দীর্ঘদিন ধরেই ক্ষুধা-দারিদ্র্যের মুখোমুখি গাজা উপত্যকাটিতে সংকট আরও ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। ফিলিস্তিনের গাজায় এক দিনে অনাহারে মারা গেছেন অন্তত ১০ জন। আলজাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অনাহারে মারা যাওয়া ছয় সপ্তাহ বয়সি ওই শিশুর নাম ইউসুফ আবু জাহির। দুধের অভাবে তার মৃত্যু হয়। শিশুটির চাচা আদহাম আল-সাফাদি রয়টার্সকে বলেন, ‘বাজারে কোথাও দুধ নেই, আর পাওয়া গেলেও একটি ছোট টিনের কৌটার দাম ১০০ ডলার পর্যন্ত।’
গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনে ২৪ ঘণ্টায় আরও ৬৪ জনের মৃত্যু দেখল ফিলিস্তিনিরা। এর মধ্যে ১৩ জন নিহত হয়েছেন ত্রাণ নিতে গিয়ে হামলার শিকার হয়ে। এ ছাড়া উপত্যকার জনপ্রিয় একটি বাজারে ইসরায়েলি হামলায় প্রাণ গেছে পাঁচজনের। অনাহারে মৃত্যু হয়েছে আরও তিনজনের। মূলত গাজায় ইসরায়েলের অভিযান আরও তীব্র হয়েছে এবং গাজা নগরীতে হত্যাযজ্ঞ ও বাস্তুচ্যুতি বৃদ্ধি পেয়েছে। গতকাল বুধবার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ইসরায়েলি সেনারা গাজার সবচেয়ে বড় শহর গাজা নগরীতে আরও গভীরভাবে ঢুকে পড়েছে। পুরো মহল্লা-মহল্লা ধ্বংস করে ফেলা হচ্ছে, ফলে ফিলিস্তিনি পরিবারগুলোর আর কোথাও আশ্রয় নেওয়ার সুযোগ থাকছে না। এর মধ্যেই ইসরায়েলি অবরোধ সৃষ্ট দুর্ভিক্ষ ভয়াবহ আকার নিয়েছে।
আলজাজিরার যাচাইকৃত ভিডিওতে দেখা যায়, ইসরায়েলি হামলার মুখে উত্তর গাজার আস-সাফতাওয়ি এলাকা থেকে মানুষ পালাচ্ছে। প্রায় ১০ লাখ মানুষকে দক্ষিণ গাজার দিকে যেতে বাধ্য করছে ইসরায়েল। ছবিগুলোয় দেখা যায়, ধ্বংসস্তূপে ভরা ধুলোমাখা রাস্তায় লম্বা সারি বেঁধে হাঁটছে নারী-পুরুষ-শিশুরা। কারো হাতে ব্যাগ, কম্বল, খাটিয়া, কেউ ঠেলাগাড়িতে বোঝাই করে নিয়ে যাচ্ছে সামান্য জিনিসপত্র, আবার কেউ ছোট বাচ্চাদের হাত ধরে হাঁটছে।
প্যালেস্টাইনি সিভিল ডিফেন্সের হিসাব অনুযায়ী, গত ৬ আগস্ট থেকে শুরু হওয়া টানা অভিযানে গাজা নগরীর জায়তুন ও সাবরা এলাকায় এক হাজারের বেশি ভবন সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিয়েছে ইসরায়েল। প্রায় দুই বছর ধরে চলা যুদ্ধে এনিয়ে অনাহারে মোট মৃত্যু তিন শতাধিক। এর মধ্যে শিশু রয়েছে ১১৭ জন। এদিকে আন্তর্জাতিক চাপের মুখেও থামছে না গাজায় ইসরায়েলের বর্বরতা। গাজা সিটির আরও ভেতরে প্রবেশ করেছে জায়নবাদী সেনারা। হামলার তীব্রতায় ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাচ্ছেন ফিলিস্তিনিরা।
ফিলিস্তিনের গাজা ভূখ-ে ইসরায়েলি হামলা আরও জোরদার করা হয়েছে। সেই সঙ্গে রয়েছে সর্বাত্মক অবরোধ। ফলে মারাত্মক মানবিক সংকট সৃষ্টি হয়েছে ভূখন্ডটিতে।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বরাতে সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা জানায়, গত কয়েক মাস ধরে ত্রাণ আনতে গিয়ে প্রায় প্রতিদিনই প্রাণ যাচ্ছে ফিলিস্তিনিদের। গত ২৪ ঘণ্টায় অন্তত ১৩ জন নিহত হয়েছেন সাহায্যের আশায় লাইনে দাঁড়ানো অবস্থায়। গাজায় আমেরিকা ও ইসরায়েল-সমর্থিত সংস্থা জিএইচএফ চলতি বছরের মে মাসের শেষদিকে ত্রাণ বিতরণের দায়িত্ব নেয়। এরপর থেকে ত্রাণ সংগ্রহ করতে গিয়ে এখন পর্যন্ত ২ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া অনাহারে প্রাণ গেছে এ পর্যন্ত ৩০৩ জনের। এর মধ্যে ১১৭ জনই শিশু। জাতিসংঘের মানবিক দপ্তর (ওসিএইচএ) সবশেষ প্রতিবেদনে সতর্ক করে বলেছে, গাজা উপত্যকায় ক্ষুধা আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। হতাহতের সংখ্যা বাড়ছে এবং জরুরি সেবাগুলো ভেঙে পড়ছে।
এদিকে গত মঙ্গলবার ভোর থেকে ২৪ ঘণ্টায় ইসরায়েলি হামলায় অন্তত ৬৪ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এদিন দক্ষিণ গাজার নাসের হাসপাতালে ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় সাংবাদিক, চিকিৎসক ও রোগীসহ অন্তত ২০ জন নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে পাঁচজন সাংবাদিকও রয়েছেন। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা চালায় হামাস। ওইদিন ১ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হন, জিম্মি করা হয় অনেককে।
এর পর থেকে গাজায় হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েলি বাহিনী। হামলায় এখন পর্যন্ত ৬২ হাজার ৮০০ জনের বেশি ফিলিস্তিনি প্রাণ হারিয়েছেন। এ ছাড়া আহত ফিলিস্তিনির সংখ্যা দেড় লাখের বেশি। ফিলিস্তিনের গাজা নগরে দুর্ভিক্ষ চলছে বলে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দিয়েছে জাতিসংঘ-সমর্থিত খাদ্যনিরাপত্তা পর্যবেক্ষণ সংস্থা ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্লাসিফিকেশন (আইপিসি)। আইপিসির প্রকাশিত সর্বশেষ হালনাগাদ প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে আসে।
মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসে এটি প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃত দুর্ভিক্ষ, যেখানে গাজার প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ ভয়াবহ খাদ্যসংকটে ভুগছে। আইপিসির তথ্য অনুযায়ী, পরিস্থিতি এতটাই গুরুতর, গাজা নগর বর্তমানে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার সর্বোচ্চ স্তরে আইপিসি ধাপ ৫-এ রয়েছে। জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা প্রধান টম ফ্লেচার বলেছেন, ‘এই দুর্ভিক্ষ পুরোপুরি প্রতিরোধযোগ্য ছিল। কিন্তু ইসরায়েলের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বাধার কারণে গাজায় খাদ্যসামগ্রী প্রবেশ করানো যায়নি।’ অন্যদিকে, ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ প্রতিবেদনকে ‘মিথ্যা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলে উড়িয়ে দিয়েছে। তারা দাবি করেছে, গাজায় কোনো দুর্ভিক্ষ নেই এবং প্রতিবেদনটি ‘হামাসের প্রচারিত ভুল তথ্যের ওপর ভিত্তি করে তৈরি’।
আইপিসি বলছে, দীর্ঘমেয়াদি সংঘাত, নিষেধাজ্ঞা, অবরোধ এবং ত্রাণ সরবরাহ বন্ধ থাকার কারণে গাজা উপত্যকার মানবিক পরিস্থিতি চরমভাবে অবনতি ঘটেছে। মার্চের শুরুতে ইসরায়েল কর্তৃক ত্রাণ সরবরাহ সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দেওয়ার ফলে খাদ্য, ওষুধ ও জ্বালানির তীব্র সংকট তৈরি হয়। মে মাসে সীমিত সহায়তা প্রবেশ করলেও তা চাহিদার তুলনায় অত্যন্ত অপ্রতুল।প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, আগামী সেপ্টেম্বরের শেষ নাগাদ গাজার আরও দুটি বড় অঞ্চল দেইর আল-বালাহ ও খান ইউনিসে দুর্ভিক্ষ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। তখন দুর্ভিক্ষে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ৬ লাখ ৪১ হাজারে পৌঁছাতে পারে, যা গাজার মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন