রাজধানীর উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভবনে গতকাল সোমবার বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় কাঁদছেন দেশবাসী। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, দুপুর সোয়া ১টার দিকে বিমানটি কলেজের একটি দোতলা ভবনের নিচতলায় সরাসরি আঘাত হানে। সেখানে তখন স্কুল শাখার ক্লাস চলছিল। মাইলস্টোন কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী ফাহিম হোসেন ও তারিকুল ইসলাম রূপালী বাংলাদেশকে কান্নাজড়িত কণ্ঠে দুর্ঘটনার বর্ণনা দেন। এ সময় তারা বলেন, চোখের সামনে মাত্র ১০ ফুট দূরে যুদ্ধবিমান আছড়ে পড়ে। বিমানটি আমাদের কলেজের দোতলা ঘেঁষে নিচের দিকে পড়ে যায়। দুর্ঘটনায় ভবনটির নিচতলা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আগুনের ভয়াবহতা এতই তীব্র ছিল যে সাধারণ মানুষের পক্ষে তা নেভানো সম্ভব ছিল না।
ঘটনাস্থলে কথা হয় চায়ের দোকানি রোজিনা আক্তারের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমরা ঘটনাটি দেখে দৌড়ে গিয়ে দেখি ঝলসানো অবস্থায় বাচ্চারা দৌড়াচ্ছে আর তারা ‘মা-মা, বাবা-বাবা’ বলে কাঁদছে।
প্রত্যক্ষদর্শী জেরিন আহমদ জানান, দুর্ঘটনার পরপরই ঘটনাস্থলে ছুটে আসি। তিনি বলেন, ভবনটির নিচতলার ভেতরের অবস্থা ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। ঘটনাটি যখন ঘটে ঠিক তখন আমাদের বাড়িওয়ালী তার মেয়েকে স্কুলে আনতে যান। বিকট শব্দ শুনে সবাই দৌড়ে গিয়ে দেখি বাচ্চারা ঝলসে গেছে। ধরার মতো পরিবেশ নেই। আগুনে ঝলসানো বাচ্চারা চিৎকার করে মা-বাবাকে ডাকছে। এই দৃশ্য দেখে নিজেকে ঠিক রাখতে পারিনি।
ঘটনাস্থলে দেখা যায়, বেশ কয়েকটি অ্যাম্বুলেন্স ক্যাম্পাসের ভেতরে-বাইরে আসা-যাওয়া করছে। শিক্ষার্থীদের উদ্বিগ্ন বাবা-মা, ভাই-বোন ও অভিভাবকেরা ক্যাম্পাসের বাইরে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন। ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে আসতে পারা কয়েকজন শিক্ষার্থীর চোখে-মুখে ছিল আতঙ্কের ছাপ।
এইচএসসি প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী মো. আরিফ রূপালী বাংলাদেশকে জানান, হঠাৎ পাশের বিল্ডিংয়ের নিচতলায় প্লেন বিধ্বস্ত হতে দেখি। সেখানে জুনিয়র শিক্ষার্থীদের ক্লাস চলছিল। বিকট শব্দের পর পুরো এলাকায় আগুন ধরে যায়। বিল্ডিং থেকে শিক্ষার্থীদের চিৎকার শুনতে পাচ্ছিলাম। আমরা তাড়াতাড়ি আমাদের বিল্ডিং থেকে নেমে এসে দেখি অনেকেই পুড়ে গেছে।’
নুর ইসলাম নামের আরেক শিক্ষার্থী জানান, ‘আমি একটি বিল্ডিংয়ের সপ্তম তলায় ক্লাসে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিলাম। দেখি সবাই ভয়ে কান্না করছে। বের হয়ে দেখি আমাদের অনেক ভাই-বোন নেই। কেউ কেউ পোড়া অবস্থায় দৌড়াচ্ছে আবার কেউ কেউ মাটিতে পড়ে আছে।’
আশপাশ থেকে ছুটে এসেছিলেন অনেকেই: প্রশিক্ষণ উড়োজাহাজ ভেঙে পড়ার পর আশপাশ থেকে ছুটে এসেছিলেন অনেকেই। তারা বলছেন, ঘটনার পর তারা স্কুলমাঠে একজনকে প্যারাসুট দিয়ে নামতে দেখেছেন। ভয়াল আগুনের জন্য তারা শুরুতে কাউকে উদ্ধার করতে পারেননি।
উড়োজাহাজটি আছড়ে পড়ে একটি ভবনের মুখে, যেখানে শিশু ও অভিভাবকদের দাঁড়ানোর জায়গা ছিল। আর ভবনটিতে বেশ কয়েকটি শ্রেণিকক্ষ রয়েছে, যেখানে তৃতীয় থেকে অষ্টম শ্রেণির ইংরেজি মাধ্যমের ক্লাস হতো। ঘটনার আগে মাত্রই সেখানে ক্লাস শেষ হয়েছিল।
একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী রাজন বলেন, একটা ফাইটার প্লেন নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে আমাদের জুনিয়র ক্যাম্পাস, যেখানে ক্লাস ফাইভ থেকে এইটের ক্লাস হয়, ঠিক সেইখানে প্লেনটা পড়ে। ওইখানে বলতে গেলে সবাই পুড়ে গেছে, সবাই ঝলসে গেছে। আমরা ভেতরে গেছিলাম, আগুনের কারণে কাউকে বের করতে পারিনি। খুব খারাপ অবস্থা ছিল।’ একাদশের শিক্ষার্থী মাইন বলেন, ক্লাসে ছিলাম, শব্দ পেয়ে নিচে নেমে দেখি আগুন জ¦লছে।
দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী তানভীর আলম বলেন, ‘আমরা যখন ক্লাসে ছিলাম, তখন বিস্ফোরণের মতো একটা শব্দ হইছে। আমরা কেউ বুঝতে পারিনি প্রথমে। তারপর হঠাৎ যখন সবাই দৌড়াদৌড়ি, ছোটাছুটি শুরু করলÑ তারপর স্যার আসলেন। ১ নম্বর বিল্ডিংয়ে বিমানের কিছু অংশ হয়তো ব্লাস্ট হইছে। বিল্ডিংয়ের সামনে পড়ছে, যার কারণে পুরো বিল্ডিংয়ে আগুন ধরে গেছে। তারপর আমরা বের হইছি। তারপর দেখি ফায়ার সার্ভিস। পাশেই ফায়ার সার্ভিস আর আর্মির ক্যাম্প ছিল। যার কারণে সবাই দ্রুত চলে আসছে। আগুন নিভাইতে বেশি সময় লাগেনি, কিন্তু ভেতরে অনেক মানুষ ছিল। ছোট বাচ্চারা ছিল। ওদেরকে বের করতে অনেক সময় লাগে।’
স্কুলের পাশেই বাসা নার্গিস বেগমের। তিনি বলেন, আমার ভাতিজি ক্লাস সিক্সে পড়ে। ক্লাস শেষে সবে সে বাসায় ফেরে। আর অন্য বাচ্চারা কোচিংয়ের জন্য ওই ভবনের সামনে অপেক্ষা করছিল। আর তখনই ঘটনা ঘটে।’ ঘটনার সময় অনেকেই ছুটে ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন। তাদের কয়েকজন বিকেলে স্কুলের ঘটনা নিয়ে নিজেদের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করছিলেন।
তাদের একজন ইব্রাহিম বলেন, ‘আমরা গিয়ে দেখি একজন প্যারাসুট নিয়া নামছে। আর বহু বাচ্চা আর তাদের গার্ডিয়ানরা আগুনে পুড়ছে। সবাই ধরাধরি করে তাদের সেখান থেকে সরায়ে আনার চেষ্টা করে। কিন্তু আগুনের তাপ ছিল সাংঘাতিক। স্কুলের ওই বিল্ডিংটার ভেতরে ঢোকার কোনো উপায় ছিল না। ওটার ভেতরে যারা ছিল, তাদের কী অবস্থা তা জানি না।’
অটোচালক মিজান বলেন, ‘এক জায়গায় দেখি ১০-১৫টা বাচ্চা পইড়ে রইছে। তাদের উদ্ধার করার কোনো উপায় আমাদের ছিল না। যেসব বাচ্চাদের বের করা হয়েছে, তারাও সব পুড়ে গেছে। জামা-কাপড় ব্যাগ সব পোড়া।’
আকমল নামের আরেকজন বলেন, কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘটনাস্থলে সেনাবাহিনী ও ফায়ার সার্ভিসের লোকজন চলে আসে। মাইলস্টোন স্কুল থেকে সবে বাসায় ফিরেছিলেন দশম শ্রেণির ছাত্র রিয়াদ। তাদের বাসা স্কুল থেকে দুই মিনিটের হাঁটাপথ। রিয়াদ বলেন, হঠাৎ বিকট শব্দ শুনে তিনি ঘরের বারান্দায় গিয়ে দেখেন, স্কুল থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। এরপর দৌড় দিয়ে ঘটনাস্থলে এসে দেখি, স্কুলের আগে যেটা হোস্টেল ছিল, পরে সেটা ইংলিশ মিডিয়াম শাখা বানানো হয়েছে- তার ঠিক সামনে একটি বিমান ক্রাশ করেছে। দাউ দাউ করে আগুন বের হচ্ছে।’
শান্ত নামের আরেকজন বলেন, ‘ওই ভবনে ১১ থেকে ১২টি ক্লাসরুম রয়েছে। ক্লাস থ্রি থেকে ক্লাস এইট পর্যন্ত ইংলিশ মিডিয়ামের ক্লাস হয় এখানে।’ প্রতি ক্লাসে ৩০ থেকে ৩৫ জন করে শিক্ষার্থী রয়েছে বলে শান্ত ধারণা দেন। তবে আর কিছু সময় পর সবার ছুটি হয়ে যেত। শিক্ষার্থীদের কী অবস্থা হয়েছে, জানতে চাইলে শান্ত বলেন, ‘আমরা অনেক ছাত্রকে বের করেছি, যাদের জামা-কাপড়, হাত-পা সব পুড়ে গেছে। যারা ভেতরে ছিলেন, তাদের বের হওয়ার কোনো উপায় ছিল না।’
বিকেল সাড়ে ৪টার পরও ঘটনাস্থল থেকে একের পর এক অ্যাম্বুলেন্স বের হচ্ছিল। এ সময় একটি হলুদ রঙের ক্রেন ও বিমানবাহিনীর একটি বড় ট্রাক ভেতরে ঢোকানো হয়। ঘটনার পরপরই উপস্থিত হয়েছিলেন ঠিকাদার আতিকুর রহমান। তিনি বলছেন, ‘যারা পুড়েছে, তাদের বেশির ভাগই আট থেকে দশ বছরের বাচ্চা। অনেকে হাতে ধরার মতো অবস্থায় ছিল না।’
এ সময় বাইরে অপেক্ষারত এক বাবা বলেন, আমার ছেলের সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছে, কিন্তু এখনো ওকে খুঁজে পাইনি। এখন ঢাকা মেডিকেলে যাচ্ছি। দোয়া করবেন, যাতে আমার বাচ্চাটা ভালো থাকে।
দুর্ঘটনাস্থলে বহু মানুষ ভিড় করায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খেতে হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে। সেনাবাহিনী ও পুলিশ সদস্যদের ভিড় সামলাতে দেখা যায়।
একটু পরই স্কুল ছুটি হতো:
বিমানটি যখন আমাদের বিল্ডিংয়ের ওপর পড়ে তখন আমরা একপাশ দিয়ে নামা শুরু করি। সিঁড়ি দিয়ে যে যেভাবে পেরেছে সে সেভাবে নামে। একটু পরই স্কুল ছুটি হতো, ওই ভবনে সবাই ছিল। গতকাল কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলে দুর্ঘটনার সময় স্কুলে থাকা শিক্ষার্থী আদিভা রহমান। সে বলেÑ ১, ৪, ৫ ও ৭ নম্বর বিল্ডিং নবম শ্রেণি থেকে সেকেন্ড ইয়ার পর্যন্ত। তারা আলহামদুলিল্লাহ সবাই সুস্থ আছেন। আমি ১ নম্বর ভবনে ছিলাম। বিমানটি পড়েছে প্লে থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত যে ভবনে ক্লাস হয় সেখানে।
আপনার মতামত লিখুন :