- স্থানীয় রাজনৈতিক শক্তিকে পাত্তা দিতেন না
- ছিল মাঠপর্যায়ে কাজের দক্ষতার অভাব
- পাথরকাণ্ডে ‘বিশেষ সুবিধা’ নেওয়ার অভিযোগ
- কয়েকটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টদের সঙ্গেও জড়ান বিরোধে
- একদিনের মাথায় আবারও বদলি কোম্পানিগঞ্জের ইউএনও
কথাবার্তায় ছিলেন নম্র, আচরণে ছিল ভদ্রতার ছাপ। মুখে লেগে থাকত হাসি। প্রথম দেখায় যে কেউই মুগ্ধ হতেনÑ কিন্তু সেই মানুষটি সিলেটবাসীকে মুগ্ধ করতে পারলেন না। পাথরকা-ে অপবাদ মাথায় নিয়ে বিদায় নিতে হচ্ছে সিলেট থেকে। তাও ওএসডিÑ প্রশাসনে যেটি শাস্তি ও অমর্যাদার জায়গা। পরবর্তী পদায়ন না হওয়া পর্যন্ত তাকে পাথরের দায় নিয়েই কাটাতে হবে।
২৭তম বিসিএসের কর্মকর্তা মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ সিলেটের জেলা প্রশাসক হিসেবে যোগ দেন ২০২৪ এর গণঅভ্যুত্থানের পর, তার কার্যকাল শুরু হয় ১২ সেপ্টেম্বর থেকে। মাঠপর্যায়ের শীর্ষ সব পদ থেকে যখন অন্তর্বর্তী সরকার সবাইকে সরিয়ে নেয়, তখন খালি হওয়া সিলেটের জেলা প্রশাসক পদে তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়। জামায়াত ঘরানার কর্মকর্তা হিসেবে তার পরিচিতি ছিল। সিলেটে বেশি সুসম্পর্ক ছিল জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে। তবে কাউকেই তিনি তার দায়িত্বকালে খুব একটা পাত্তা দেননি। চলতেন নিজের মতো করে। মাঝপথে এসে বিরোধে জড়ান সিলেটের প্রভাবশালী ব্যক্তি ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। বিশেষ করে বিএনপির একটি অংশের সঙ্গে তার সম্পর্ক হয়ে ওঠে সাপেনেউলে। সেই বলয়ে আছেন সিলেটের জনপ্রিয় নেতা বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা ও সিলেট সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। সম্পর্কের এতটাই অবনতি ঘটে যে, আরিফুল হক চৌধুরী তার বিরুদ্ধে রাজপথে আন্দোলনে নামেন।
আল্টিমেটাম দেন পদত্যাগের। এখান থেকে বিরোধ প্রকাশ্যে উঠে আসে। সিলেটের পাথর কোয়ারি ও জালালাবাদ অন্ধকল্যাণ হাসপাতাল নিয়ে মূলত আরিফুল হক চৌধুরীর সঙ্গে তার মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব শুরু। তার বিরুদ্ধে আরিফ প্রকাশ্যে মাঠে নামলেও সিলেট বিএনপির আরিফবিরোধী একটি বলয়কে কাছে টেনে সে যাত্রায় রক্ষা পান ডিসি মুরাদ। বিএনপির ওই পক্ষ তার পাশে এসে দাঁড়ালে আরিফের হুংকার পালে পানি পায়নি।
গত সোমবার সমালোচনার মুখে সিলেটের জেলা প্রশাসক শের মাহবুব মুরাদের যখন বদলির আদেশ আসে, তখন তিনি সাদাপাথর পরিদর্শনে। যে সাদাপাথরকা-ে তিনি ওএসডি, সেই সাদাপাথর পরিদর্শনের সময়ই শুনতে পেলেন, তাকে সিলেট থেকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে, তিনি ওএসডি হয়েছেন। সেখানেই সহকর্মীরা এ খবর তাকে অবগত করেন। সে সময় তার সঙ্গে ছিলেন কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আজিজুন্নাহার। তাকেও একই দিনে একই অভিযোগে বদলি করা হয়। তিনিও সাদাপাথরে থাকাকালে বদলির খবর জানতে পারেন।
একটি সূত্রের দাবি, ডিসি মোহাম্মদ শের মাহমুদ মুরাদের মাঠের অভিজ্ঞতা একেবারেই কম। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় মাঠপর্যায়ে যাওয়ার সুযোগ হয়নি তার। ফলে জেলা প্রশাসন চালাতে এসে রীতিমতো হিমশিম খেতে হতো। জেলা প্রশাসনের অন্যান্য কর্মকর্তা, স্টাফদের পরামর্শে তাকে চলতে হয়। এ জন্য তার সিদ্ধান্ত প্রভাবিত হয় তারই অধীনস্ত জুনিয়র কর্মকর্তাদের আকাক্সক্ষা ও মর্জিমাফিক। গুঞ্জন আছে, তার বেকায়দায় পড়ার পেছনে কয়েকজন সহকর্মী কর্মকর্তা দায়ি। তারা তাকে বিভ্রান্ত করে প্রশ্নের মুখে ফেলেছেন।
এ ছাড়াও সিলেট জেলা প্রশাসন ও উপজেলায় দায়িত্ব পালন যারা করছেন, তাদের অধিকাংশই আওয়ামী লীগ আমলে নিয়োগ পাওয়া। মূলত তারাই তাকে ভুল সিদ্ধান্ত নিতে প্রভাবিত করেছেন। সিলেট বিভাগীয় কমিশনার অফিসের একটি সূত্র জানায়, অভিজ্ঞতা না থাকায় পাথরকা-ে দেশব্যাপী সমালোচনা শুরুর পর সম্প্রতি বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ে এক সভায় বসেন বিভাগীয় কমিশনারসহ সিলেটের প্রশাসন ও পুলিশ বিভাগের সিনিয়র কর্তারা। সেদিন পাথর লুট ইস্যুতে তাকে সেখানে তুলোধুনো করা হয়। এতে তিনি অনেকটাই ভেঙে পড়েন। অনেকে বলছেন, রাজনৈতিক চাপে সিলেটের প্রশাসন মূলত ছিল ঢাল-তলোয়ারবিহীন নিধিরাম সরদারের মতো। ফলে চাইলেও তার পক্ষে অনেক কিছু করা সম্ভব ছিল না।
সাদাপাথর নিয়ে নিবিড়ভাবে কাজ করেছেন সিলেটের সাংবাদিক শুয়াইবুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘পাথর লুট হওয়ার বিষয়টি জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদের একক ব্যর্থতা নয়। তার দায় আছে সত্য, আমাদেরও দায় রয়ে গেছে। সিলেটে এসে সব রাজনৈতিক পক্ষকে সঙ্গে নিয়ে ন্যায়নীতির ভিত্তিতে পরিচালনা করা উচিত ছিল। কিন্তু রাজনীতিকরা বিশেষ করে বিএনপির নেতারা অভিযোগ করছেন সিলেটে এসে ডিসি তাদের পাত্তাই দেননি। আবার তাকে ব্যর্থ করতে সবাই ঐক্যবদ্ধ ছিল। আর উপদেষ্টা রিজওয়ানা হাসান যখন প্রকাশ্যে বক্তব্য দিয়ে সিলেটের পাথর লুটে রাজনৈতিক ঐক্যের কথা বললেন এবং হতাশা প্রকাশ করলেন তখন ডিসির ওপর একা দায় দেওয়া যায় কীভাবে? তার কী এমন শক্তি আছে লুটপাট ঠেকানোর?’
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, তার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ ‘বিশেষ সুবিধা’ নিয়ে সিলেটের কয়েকটি বালু ও পাথর কোয়ারি লুটেরাদের হাতে ছেড়ে দেওয়া। সিলেটে তিনি আলোচনার খোরাক দেন খাজাঞ্চি বাড়ি স্কুল, জালালাবাদ অন্ধ কল্যাণ হাসপাতালসহ আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান নিয়ে প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে যাওয়ার পর। প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে বলা হয়, অনৈতিক সুবিধা না পাওয়ায় তিনি বিরোধ সৃষ্টি করেছিলেন। এ নিয়ে গণমাধ্যমেও লেখালেখি হয়।
সূত্র মতে, সিলেটের একাধিক ফেরিঘাট ও টোল প্লাজা নিয়মতান্ত্রিক পথে ইজারায় না গিয়ে তিনি যাচ্ছেতাইভাবে লুটেপুটে খাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন। পাশাপাশি মব জাস্টিসের শিকার হয়ে অনেকে তার কাছে প্রতিকারের আশায় গেলেও তারা তার কাছে কোনো সহযোগিতা পাননি। উল্টো তার কাছে হয়রানির শিকার হয়েছেন। তিনি সিলেটের স্কুল-মাদ্রাসাসহ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান ও শিক্ষকদের বেতনভাতা আটকে রেখেছেন। এ কারণে তারা দীর্ঘদিন ধরে এক রকম মানবেতর জীবনযাপন করছেন। বারবার তার কাছে ধরনা দিয়েও কাজ হয়নি।
সিলেট বিভাগীয় গণদাবি ফোরামের সভাপতি ও বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট চৌধুরী আতাউর রহমান আজাদ বলেন, ‘তিনি সিলেটকে সামগ্রিক দিক থেকে হযবরল অবস্থায় ফেলে দিয়েছেন। সিলেটে দায়িত্ব পালন করলেও এ অঞ্চলের প্রতি তার দায়িত্ববোধের অভাব ছিল। গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে যে দক্ষতা ও বিচক্ষণতার পরিচয় দেওয়া দরকার ছিল, তা দেখাতে পারেননি। জেলার অভিভাবক হিসেবে সব ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলা করে শৃঙ্খলা রাখতে পারেননি। সেখানে তার সফলতা নেই বললেই চলে।’
তিনি আরও বলেন, ‘যেহেতু সাদাপাথর লুটের সঙ্গে তাদের যোগসাজশের অভিযোগ এনে বদলি করা হয়েছে, সুতরাং শুধু এই শাস্তি নয়, তাদের সম্পদের হিসাবও নিতে হবে। আর তাতে গরমিল পেলে অবশ্যই কৈফিয়তের মুখোমুখি করতে হবে।’
এদিকে সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) পদে এক দিনের মাথায় আবারও রদবদল হয়েছে। এ উপজেলার ইউএনও হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন মোহাম্মদ রবিন মিয়া। তিনি হবিগঞ্জের চুনারুঘাটের ইউএনও পদে ছিলেন। গতকাল মঙ্গলবার এ তথ্য জানা গেছে।
এর আগে গত সোমবার সন্ধ্যায় কোম্পানীগঞ্জের ইউএনও আজিজুন্নাহারকে বদলি করে সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলায় এবং ফেঞ্চুগঞ্জের ইউএনও মোহাম্মদ শফিকুল ইসলামকে কোম্পানীগঞ্জে নিয়োগ দেওয়ার তথ্য জানা যায়। সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার খান মো. রেজা-উন-নবী স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে জনস্বার্থে জারিকৃত এ আদেশ অবিলম্বে কার্যকর করার কথা প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছে। পরে আরও একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়, যাতে কোম্পানীগঞ্জের ইউএনও হিসেবে হবিগঞ্জের চুনারুঘাটের ইউএনও মোহাম্মদ রবিন মিয়াকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।
মোহাম্মদ রবিন মিয়া ৩৬তম বিসিএসের কর্মকর্তা; বর্তমানে হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার ইউএনও হিসেবে কর্মরত। তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জের বর্তমান ইউএনও মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম। অন্যদিকে কোম্পানীগঞ্জের ইউএনও ফেঞ্চুগঞ্জের ইউএনওর স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন।

আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন