- থেমেছে রিজার্ভের পতন
- ডলারের বাজারেও স্থিতিশীলতা ফিরেছে
- শৃঙ্খলা ফিরেছে ব্যাংক খাতে
- মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমলেও চাপে সাধারণ মানুষ
- সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগ অনেকটা স্থবির
সরকারের সামনে চ্যালেঞ্জ
- মূল্যস্ফীতি কমিয়ে রাজস্ব আদায় বাড়ানো
- বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়ানো
- নির্বাচনকেন্দ্রিক অনিশ্চয়তা দূর করা
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের পর একটি ভঙ্গুর অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে দায়িত্ব নেয় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার। দায়িত্ব গ্রহণের পর গত এক বছরে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের নানা উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। প্রবাসীদের পাঠানো ‘রেমিট্যান্স’ রীতিমতো অর্থনীতির মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। গত অর্থবছরে দেশে ৩০ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ডলারের প্রবাসী আয় এসেছে। দেশের ইতিহাসে এর আগে কোনো অর্থবছরে এত প্রবাসী আয় আসেনি। এর ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতন থেমে যায়। ডলারের বাজারেও স্থিতিশীলতা ফিরেছে। শৃঙ্খলা ফিরেছে ব্যাংক খাতে। রপ্তানি আয়ের উল্লম্ফনে গতি ফিরে আমদানিতে। অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকে অগ্রগতি হলেও সাধারণ মানুষের মধ্যে কাক্সিক্ষত স্বস্তি আসেনি। কারণ, মূল্যস্ফীতির চাপ পুরোপুরি সামাল দেওয়া যায়নি। মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমলেও এখনো চাপে আছে সাধারণ মানুষ। সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগও অনেকটা স্থবির। ফলে কর্মসংস্থান আশানুরূপ বাড়েনি। এমন অবস্থায় অর্থনীতিতে কয়েকটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে। এসব চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে মূল্যস্ফীতি কমানোর পাশাপাশি রাজস্ব, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়ানো এবং নির্বাচনকেন্দ্রিক অনিশ্চয়তা দূর করা।
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার টানা ১৫ বছরের বেশি ক্ষমতায় থেকেও সংকটে পড়া অর্থনীতিকে টেনে তুলতে পারেনি। শেষ সময়ে এসে অর্থনীতি প্রায় গভীর খাদে পড়ে যাচ্ছিল। তবে অর্থনীতি খারাপ হতে শুরু করেছিল মূলত ২০১৯ সাল থেকে। মাঝখানে দেখা দেয় কোভিড-২০ মহামারি। এরপর ২০২২ সালের শুরুতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে বৈশ্বিক অর্থনীতি বিপদে পড়ে যায়, যার প্রভাব পড়ে বাংলাদেশেও। তবে দেশে সংকট বেশি প্রকট হয়েছে আগের সরকারের একের পর এক ভুল ও খামখেয়ালি নীতির কারণে। অর্থনীতির প্রায় সব সূচকই তখন নি¤œমুখী ছিল। এর মধ্যে অন্যতম ছিল রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়। ২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলনের অন্যতম অবিস্মরণীয় অধ্যায় ছিল প্রবাসীদের ‘রেমিট্যান্স শাটডাউন’। হাসিনার পতনের দুই সপ্তাহ আগে থেকে বিভিন্ন দেশে থাকা বাংলাদেশি শ্রমজীবী প্রবাসীরা রেমিট্যান্স পাঠানো বন্ধ করে দেন। এতে সরকারের ওপর চাপ বাড়তে থাকে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর একটি ভঙ্গুর অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে দায়িত্ব নেয় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার। দায়িত্ব নেওয়ার পর বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের উল্লেখযোগ্য সাফল্য বৈদেশিক মুদ্রার মজুতের (রিজার্ভ) পতন ঠেকাতে পারা। আইএমএফের হিসাবপদ্ধতি (বিপিএম) অনুসারে এই রিজার্ভ এখন দুই হাজার ৪৭০ কোটি ডলারের আশপাশেই আছে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসেনি, বিনিয়োগে স্থবিরতা এবং রাজস্ব আদায়ে নাজুক পরিস্থিতি বিদ্যমান। রিজার্ভের পরিমাণ দেখে মনে হচ্ছে, এটি ভালো আছে। কিন্তু আমদানি খরচ কম হওয়া এবং বিদেশি ঋণের প্রবাহ বৃদ্ধি পাওয়ায় রিজার্ভ বেড়েছে। তাই রিজার্ভ পরিস্থিতি ভালো, এটা বলা যাবে না। সেলিম রায়হানের মতে, অর্থনীতি এখনো চাপের মধ্যে আছে। সরকারের ভাষ্য অনুসারে, চলতি অর্থবছরে নির্বাচন হবে। কিন্তু শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর হবে কি না, তা নিয়ে ব্যবসায়ীদের মধ্যে অস্বস্তি আছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মার্কিন প্রশাসনের পাল্টা শুল্ক আরোপ হলে রপ্তানি কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তা নিয়েও দুশ্চিন্তা আছে।
পতন থেমেছে রিজার্ভে
রেমিট্যান্স আয়ের দিক থেকে চলতি অর্থবছর ভালোভাবে শুরু হয়েছে। অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৯ শতাংশ। গত জুলাই মাসে প্রবাসীরা ২৪৭ কোটি ডলার বা ২ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন ডলার আয় দেশে পাঠিয়েছেন। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশে সব মিলিয়ে প্রায় ৩০ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ডলারের প্রবাসী আয় এসেছে। দেশের ইতিহাসে এর আগে কোনো অর্থবছরে এত প্রবাসী আয় আসেনি। এই আয় আগের অর্থবছরের ২৩ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলারের চেয়ে ৬ দশমিক ৪২ বিলিয়ন ডলার বা ২৬ দশমিক ৮ শতাংশ বেশি। এর আগে ২০২০-২১ অর্থবছরে রেমিট্যান্স এসেছিল ২৪ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার। প্রবাসী আয় বৃদ্ধি পাওয়ায় ডলারের বাজার স্থিতিশীল হয়ে উঠেছে। আইএমএফের হিসাবপদ্ধতি বিপিএম ৬ মান অনুযায়ী, রিজার্ভ অবশ্য ২৪ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার।
রাজস্ব ঘাটতির চাপে বাড়ছে দুশ্চিন্তা
গণঅভ্যুত্থানের পর ২০২৪ সালের আগস্টে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের ফলে অর্থনৈতিক কর্মকা-ে নতুন করে গতি আসায় বছরের শুরুর দিকে রাজস্ব প্রবৃদ্ধিতে পুনরুদ্ধারের লক্ষণ দেখা যায়। এপ্রিলে প্রবৃদ্ধি হয় ১৪ শতাংশের ওপরে। তবে গত জুনে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তারা আন্দোলনে নামার পর রাজস্ব আদায় কার্যক্রম একরকম বন্ধ হয়ে যায়। এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জুনে রাজস্ব আদায় কম হয়েছে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা, যা আগের অর্থবছরের একই মাসের তুলনায় প্রায় ১৯ শতাংশ কম। সব মিলিয়ে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মোট রাজস্ব আদায় হয়েছে প্রায় ৩.৭১ লাখ কোটি টাকা, যা এর আগের অর্থবছরে ছিল প্রায় ৩.৬৩ লাখ কোটি টাকা। এ অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ২.২৩ শতাংশ, যা কোভিড মহামারিতে ক্ষতিগ্রস্ত ২০১৯-২০ অর্থবছরের পর সর্বনিম্ন।
বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধিতে পতন
বিনিয়োগ খরার মধ্যে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমে সর্বনি¤œ পর্যায়ে এসেছে। গত জুন শেষে প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ৪ শতাংশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওয়েবসাইটে গত ২২ বছরের যে তথ্য রয়েছে, এ প্রবৃদ্ধি তার মধ্যে সর্বনি¤œ। এর আগে গত ফেব্রুয়ারিতে একবার প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৮২ শতাংশে নেমেছিল। এর আগে করোনা অতিমারির মধ্যেও বেসরকারি খাতের প্রবৃদ্ধি সাড়ে ৭ শতাংশের ওপরে ছিল। মূলত গত বছর ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকে প্রতি মাসেই ঋণ প্রবৃদ্ধি কমতে কমতে এ পর্যায়ে নেমেছে। গত বছরের জুলাইয়ে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল ১০ দশমিক ১৩ শতাংশ।
‘মন্থর’ বিনিয়োগে গতি ফিরেছে সামান্য
রাজনৈতিক অস্থিরতা, গ্যাস-বিদ্যুতের সংকটসহ বিভিন্ন কারণে দীর্ঘদিন ধরেই প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগে (এফডিআই) মন্দাভাব চলছিল। গত বছরের শেষ ছয় মাসে তা ৭১ শতাংশ কমে যায়। তবে চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে (জানুয়ারি-মার্চ) এফডিআই আসার হার বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে দেশে মোট ১৫৮ কোটি ডলারের এফডিআই এসেছে। এর মধ্যে ৭১ কোটি ডলার ফেরত নিয়ে গেছেন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা। সেই হিসাবে, গত জানুয়ারি-মার্চ সময়ে নিট এফডিআই এসেছে ৮৬ কোটি ডলার। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় যা ১১৪ শতাংশ বেশি।
ঋণের চাপে সরকার, কমছে বিদেশি সহায়তা
দেশের ইতিহাসে প্রথমবার এক বছরে ৪ বিলিয়ন ডলারের বেশি বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করেছে সরকার। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এ ঋণ শোধ করা হয়। আসল ও সুদ মিলিয়ে মোট পরিশোধ করা হয়েছে ৪০৮ কোটি ৬৯ লাখ ডলার। যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ২১ শতাংশ বেশি। পরিশোধ করা অর্থের মধ্যে আসল পরিশোধ হয়েছে ২৫৯ কোটি ৫১ লাখ ডলার এবং ১৪৯ কোটি ১৮ লাখ ডলার ব্যয় হয়েছে সুদ পরিশোধে। এদিকে, গত অর্থবছরে মোট ৮ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক ঋণ পেয়েছে বাংলাদেশ, যা চার বছরের মধ্যে সর্বনি¤œ। আর ঋণ প্রতিশ্রুতি ছিল ৮ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলার, যা আগের অর্থবছরের তুলনায় ২২ শতাংশ কম। এদিকে গত অর্থবছরে ৮৩২ কোটি ডলারের প্রতিশ্রুতি ছিল। ছাড় হয় ৮৫৭ কোটি ডলার। এর আগের ২০২৩-২৪ অর্থবছরে যেখানে ১ হাজার ৭৪ কোটি ডলার প্রতিশ্রুতির বিপরীতে ১ হাজার ২৮ কোটি ডলার ছাড় করা হয়েছিল।
উন্নয়ন প্রকল্পে স্থবিরতা
গত ২০ বছরের মধ্যে বিদায়ী অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) সর্বনি¤œ বাস্তবায়ন হয়েছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মাত্র ৬৮ শতাংশ এডিপি বাস্তবায়ন হয়। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) ওয়েবসাইটে ২০০৪-২৫ অর্থবছর থেকে গত ২০ বছরের এডিপি বাস্তবায়নের তথ্য দেওয়া আছে। ওই সময়ের মধ্যে সবচেয়ে কম এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছে বিদায়ী অর্থবছরে। বিদায়ী অর্থবছরে সংশোধিত এডিপির আকার ছিল ২ লাখ ২৬ হাজার ১৬৫ কোটি টাকা। বছর শেষে খরচ হয় মাত্র ১ লাখ ৫২ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা। বাস্তবায়ন হার ৬৭ দশমিক ৮৫ শতাংশ।