হয়েছে। প্রবীণদের জন্য এই সীমা ৪.৫ লাখ, নারী ও ৭৫ বছরের বেশি বয়সীদের জন্য ৫ লাখ করা হয়েছে। তবে মূল্যস্ফীতি ও ব্যয় বৃদ্ধির তুলনায় এই ছাড় অত্যন্ত সামান্য, বিশেষত মধ্যবিত্ত শ্রেণির চাহিদার বিপরীতে। আয় বেড়েছে কম, ব্যয় বেড়েছে বেশি এই অসমতা রয়ে গেছে।

বাজেটের আরেকটি আলোচিত দিক হলো কর্মসংস্থান ও দক্ষতা উন্নয়ন খাতে কিছু প্রকল্প গ্রহণ। যেমন ৪৮ জেলায় তরুণদের ফ্রিল্যান্সিং প্রশিক্ষণ, আইটি খাতে দক্ষতা উন্নয়ন, উদ্যোক্তা উন্নয়ন ইত্যাদি। যদিও উদ্দেশ্য প্রশংসনীয়, কিন্তু বাস্তবায়নের ইতিহাস আশানুরূপ নয়। ২০২৩ সালে দুর্নীতির কারণে অনেক প্রশিক্ষণ প্রকল্প প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।

এ কারণে এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে কার্যকর নজরদারি ও স্বচ্ছতা অপরিহার্য। তবে একটা প্রশ্ন উঠেছে এবার ‘ব্যতিক্রমী’, বাজেট দিয়েছেন একজন অর্থনীতিবিদ। সালেহ উদ্দিন আহমেদ একসময় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরও ছিলেন। অর্থ উপদেষ্টার পেছনে আছেন নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের মতো প্রভাবশালী পরামর্শক, তখন বাজেটের মধ্যে সেই প্রত্যাশিত ‘ম্যাজিক’ কোথায়? বিষয়টি একটু সহজ করে বলা যাক। বাজেটে কোথাও ড. ইউনূসের ‘সামাজিক ব্যবসা’র ছায়া নেই। নেই দারিদ্র্য বিমোচনের সেই মৌলিক চিন্তার স্পর্শ, যা তাকে নোবেল এনে দিয়েছিল।

ক্ষুদ্র উদ্যোগকে উৎসাহিত করার কোনো সুনির্দিষ্ট কৌশল নেই। মধ্যবিত্ত বা নিম্নআয়ের উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ অর্থায়ন, কর ছাড়, অথবা প্রণোদনার কোনো স্পষ্ট রূপরেখা নেই। সামাজিক সুরক্ষা, নারী উদ্যোক্তা, কৃষিজ ব্যবসা এই জায়গাগুলোতে ‘ইউনূসীয় দর্শন’ ব্যবহার করা যেত, কিন্তু তার চিহ্নও খুঁজে পাওয়া যায় না। একসময় দেশের নামকরা গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ ব্যাংকিং খাতের সংকট উত্তরণেও কোনো পথনকশা দিতে পারেননি।
 
গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, বাজেটের ভাষাগত শক্তি এবং কৌশলগত অঙ্গীকারের পেছনে যে কাঠামোগত দুর্বলতা রয়েছে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। বাজেটের প্রস্তাবগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এটি মূলত আগের বাজেট কাঠামোরই ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে, যেখানে কিছু নতুন উদ্যোগ থাকলেও বহুদিনের পুঞ্জীভূত সমস্যা এবং কাঠামোগত সংস্কারের প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো যথাযথ গুরুত্ব পায়নি। বিশেষ করে রাজস্ব আহরণব্যবস্থার দুর্বলতা, সরকারি ব্যয়ের অদক্ষতা এবং প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা এই পুরোনো ব্যাধিগুলো এবারও তেমনভাবে চ্যালেঞ্জ করা হয়নি।

Link copied!