এমএসএফ প্রতিবেদন:
- ৪৯টি সহিংসতার ঘটনায় ৫৪৯ জন আহত, নিহত ২
- নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৯৬ সাংবাদিক
- এক মাসে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ৩৪৯টি
দেশে মব সন্ত্রাস বা গণপিটুনিতে হত্যার সংখ্যা উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে চলেছে। চলতি সময়ে মব সহিংসতা কিছুটা কমলেও নিহতের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। এতে জনমনে নিরাপত্তা বোধের বিষয়টি প্রশ্নাতীতভাবে ভাবিয়ে তুলেছে বলে দাবি করছে মানবাধিকার সংগঠন মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ)। সংস্থাটির গত আগস্ট মাসের প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত মাসে অন্তত ৩৮টি গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে। এতে ২৩ জন নিহত ও ৪৩ জন গুরুতর আহত হয়েছেন। জুলাই মাসে এমন ঘটনায় নিহত হয়েছিলেন ১৬ জন।
গতকাল রোববার এমএসএফ গণমাধ্যমে পাঠানো এ প্রতিবেদনে দেখা যায়, গণপিটুনিতে নিহতের মধ্যে ১০ জনকে চুরির অভিযোগে, ৪ জনকে সন্দেহজনক চুরির অভিযোগে, ৩ জনকে ডাকাতির অভিযোগে, ১ জন নারীসহ ২ জন পূর্বশত্রুতার জেরে, ১ জন মাদক মামলায় অভিযুক্ত, ২ জন ছিনতাইয়ের অভিযোগে, ১ জনকে চাঁদাবাজির অভিযোগে হত্যা করা হয়। অপরদিকে ১০ জনকে ডাকাতির অভিযোগে, ৭ জনকে চুরির অভিযোগে, ১ জনকে বোমা বিস্ফোরণে, ২ জনকে ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগে, ১ জনকে যৌন হয়রানির অভিযোগে, ৪ জনকে ছিনতাইয়ের অভিযোগে, ৮ জনকে নিষিদ্ধ লীগের নেতাকর্মী হওয়ার অভিযোগে এবং সন্দেহজনক চুরি, চাঁদাবাজি, কটূক্তি, প্রতারণা, অপহরণÑ এ ধরনের অপরাধজনিত কারণে আরও ৯ জনকে গণপিটুনিতে গুরুতর আহত করা হয়।
সংস্থাটি দাবি করেছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তার ফলে একশ্রেণির স্বার্থান্বেষী বিভিন্ন নাম ব্যবহার করে আইন নিজেদের হাতে তুলে নিচ্ছে। এতে সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপস্থিতিতে মব সহিংসতা বা গণপিটুনির ঘটনা ঘটে চলেছে।
এমএসএফের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, আগস্ট মাসে গণপিটুনির যত ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে, বাস্তবে তার চেয়ে অনেক বেশি ঘটনা ঘটেছে। এখন ভয়ে কেউ মুখও খুলতে চান না। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটেছে। এভাবে গণপিটুনির সংখ্যা বেড়ে যাওয়া তার একটি প্রমাণ।
রাজনৈতিক সহিংসতা: আগস্ট মাসে রাজনৈতিক সহিংসতার ৪৯টি ঘটনায় শিকার হয়েছেন ৫৪৯ জন। তাদের মধ্যে দুজন নিহত এবং ৫৪৭ জন আহত হয়েছেন। আহত ব্যক্তিদের মধ্যে ৪ জন গুলিবিদ্ধ এবং নিহত ব্যক্তিরা বিএনপির কর্মী-সমর্থক। সহিংসতার ৪৯টি ঘটনার মধ্যে ১১টি ঘটনায় রাজনৈতিক বিরোধ এবং সহিংসতাকে কেন্দ্র করে পার্টি অফিস, বসতবাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা ও অগ্নিকা- এবং ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। তবে এসব ঘটনায় হতাহতের কোনো খবর পাওয়া যায়নি।
সহিংসতার ৩৮টি ঘটনার মধ্যে বিএনপির অন্তর্দ্বন্দ্বে ২৩টি, বিএনপি-আওয়ামী লীগের সংঘর্ষে ৫টি, এনসিপি-আওয়ামী লীগ দ্বন্দ্বে ২টি, বিএনপি-এনসিপি দ্বন্দ্বে ১টি, বিএনপি-জামায়াত সংঘর্ষে ২টি, আওয়ামী লীগ-জামায়াত সংঘর্ষে ১টি, আওয়ামী লীগ-গণপরিষদ ১টি, জাতীয় পার্টি ও গণঅধিকার পরিষদের সংঘর্ষের ২টি, গণঅধিকার পরিষদ-পুলিশের ১টি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে।
সাংবাদিক নির্যাতন: আগস্ট মাসে দেশের বিভিন্ন জেলায় পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় ৩৩টি ঘটনায় ৯৬ সাংবাদিক নানাভাবে হামলা, আইনি হয়রানি, হুমকি, হত্যা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। আক্রান্ত সাংবাদিকদের সংখ্যা জুলাই মাসের তুলনায় প্রায় তিন গুণ। আর নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে জুলাইয়ের প্রায় দ্বিগুণ।
এমএসএফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগস্ট মাসে আক্রান্ত সাংবাদিকদের মধ্যে একজনকে হত্যা, ৩৬ জন সাংবাদিক আইনি হয়রানির শিকার হয়েছেন, যাদের মধ্যে একজন সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ২৩ জন সাংবাদিক তাদের পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় আহত ও হামলার শিকার হয়েছেন। লাঞ্ছিত এবং হুমকির শিকার হয়েছেন ১৬ জন সাংবাদিক এবং ২০ জন সাংবাদিককে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলাগুলোর মধ্যে রয়েছে হত্যা, চাঁদাবাজি এবং মানহানির মামলা।
জুলাই মাসে সাংবাদিকদের ওপর ১৯টি নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছিল। আর সেসব ঘটনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন ৩০ জন।
আগস্ট মাসের ৩৩টি সাংবাদিক নির্যাতনসংক্রান্ত ঘটনায় ৭টি বিএনপি, ৬টিতে পুলিশ, ৩টি ঘটনায় শিক্ষক, ৫টি ঘটনায় সন্ত্রাসী বাহিনী, দুটিতে চোরাকারবারি, একটি ঘটনায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে মামলার শিকার, একটিতে এনজিও, একটিতে পেশকার, চারটিতে দুষ্কৃতকারী, একটিতে পত্রিকা অফিস এবং দুটিতে সাময়িক কার্যক্রম নিষিদ্ধ সংগঠন আওয়ামী লীগের সংশ্লিষ্টতা ছিল।
কারা হেফাজতে মৃত্যু: আগস্ট মাসে কারা হেফাজতে মৃত্যু কমেনি। এমএসএফের তথ্য অনুযায়ী আগস্টে কারা হেফাজতে মোট ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। গত মাসে এর সংখ্যা ছিল মোট ১০। এ মাসে ৩ জন কয়েদি ও ৭ জন হাজতির মৃত্যু হয়েছে।
নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা: এমএসএফের তথ্য অনুযায়ী, আগস্ট মাসে ৩৪৯টি নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা সংঘটিত হয়েছে, যা গত মাসের তুলনায় ৩টি কম। এ মাসে ধর্ষণের ঘটনা ৪৭টি, সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ১৯টি, ধর্ষণ ও হত্যা ৪টি। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৯ জন প্রতিবন্ধী কিশোরী ও নারী।
ধর্ষণের শিকার ৪৭ জনের মধ্যে ১১ জন শিশু, ১৭ জন কিশোরী রয়েছে, অন্যদিকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৬ জন কিশোরী ও ৯ জন নারী এবং ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হয়েছেন ২ জন শিশু ও ১ জন কিশোরী। ধর্ষণের চেষ্টা ২৪টি, যৌন হয়রানি ২১টি, শারীরিক নির্যাতনের ৯৪টি ঘটনা ঘটেছে।
সংখ্যালঘু নির্যাতন:
এমএসএফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সংখ্যালঘুদের জীবনমান, সহাবস্থান, ধর্মীয় স্বাধীনতা ও নিরাপত্তায় সরকার ও প্রশাসনের দ্রুত ও নিরপেক্ষ পদক্ষেপের অভাবে তাদের ওপর সহিংসতার ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে, যা সংবিধানের মৌলিক অধিকার ও রাষ্ট্রের মূলনীতির পরিপন্থি।
এমএসএফের তথ্য অনুযায়ী, আগস্টে বিভিন্ন পর্যায়ে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু নির্যাতনের ১০টি ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনার মধ্যে রয়েছে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট ২টি, ধর্ষণের ১টি, জমি দখলের ঘটনা ১টি, ১টি গুজব এবং ৩টি ঘটনায় কটূক্তির অভিযোগে ৩ জন যুবককে গ্রেপ্তার করা হয়। অপরদিকে পরিকল্পনাবিহীন দেয়াল নির্মাণে জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বসতঘর ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা এবং জমি দখলের ঘটনা ঘটেছে।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন