আজ মঙ্গলবার জাতির ইতিহাসে এক অনন্য গৌরবময় দিনÑ ৩৬ জুলাই গণঅভ্যুত্থান দিবস। দিনটি ঘিরে রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে দিনব্যাপী বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানমালা। যার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে বহু প্রতীক্ষিত ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ পাঠ। বিকেল সোয়া ৫টায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের উপস্থিতিতে এই ঘোষণাপত্র আনুষ্ঠানিকভাবে জাতির সামনে উপস্থাপন করা হবে।
সরকারের তথ্য অধিদপ্তরের এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে আয়োজিত মূল অনুষ্ঠানে বিকেল ৫টায় ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ পাঠ করা হবে, যা রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ রূপরেখা নির্ধারণে এক যুগান্তকারী রাজনৈতিক দলিল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। অনুষ্ঠানের আয়োজক সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়। সার্বিক ব্যবস্থাপনায় রয়েছে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি এবং সহযোগিতায় বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ সচিবালয়।
গণঅভ্যুত্থান দিবসের তাৎপর্য
গত বছর ৩৬ জুলাই তারিখে (৫ আগস্ট) বাংলাদেশ দেখেছিল এক নজিরবিহীন গণঅভ্যুত্থান। ইতিহাসের এই বাঁক পরিবর্তনকারী দিনে ফ্যাসিস্ট শক্তির পতন ঘটে এবং বাংলাদেশ প্রবেশ করে একটি নতুন রাজনৈতিক ধারায়। শহিদদের রক্ত আর সংগ্রামী জনগণের ত্যাগে রচিত সেই গৌরবময় অধ্যায় স্মরণে এবার দিনটি জাতীয়ভাবে পালন করা হচ্ছে।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম গত শনিবার এক ফেসবুক পোস্টে লেখেন, ‘আগামী মঙ্গলবার, ৫ আগস্ট ২০২৫ বিকেল ৫টায় গণঅভ্যুত্থানের সব পক্ষের উপস্থিতিতে জুলাই ঘোষণাপত্র জাতির সামনে উপস্থাপন করা হবে।’
সব পক্ষের সম্মতির ভিত্তিতে ঘোষণাপত্র
বিশেষভাবে উল্লেখ্য, অন্তর্বর্তী সরকার জুলাই ঘোষণাপত্রের খসড়া চূড়ান্ত করেছে দেশের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে মতামত বিনিময়ের মাধ্যমে। বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি, বিপ্লবী ও বামপন্থি জোটসহ প্রভাবশালী দলগুলোর সম্মতির ভিত্তিতে এ ঘোষণা চূড়ান্ত হয়েছে। এর মাধ্যমে এটি এক জাতীয় ঐকমত্যের দলিলে পরিণত হয়েছে। রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদানের পথও এর মাধ্যমে সুগম হবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
জুলাই সনদ ও ঘোষণাপত্রের পার্থক্য
গত বছরের ৩৬ জুলাইয়ের (৫ আগস্ট) ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিসরে সবচেয়ে আলোচিত দুটি শব্দÑ ‘জুলাই সনদ’ ও ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’। সরকারি ভাষ্যে আর রাজনৈতিক নেতাদের বক্তব্যে এই দুটি শব্দ এখন ঘনঘন উচ্চারিত হচ্ছে, কিন্তু একই সঙ্গে অনেকের মনে তৈরি হয়েছে বিভ্রান্তি। অনেকেই ধারণা করছেন, এই দুটি হয়তো একই দলিল বা অভিন্ন বিষয়। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। ‘জুলাই সনদ’ এবং ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ দুটি একেবারেই আলাদা দলিলÑ উদ্দেশ্য, কাঠামো ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে। সরকারের জাতীয় ঐকমত্য কমিশন এবং অন্তর্বর্তী সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর এ দুটি দলিলের মধ্যে পরিষ্কার পার্থক্য টেনে দিয়েছে।
জুলাই ঘোষণাপত্র
একটি জাতীয় ঐতিহাসিক দলিল। জুলাই ঘোষণাপত্র মূলত ২০২৪ সালের ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থান, শহিদ, আহত ও নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তিবর্গের অবদান এবং বাংলাদেশের নতুন রাজনৈতিক পথচলার পটভূমি তুলে ধরার জন্য একটি জাতীয় স্বীকৃতি দলিল।
জাতীয় ছাত্র ও নাগরিক প্রতিরোধ আন্দোলনের পক্ষ থেকে ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর ঘোষণাপত্র প্রকাশের কথা থাকলেও পরবর্তীতে রাজনৈতিক দল ও সরকারের আলোচনার ভিত্তিতে এই ঘোষণাপত্র এখন সরকারের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাচ্ছে।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম গত ৩০ জুন তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পোস্টে লিখেছিলেন, জুলাই ঘোষণাপত্র হচ্ছে ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, শহিদদের আত্মদান, নেতৃত্বের অবদান এবং একটি গণতান্ত্রিক নিরাপত্তাব্যবস্থার প্রতিশ্রুতি।
এনসিপির প্রচার ও প্রকাশনা সেলের সদস্য খালেদ সাইফুল্লাহ জুয়েল বলেন, এই ঘোষণাপত্র একদিকে যেমন গণঅভ্যুত্থান ও অন্তর্বর্তী সরকারের আইনি স্বীকৃতি প্রদান করবে, তেমনি ভবিষ্যতে কেউ যেন এই সরকার বা আন্দোলনকে অবৈধ বলে দাবি না করতে পারেÑ তা নিশ্চিত করবে।
ঘোষণাপত্রের সর্বশেষ খসড়ায় ২৬টি দফা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এতে রয়েছে ছাত্রলীগ কর্তৃক সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর চালানো ‘পাশবিক নির্যাতন’-এর বর্ণনা। শিক্ষার্থীদের ৯ দফা দাবির ইতিহাস ও তা একদফায় রূপান্তরের বিবরণ। সামরিক বাহিনীর একাংশের গণআন্দোলনের প্রতি সমর্থনের উল্লেখ। শেখ হাসিনা, তার মন্ত্রিসভা, স্পিকার ও সংসদ সদস্যদের দেশত্যাগের বিবরণ। ২০২৪ সালের ৮ আগস্ট জনগণের সার্বভৌম অভিপ্রায়ে অন্তর্বর্তী সরকারের গঠন। সংবিধানের প্রস্তাবনায় ‘জুলাই ঘোষণা’-র উল্লেখ এবং সংবিধানের তপশিলে তা সংযুক্ত করার প্রস্তাব।
জুলাই সনদ
সংস্কারের রোডম্যাপ অন্যদিকে ‘জুলাই সনদ’ বা ‘জাতীয় সনদ’ হচ্ছে একেবারে আলাদা বিষয়। এটি মূলত রাষ্ট্রীয় ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের রোডম্যাপ বা কাঠামোগত প্রতিশ্রুতি দলিল। ৩৬ জুলাইয়ের অভ্যুত্থানের পর সরকার পরিচালনার পদ্ধতি, সংবিধান, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা, বিচারব্যবস্থা ও দুর্নীতি দমন সংস্থাসমূহের সংস্কারের দাবিতে উচ্চকিত হয় জনগণ। এসব দাবিকে বাস্তব রূপ দিতে সরকার গঠন করে বিভিন্ন সংস্কার কমিশন এবং রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণে গঠিত হয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এই কমিশনই বর্তমানে একটি জুলাই সনদ প্রস্তুতের কাজ করছে। ইতোমধ্যে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক সম্পন্ন হয়েছে, যার সর্বশেষ পর্ব অনুষ্ঠিত হয় ৩১ জুলাই।
সনদের কাঠামো ও অঙ্গীকার
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন একটি ৭ দফা অঙ্গীকারনামার খসড়া চূড়ান্ত করেছে। এর অন্যতম মূল বিষয়গুলো হলোÑ সংবিধানের সংস্কার ও পরিমার্জন, নির্বাচন পদ্ধতির সংস্কার। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা। জনপ্রশাসন ও পুলিশ বাহিনী সংস্কার। দুদককে নির্বাহী হস্তক্ষেপমুক্ত করে স্বাধীনভাবে কাজ করার সক্ষমতা দেওয়া। দলগুলোর স্বাক্ষরের মাধ্যমে বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি প্রদান। আগামী সংসদ নির্বাচনে গঠিত সরকার এই সংস্কার দুই বছরের মধ্যে বাস্তবায়ন করবে।
জুলাই সনদ হলো একটি প্রতিশ্রুতি। সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবগুলোর মধ্য থেকে রাজনৈতিক দলগুলো যে কটিতে একমত হয়েছে, সেই তালিকাই এই সনদে থাকবে।
দিনব্যাপী আয়োজন ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান
‘৩৬ জুলাই উদযাপন’ উপলক্ষে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে আজ বেলা ১১টা থেকে শুরু হবে দিনব্যাপী অনুষ্ঠান। থাকবে সাংস্কৃতিক পরিবেশনা, আলোচনা সভা, গণপাঠ, থিয়েটার ও গানের অনুষ্ঠান। বিশেষ আকর্ষণ হিসেবে থাকছে স্পেশাল ড্রোন ড্রামার আয়োজন। সন্ধ্যায় মূল অনুষ্ঠান শেষে রাত ৮টায় মঞ্চে উঠবে দেশের জনপ্রিয় ব্যান্ড আর্টসেল, যা দিয়ে অনুষ্ঠানমালার সমাপ্তি হবে।
জাতীয় পর্যায়ে উদযাপন কর্মসূচি
এদিন দেশের ৬৪টি জেলায় সকাল ৯টায় জুলাই শহিদ স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হবে। একইসঙ্গে প্রতিটি ধর্মীয় উপাসনালয়ে শহিদদের আত্মার মাগফিরাত ও শান্তির জন্য মোনাজাত ও প্রার্থনার আয়োজন থাকবে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) সব সার্কেল অফিস নিজ নিজ এলাকায় রাস্তার পাশে বা ট্রাফিক ইন্টারসেকশনে বনজ, ফলদ ও ঔষধি গাছ রোপণ করবে। পরিবেশ রক্ষায় এটি সরকারের প্রতীকী অঙ্গীকার বলে জানা গেছে।
এ ছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থিত বাংলাদেশের মিশনসমূহে জুলাই অভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে নির্মিত চলচ্চিত্র, প্রামাণ্যচিত্র ও ডকুমেন্টারি প্রদর্শন করা হবে।
এবারের ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ নিয়ে জনগণের প্রত্যাশা তুঙ্গে। এটি শুধু একটি রাজনৈতিক দলিল নয়, বরং গণআন্দোলনের ফসল। এতে অন্তর্ভুক্ত বিষয়াবলি দেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক কাঠামো, সংবিধানিক সংস্কার এবং সামাজিক ন্যায়ের রূপরেখা নির্ধারণে মুখ্য ভূমিকা পালন করবে বলে বিশ্বাস করা হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ঘোষণাপত্র সফলভাবে বাস্তবায়িত হলে এটি হবে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক উত্তরণের এক নতুন মাইলফলক। গণঅভ্যুত্থানের এক বছর পূর্তিতে এমন ঐতিহাসিক আয়োজনে অংশ নিতে রাজধানীতে সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ প্রত্যাশিত।