আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে রাজনীতির মাঠে নিজেদের শক্ত অবস্থান জানান দিতে কৌশলী হচ্ছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। দলটি এরই মধ্যে ৩০০ আসনে প্রার্থী চূড়ান্তের মাধ্যমে নিজ নিজ এলাকায় তাদের সক্রিয় থাকার নির্দেশও দিয়েছে। এ ছাড়া উপজেলা থেকে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের জন্যও অনেক স্থানে তারা প্রার্থী বাছাই করে রেখেছে বলে জানা গেছে। গত ৫ আগস্টের পর থেকেই মূলত নির্বাচন নিয়ে জামায়াত প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে বলে জানান দলটির নেতারা। এদিকে নির্বাচন ঘনিয়ে এলেও পিআরসহ বিভিন্ন ইস্যুতে যুগপৎ আন্দোলনে মাঠে রয়েছে জামায়াতসহ সাতটি রাজনৈতিক দল। সংসদীয় ভোটের বিষয়ে জামাতের শীর্ষ নেতারা দাবি করছেন, সম্প্রতি ঢাবি-জাবির ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্রশিবিরের সাফল্যে তাদের আত্মবিশ্বাস বেড়েছে বহুগুণ। তাদের মতে, এই সাফল্য জাতীয় নির্বাচনেও প্রভাব রাখবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, জুলাই অভ্যুত্থানে পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিএনপির বিকল্প বৃহৎ শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে চেয়েছে জামায়াত। সেই লক্ষ্যে দ্রুত প্রার্থী চূড়ান্তের মধ্য দিয়ে সাংগঠনিকভাবে দলকে শক্তিশালী করা হয়েছে। গত এক বছর ধরে তাদের দেশব্যাপী কর্মী সম্মেলন, সভা-সমাবেশ এবং অন্যান্য কর্মসূচির মাধ্যমে তারা নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। পাশাপাশি চেষ্টা করছে বৃহত্তর রাজনৈতিক জোট গঠনের। সম্প্রতি পিআরসহ বেশ কিছু দাবিতে জামায়াতের পাশাপাশি রাজপথে আন্দোলন করছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ নেজাম ইসলাম পার্টি, খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন ও জাগবা। এ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তাদের সম্মিলিত জোটের সম্ভবনা রয়েছে বলে মনে করেন তারা। জামায়াত-এনসিপি জোট হচ্ছে এমন গুঞ্জন ছিল। যদিও এনসিপি জানিয়েছে, এই যুগপৎ আন্দোলনে জামায়াতের সঙ্গে নেই। তবে অধিকাংশ দাবির সঙ্গে তারা একমত। এবি পার্টি এবং গণঅধিকার পরিষদও জামায়াতের পাঁচ দফা দাবির সঙ্গে একমত হলেও যুগপৎ কর্মসূচিতে থাকছে না। ফলে জামায়াতের বৃহত্তর ঐক্য শেষ পর্যন্ত কতটা বড় হবে, সে বিষয়ে এখনো ধোঁয়াশা রয়েছে বলেই মনে করছেন তারা।
জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান এক আলোচনা সভায় বলেন, জামায়াত অফিসিয়ালি প্রার্থী ঘোষণা করেনি। এটি কেবল প্রাথমিক নির্বাচনি প্রস্তুতি। সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি হলে চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হবে। নির্বাচন হতে হলে আগে মৌলিক কিছু সংস্কার জরুরি। তা না হলে এটি হবে নির্বাচন গণহত্যার শামিল।
জাতীয় নির্বাচন ঘিরে প্রস্তুতি এবং বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘সম্প্রতি ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনে শিক্ষার্থীরা নীরব ব্যালট বিপ্লব ঘটিয়েছেন, যার মধ্য দিয়ে লেজুড়বৃত্তিক, সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজদের শোচনীয় পরাজয় হয়েছে। এর মাধ্যমে প্রমাণিত, জনগণ পুরোনো শাসনব্যবস্থায় আর ফিরতে চায় না। জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। তা না হলে এই সংবিধানের আলোকে যে নির্বাচন হবে, তাতে যে-ই ক্ষমতায় আসুক, স্বৈরাচার হয়ে ওঠার ঝুঁকি থেকে যাবে। নির্ধারিত সময়ের আগেই সংবিধান সংশোধন করে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন দিতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘জনগণের ওপর জুলুম-নির্যাতন করে, দাম্ভিকতা দেখিয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকা যায় না। যারা নিকট অতীতে জনগণের ওপর জুলুম-নির্যাতন করেছিল, ভেবেছিল আজীবন ক্ষমতায় টিকে থাকবে, জনগণ তাদের দেশছাড়া করেছে। আগামীতে যদি কেউ ক্ষমতায় এসে অতীতের মতো জুলুম-নির্যাতন-নিপীড়ন চালাতে চায়, তাহলে জনগণ তাদেরও দেশছাড়া করবে।’
জুলাই সনদের বিষয়ে মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, ‘সুষ্ঠু, স্বচ্ছ গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের ঘোষিত সময়ের আগেই ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় সব গণতান্ত্রিক দল যে যে বিষয়ে একমত হয়েছে, সেগুলো লিখিতভাবে প্রকাশ করতে হবে। অন্যথায় মৌখিক স্বীকৃতির জুলাই সনদ এ দেশের জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না।’ জামায়াতে ইসলামীর বৃহৎ ঐক্যের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ইসলামি ও দেশপ্রেমিক সমমনা সব রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে একটি বৃহৎ ঐক্যের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। জুলাই সনদের ভিত্তিতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে নতুন বাংলাদেশ গড়তে হবে। সেই বাংলাদেশ হবে সাম্যের, ন্যায়ের, ইনসাফের ও ঐক্যের।’ তিনি বলেন, নতুন বাংলাদেশে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানসহ সব ধর্মের মানুষই ন্যায্যতার ভিত্তিতে রাষ্ট্রের সমান অধিকার ভোগ করবে।
জনগণ ইসলামী শক্তিকে বিজয়ী দেখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধÑ এমন প্রত্যাশা ব্যক্ত করে ঢাকা মহানগর উত্তরের আমির মোহাম্মদ সেলিম উদ্দিন বলেন, জনগণ আগামীতে যে কোনো নির্বাচনে ইসলামী শক্তিকে বিজয়ী দেখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এ দেশের মানুষ আর কোনো চাঁদাবাজ, টেন্ডারবাজ, দুর্নীতিবাজ ও ভোটচোরদের ক্ষমতায় দেখতে চায় না। সদ্য সমাপ্ত ছাত্র সংসদ নির্বাচনে নতুন প্রজন্মের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ থেকে স্পষ্ট হওয়া গেছে। পিআর পদ্ধতি বিষয়ে জামায়াতের এই নেতা বলেন, রাষ্ট্রের কার্যকর সংস্কারের সঙ্গে জুলাই গণহত্যাকারীদের বিচার দৃশ্যমান হতে হবে। একই সঙ্গে প্রচলিত পদ্ধতির পরিবর্তে পিআর পদ্ধতিতেই নির্বাচন হতে হবে।
সরকারের পক্ষ থেকে স্পষ্ট করা হয়েছে, আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। দাবি মেনেই যথা সময়ে নির্বাচন সম্ভব মনে করেন যুগপৎ আন্দোলনকারীরা। জামায়াতসহ দলগুলো মনে করছে, সরকার ইচ্ছা করলে দাবি পূরণ করেই ফেব্রুয়ারির মধ্যেই নির্বাচন সম্ভব। তবে বিএনপি পুরো বিষয়টি ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখছে। বিএনপি মনে করে, এসব দাবির নেপথ্যে ফেব্রুয়ারির নির্বাচন পেছানো মূল উদ্দেশ্য।
চলমান পিআর পদ্ধতির পক্ষেও দুই ভাগ দেখা যাচ্ছে। উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের বিষয়ে প্রায় সব দলই মোটামুটি একমত। তবে দুই কক্ষেই পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের বিষয়ে ঐকমত্য নেই। যারা আন্দোলনে যাচ্ছেন, তারা জুলাই সনদের বাস্তবায়ন করে তার ভিত্তিতে নির্বাচন ও জাতীয় সংসদের উভয় কক্ষের নির্বাচন পিআর পদ্ধতিতে জোর দিচ্ছেন। চলমান আন্দোলনের বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ জানিয়েছেন, পাঁচ দফা দাবিতে জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের যুগপৎ আন্দোলন কর্মসূচির জবাব রাজপথেই দেবে বিএনপি।
এদিকে, নির্বাচন ও সংস্কার ইস্যুতে জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মধ্যে ঐকমত্য দেখা গিয়েছিল। তবে সম্প্রতি দুটি দলের মধ্যে একধরনের টানাপোড়েন বা দূরত্ব স্পষ্ট হলো যুগপথের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ও পিআর পদ্ধতিতে সংসদ নির্বাচনসহ বিভিন্ন দাবিতে জামায়াত-এনসিপি-খেলাফত-ইসলামী আন্দোলনসহ আটটি দলের যুগপৎ আন্দোলনের কথা থাকলেও নেই এনসিপি।
বৃহৎ ঐক্যে গড়তে গত জানুয়ারিতে বরিশালের চরমোনাইয়ে ইসলামী আন্দোলনের আমির সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীমের সঙ্গে জামায়াতের আমিরের বৈঠক হয়। এ ছাড়া খেলাফত মজলিসের কার্যালয়ে জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলনের নেতাদের মধ্যে বৈঠক হয়। জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল খেলাফত মজলিসের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় মিলিত হন। জামায়াতের এক কেন্দ্রীয় নেতা জানান, শুধু ইসলামি দল নয়, অন্যান্য বিরোধী রাজনৈতিক দলের সঙ্গেও আলোচনা চলছে। পরিস্থিতি বুঝে নির্বাচনি জোট গঠন করা হবে। বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় কে কার সঙ্গে থাকবে, তা পুরোপুরি নির্ভর করছে সামনের দিনগুলোর রাজনৈতিক সমীকরণের ওপর।
নির্বাচনের প্রস্তুতি ও বিভিন্ন বিষয়ে জামায়াতের অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা মুহাম্মদ শাহজাহান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, কিছু মহল থেকে জামায়াতের বিরুদ্ধে নির্বাচন পেছানোর অভিযোগ করছে। আমরা দৃঢ়ভাবে বলতে চাই, জামায়াত সবার আগেই ৩০০ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করে কাজ শুরু করে দিয়েছে, কিন্তু অন্যদের ক্ষেত্রে দৃশ্যমান কোনো নির্বাচনি কার্যক্রম চোখে পড়ে না। যারা জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি ও প্রয়োজনীয় সংস্কারে বাধা দিচ্ছে এবং পিআর পদ্ধতির নির্বাচনের বিরোধিতা করছে, নিজেদের ভরাডুবি জেনে তারাই মূলত ফেব্রুয়ারির নির্বাচন পেছাতে চায়।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন