- জেলার ৫২টি ছড়া থেকে রাতের অন্ধকারে হচ্ছে বালু লুট
- ছয়টি সিলিকা বালুর কোয়ারি ইজারা দেওয়া হলেও যার মেয়াদ শেষ
- হাইকোর্টের স্থগিতাদেশ মানছে না কেউ। প্রশাসনও নিরব
- পরিবেশ অধিদপ্তর এবং জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের মধ্যে নেই সমন্বয়
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার মৌলভীবাজার। এ জেলার সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছে বেশ কয়েকটি টিলাবেষ্টিত নদী আর অসংখ্য পাহাড়ি ছড়া। এসব ছড়া মূল্যবান খনিজ সিলিকা বালুতে সমৃদ্ধ। তবে লুটেরাদের ভয়াল থাবায় গ্রাস হচ্ছে এসব মূল্যবান খনিজ বালু। নিয়ম না মেনে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের ফলে এসব ছড়া হচ্ছে শ্রীহীন, পরিবেশের ভারসাম্যও পড়ছে হুমকির মুখে।
সরকারি হিসাব অনুযায়ী, মৌলভীবাজার জেলায় সিলিকা বালুর কোয়ারির তালিকায় রয়েছে ৫২টি ছড়া। এর মধ্যে খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরোর অনুমোদিত ৩৩টি সিলিকা বালু কোয়ারি রয়েছে। এসব ছড়া থেকে রাতের আঁধারে একটি বিশেষ মহল বালু উত্তোলন করে বিক্রি করছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। কিন্তু তা ঠেকাতে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেই। প্রশাসনও অনেকটা নীরব ভূমিকা পালন করছে। সিলেটের পাথরের কোয়ারীর মতো মৌলভীবাজারের পাহাড়ি ছড়ার মূল্যবান সিলিকা বালুও হারিয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা।
জানা যায়, মৌলভীবাজারের সিলিকা বালুর কোয়ারি ইজারা বন্ধের দাবিতে পরিবেশবাদী সংগঠন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) ২০১৬ সালে হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করে। উচ্চ আদালত ৫২টি ছড়ার মধ্যে ১৯টির ইজারায় স্থগিতাদেশ দেন। এই ১৯টি ছড়া থেকে অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলন করলে পরিবেশ মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়বে বলে সতর্ক করা হয়।
পরে এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট (ইআইএ) ও এনভায়রনমেন্টাল ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান (ইএমপি) প্রাপ্তি সাপেক্ষে ৩৩টি ছড়ায় সিলিকা বালুর কোয়ারি ইজারার অনুমোদন দেওয়া হয়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে ১৪২৮ ও ১৪২৯ বাংলা সনে ৫০টি ছড়ায় সিলিকা বালুর কোয়ারিতে ইজারা-সংক্রান্ত দরপত্র বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। এর মধ্যে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরো (বিএমডি) অনুমোদিত ৩৩টি ছড়ার সিলিকা বালুর কোয়ারি রয়েছে। এসব ছড়ার মধ্যে মাত্র ছয়টি সিলিকা বালুর কোয়ারি ইজারা দেওয়া হয়, যার মেয়াদ ইতিমধ্যে শেষ হয়ে গেছে। মেয়াদ শেষ হলেও জেলার বেশির ভাগ সিলিকা বালুর কোয়ারি থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে।
জেলার বিভিন্ন উপজেলার ছোট-বড় ছড়ার সিলিকা বালুর কোয়ারি ঘুরে দেখা যায়, ছড়ার তীরে সিলিকা বালুর ছোট-বড় স্তূপ। বেশির ভাগ ছড়ায় রাতে কোদাল ও টুকরি দিয়ে বালু উত্তোলন করা হয়। বেশি বালুর স্তূপ না করে প্রতিদিন বিক্রি করে দেওয়া হয় বলে জানান স্থানীয়রা। যেখানে লোকসমাগম কম, সে জায়গা থেকেই মূলত বালু উত্তোলন করা হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সিলিকা বালু উত্তোলনকারী একজন বলেন, ‘কয়েক বছর ধরে ছড়ার বালু উত্তোলন করছি। রাতে উত্তোলন করি আমরা। যে বালু উত্তোলন করি, এগুলো বৃষ্টি হলে আবার পরিপূর্ণ হয়ে যায়। উত্তোলন করা বালু কখনো ট্রাক, পিকআপ বা ট্রাক্টরের মাধ্যমে বিক্রি করি।’
স্থানীয়রা জানান, যখন যে সরকার ক্ষতায় থাকে সে দলের স্থানীয় প্রভাবশালী নেতাকর্মীরা সিলিকা বালু উত্তোলনের পর বিক্রি করে। গত ৫ আগস্টের পর আওয়ামী সরকারের পতনের পর বর্তমানে বিএনপি ও জামায়াতের কিছু প্রভাবশালী নেতাকর্মী শ্রমিকদের দিয়ে পাহাড়ি ছড়ার মূল্যবান সিলিকা বালু উত্তোলন করে বিক্রি করছেন।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) মৌলভীবাজার জেলা শাখার সভাপতির সালেহ সোহেল বলেন, ‘সরকারকেই সিলিকা বালু রক্ষা করতে হবে। যারা নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে বালু উত্তোলনে জড়িত, তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। সময় থাকতে পদক্ষেপ না নিলে পরে ভোলাগঞ্জের মতো পাথর লুট হওয়ার পর মায়াকান্না করে কোনো লাভ হবে না।’
মৌলভীবাজার পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মাঈদুল ইসলাম বলেন, ‘সিলিকা বালু ইজারার সম্পূর্ণ বিষয় জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ থেকে দেখা হয়। বিষয়টি আমাদের কাছে নেই। যারা বালু উত্তোলন করে বিক্রি করছেন, তারা কার কাছ থেকে বৈধতা নিয়েছেন, সে তথ্যও জানা নেই।’
এ বিষয়ে বেলার সিলেট বিভাগীয় সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট শাহ সাহেদা আক্তার বলেন, ‘ইজারা না নিয়ে বালু উত্তোলন করা অবৈধ। এটি ঠেকানোর দায়িত্ব প্রশাসনের। যারা অবৈধ কাজের সুযোগ করে দিচ্ছেন, তারা আদালতের রায়কে অবমাননা করছেন।’
এ বিষয়ে মৌলভীবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক শাহীনা আক্তার বলেন, ‘যারা অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করেন, আমরা তাদের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করে জরিমানা ও মামলা দিই। অনেক সময় অভিযানে গেলে আমাদের উপস্থিতি টের পেয়ে সবাই পালিয়ে যান। পরে এসব বালু জব্দ করে নিলামে বিক্রি করা হয়।’
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন