তিন দফা দাবিতে বুয়েটসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল শিক্ষার্থীরা প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যুমনা অভিমুখে মিছিল নিয়ে যাওয়ার সময় সাউন্ড গ্রেনেড, কাঁদানে গ্যাস ছুড়ে তা ছত্রভঙ্গ করে দিয়েছে পুলিশ। গতকাল বুধবার রাজধানীর শাহবাগ মোড়ে ঘণ্টাখানেক অবস্থানের পর দুপুর দেড়টার দিকে শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে যমুনার দিকে রওনা হয়। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের সামনে আসার পর ওই মিছিল পুলিশ আটকে দেয়। একপর্যায়ে সেখানে পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদানে গ্যাস ছুড়ে মিছিলটি ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এই ঘটনায় অন্তত ৬০ জন শিক্ষার্থী হয়েছেন বলে দাবি করছেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। অন্যদিকে পুলিশের দাবি, পুলিশকে লক্ষ্য করে শিক্ষার্থীরা ইটপাটকেল ছোড়েন। এই ঘটনায় পুলিশের আট সদস্য আহত হয়েছেন।
এদিকে প্রকৌশল শিক্ষার্থীদের দাবির যৌক্তিকতা খতিয়ে দেখতে উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফায়জুল কবির খানকে সভাপতি করে আট সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। যদিও এই কমিটি প্রত্যাখ্যান করে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীকে আন্দোলনকারীদের সামনে এসে ক্ষমা চাওয়াসহ পাঁচ দফা দাবিতে রাত সাড়ে ৮টায় এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত শাহবাগে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছিলেন আন্দোলনরত প্রকৌশল শিক্ষার্থীরা। অন্যদিকে শাহবাগে শিক্ষার্থীদের ওপর এই হামলার খবর ছড়িয়ে পড়ায় রুয়েট ও কুয়েটের শিক্ষার্থীরা সড়ক ও রেলপথ অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। আর চুয়েটের শিক্ষার্থীরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গায়েবানা নামাজ পড়েছেন।
সূত্র জানায়, ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের নামের আগে প্রকৌশলী লিখতে না দেওয়া, ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের কাউকে পদোন্নতি দিয়ে নবম গ্রেডে উন্নীত না করা এবং দশম গ্রেডের চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে স্নাতক প্রকৌশলীদের সুযোগ দেওয়ার দাবিতে পূর্বঘোষিত ‘লংমার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচির অংশ হিসেবে গতকাল বুধবার বেলা ১১টার দিকে তারা শাহবাগের প্রধান সড়কে অবস্থান নেন। ফলে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ এই মোড় ও আশপাশের সড়কগুলোয় যানজট তৈরি হয়। এতে ভোগান্তিতে পড়েন ওই সড়ক দিয়ে যাতায়াতকারীরা।
এরপর গতকাল বেলা দেড়টার দিকে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনা অভিমুখে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। এ সময় শিক্ষার্থীদের বাধা দেয় পুলিশ। বাধা দিলে পুলিশের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের ধস্তাধস্তি শুরু হয়। একপর্যায়ে পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ে। কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে। জলকামান দিয়ে পানি ছুড়ে। পুলিশের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। পুলিশ লাঠিচার্জ করলে একপর্যায়ে শিক্ষার্থীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যান।
পরে আবার তারা একত্র হয়ে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল মোড়ে অবস্থান নেন। সেখানে থাকা বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাইয়াজ বলেন, ‘পুলিশের হামলায় আমাদের অনেকেই আহত হয়েছেন। দাবি না মানা পর্যন্ত আমরা সড়ক ছাড়ব না।’ এ ছাড়াও শাহবাগে ইন্টারনেট বন্ধ করা এবং ডিএমপির রমনা বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মাসুদ আলমের বিরুদ্ধে প্রকৌশল শিক্ষার্থীকে গলা টিপে ধরার অভিযোগ তুলেছেন।
এদিকে গতকাল বিকেল সাড়ে ৫টায় কর্মসূচিতে পুলিশের বাধার প্রতিবাদে ব্রিফিংয়ে এসে আন্দোলনকারীদের তরফে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী জুবায়ের আহমেদ শাহবাগে অবস্থান কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, আমাদের দাবিগুলো মেনে নেওয়া না হলে আমরা কঠোর কর্মসূচি দিতে বাধ্য থাকব। আমাদের দাবি মেনে না নেওয়া পর্যন্ত আমরা ঢাকা ও ঢাকার বাইরের সব শিক্ষার্থী এখানে অবস্থান করব।
এ ঘটনায় ৫০ থেকে ৬০ জন শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন উল্লেখ করে জুবায়ের আহমেদ স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীকে প্রকৌশল অধিকার আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের হামলার কারণে ক্ষমা চাইতে হবে এবং জবাবদিহি করাসহ ৫ দফা দাবিতে বলেন, বিএসসি ডিগ্রিধারী ও ডিপ্লোমাধারীদের পেশাগত দাবিগুলোর যৌক্তিকতা পরীক্ষা করে সুপারিশ দিতে সরকার যে কমিটি গঠন করেছে সেটি ‘প্রতিনিধিত্বের বিচারে অনুপযুক্ত’।
প্রকৌশল অধিকার আন্দোলনের অংশীজন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্ত করে কমিটি সংস্কার করতে হবে। তিন দফা দাবি মেনে নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে প্রজ্ঞাপন জারি করতে হবে। এজন্য তিন উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান, আদিলুর রহমান ও সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানকে আন্দোলনকারীদের সামনে এসে নিশ্চয়তা দিতে হবে; হামলায় আহত সব শিক্ষার্থীর সুচিকিৎসা নিশ্চিত ও তাদের চিকিৎসার ব্যয়ভার সরকরের পক্ষ থেকে বহন করতে হবে। আন্দোলন চলাকালীন সব শিক্ষার্থীর নিরাপত্তা নিশ্চিত ও পুলিশ দিয়ে আর হামলা করা হবে না বলে নিশ্চিয়তা প্রদান; আন্দোলনকারীদের ওপর হামলাকারীদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা; হামলাকারী পুলিশ সদস্যদের চাকরি থেকে বরখাস্ত করা।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) রমনা বিভাগের উপকমিশনারের (ডিসি) মাসুদ আলম সাংবাদিকদের বলেন, সমাধান নিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনা চলছিল। সচিবালয়ে তিনজন উপদেষ্টা এটা নিয়ে কাজ করছেন। শিক্ষার্থীদের বলা হয়েছিল শাহবাগে অবস্থান করতে। আধঘণ্টার ভেতরে তাদের সমস্যার সমাধান হবে। আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা শিক্ষার্থীরা বিকেল ৩টা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে রাজিও হয়েছিলেন। কিন্তু আলোচনা চলাকালে হঠাৎ শিক্ষার্থীরা যমুনা অভিমুখে রওনা হন। পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে যমুনার দিকে যাওয়ার চেষ্টা করেন। তখন তাদের ছত্রভঙ্গ করা হয়। এ সময় পুলিশকে লক্ষ করে ইট-পাটকেল ছোড়া হয়। এই ঘটনায় কয়েকজন পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন।
রাজশাহীতে মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ
ঢাকায় প্রকৌশল শিক্ষার্থীদের তিন দফা দাবির আন্দোলনে পুলিশের হামলার প্রতিবাদে রাজশাহীতে মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। গতকাল বুধবার দুপুরে ঢাকায় হামলার খবর ছড়িয়ে পড়লে বিকেল ৩টার দিকে রুয়েটের শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদে ফুঁসে ওঠেন। তাৎক্ষণিক বিভিন্ন হল থেকে শিক্ষার্থীরা বের হয়ে ক্যাম্পাসে সমবেত হয়ে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। মিছিলটি ক্যাম্পাস থেকে বের হয়ে নগরের তালাইমারী মোড়ে গিয়ে বিকেল ৪টার দিকে রাজশাহী-ঢাকা মহাসড়ক অবরোধ করে। এতে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
শিক্ষার্থীরা জানান, ঢাকায় শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনার সুষ্ঠু বিচার না হওয়া পর্যন্ত তারা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন এবং কোনোভাবেই সড়ক ছাড়বেন না।
অন্তর্বর্তী সরকারের গায়েবানা নামাজ পড়লেন চুয়েট শিক্ষার্থীরা
শাহবাগে প্রকৌশল শিক্ষার্থীদের কর্মসূচিতে পুলিশের হামলার প্রতিবাদে অন্তর্বর্তী সরকারের গায়েবানা নামাজ পড়েছেন চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) শিক্ষার্থীরা। গতকাল বুধবার সন্ধ্যার দিকে এই নামাজের আয়োজন করেন তারা।
কুয়েট শিক্ষার্থীদের রেলপথ অবরোধ
হামলার প্রতিবাদে খুলনা মহাসড়ক ও ফুলবাড়ীগেট রেলপথ অবরোধ করে বিক্ষোভ করছেন খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) শিক্ষার্থীরা। গতকাল বুধবার বিকেল ৪টা থেকে তারা এ অবরোধ কর্মসূচি শুরু করেন।
জানা গেছে, ক্যাম্পাস থেকে মিছিল নিয়ে ফুলবাড়ীগেটে অবস্থান নিয়ে যশোর-খুলনা মহাসড়ক এবং খুলনার সাথে সমগ্র বাংলাদেশের রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। এ সময় তারা ট্রেন আটকে রেখে বিক্ষোভ করে। প্রায় ৩০ মিনিট পর তারা অবরোধ প্রত্যাহার করে ক্যাম্পাসে ফিরে আসে। বিক্ষোভে ‘সারা বাংলায় খবর দে, কোটা প্রথার কবর দে’, ‘আমরা ভাইকে হামলা কেন, ইন্টেরিম জবাব চাই’, ইন্টেরিম তুই কি চাস, ছাত্রদের রক্ত খাস’সহ নানা ধরনের স্লোগান দেয়।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন