বুধবার, ১৫ অক্টোবর, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


মাহতাব মুহাম্মদ, গবেষক ও কলামিস্ট

প্রকাশিত: অক্টোবর ১৫, ২০২৫, ০১:২৮ এএম

স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনে ২০ দফার কার্যকারিতা কতটুকু?

মাহতাব মুহাম্মদ, গবেষক ও কলামিস্ট

প্রকাশিত: অক্টোবর ১৫, ২০২৫, ০১:২৮ এএম

স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনে ২০ দফার কার্যকারিতা কতটুকু?

গাজা যুদ্ধ বন্ধে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০ দফার শান্তি প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন। এ প্রস্তাবে হামাস ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে। ইতোমধ্যে শান্তি পরিকল্পনার প্রথম পর্যায়ের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। ট্রাম্পের প্রস্তাবিত ২০ দফা ও শান্তি পরিকল্পনার প্রথম পর্যায়ের চুক্তি স্বাক্ষরকে স্বাগত জানিয়েছে মুসলিম দেশসহ বিভিন্ন রাষ্ট্র। হামাসের ইতিবাচক সাড়া দেওয়ার পর ডোনাল্ড ট্রাম্প নেতানিয়াহুকে গাজায় হামলা না করার আহ্বান জানিয়েছিলেন।

তবে এই আহ্বানের পরও ইসরায়েল হামলা চালিয়ে গেছে এবং শত শত ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে। এদিকে অনেকেই ট্রাম্পের ২০ দফার আসল উদ্দেশ্য ও কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন ও স্থায়ী শান্তি নিশ্চিতে ২০ দফা কতটা ভূমিকা রাখবে? কিংবা আদৌ ভূমিকা রাখবে কিনা? বিশ্লেষণ অনুযায়ী উত্তরটি মোটেই সুখকর নয়। শান্তি পরিকল্পনার দফা‑৯ এ বলা হয়েছে, অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত একটি অন্তর্বর্তী সরকার গাজা পরিচালনা করবে। এ লক্ষ্যে ‘বোর্ড অব পিস’ নামে একটি আন্তর্জাতিক কমিটি গঠন করা হবে, যার প্রধান হবেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারও এই কমিটিতে থাকবেন।

যতদিন না পর্যন্ত ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের সংস্কার শেষ হয় এবং গাজার নিয়ন্ত্রণ যথাযথভাবে নিতে না পারে, ততদিন পর্যন্ত এই কমিটি গাজা পুনর্গঠনের তহবিল পরিচালনা, কার্যকর শাসনব্যবস্থা তৈরি ও বিনিয়োগে কাজ করে যাবে। পরিকল্পনাটি চমকপ্রদ মনে হলেও বাস্তবতা ভিন্ন। প্রশ্ন ওঠে, ‘ইরাক যুদ্ধের কসাইখ্যাত’ টনি ব্লেয়ারকে শান্তি কমিটিতে রেখে গাজায় কতটা শান্তি নিশ্চিত করা যাবে? তিনি ২০০৩ সালে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন বন্ধু জর্জ ডব্লিউ বুশের সঙ্গে জোট বেঁধে ইরাকে হামলা করে লাখ লাখ লোক হত্যায় শামিল হয়েছিলেন। মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত টনি ব্লেয়ার ইসরায়েল ও আমেরিকার অতি ঘনিষ্ঠ; তিনি নেতানিয়াহুর ইচ্ছার বাইরে ও আমেরিকার ইচ্ছার বিপরীতে কোন কাজ করবেনÑ এটা অবাস্তব। ফলে তার কার্যকলাপ কখনোই সন্দেহের ঊর্ধ্বে থাকবে না।

টনি ব্লেয়ার সম্পর্কে আল জাজিরার কলামিস্ট বেলেন ফার্নান্দেজ তার এক কলামে মন্তব্য করেছেন, টনি ব্লেয়ার মানবতাবিরোধী অপরাধী থেকে পরামর্শক বনে গেছেন। তিনি যেখানে যান, টাকাকড়ির সুবিধা দুহাত ভরে নেন। বেলেন ফার্নান্দেজ আরও বলেন, টনি ব্লেয়ারের মতো লোক পিস বোর্ডে থাকতে পারে না। এই লোক যদি গাজা শাসনের কমিটিতে থাকেন, গাজায় বিনিয়োগের ছদ্মবেশে আধুনিক ঔপনিবেশিকতা প্রবেশ করবে। এদিকে গণহত্যাকারী নেতানিয়াহুর আরেক সহযোগী জো বাইডেনের নিকট হতে ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই প্রতিনিয়ত গাজায় গণহত্যা চালানোর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদত দিয়ে গেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। সেই তিনিই হবেন বোর্ড অব পিসের প্রধান। ফলে যতই শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হোক, দিনশেষে ফিলিস্তিনে কতখানি দীর্ঘস্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে, তা নিয়ে সংশয় থেকে যায়। প্রাসঙ্গিকভাবে প্রশ্ন ওঠে, ডোনাল্ড ট্রাম্প কেন হঠাৎ গাজা যুদ্ধ বন্ধে অতি তৎপর হলেন? আমার কাছে মনে হয়, এর কয়েকটি কারণ থাকতে পারে। প্রথমত, সুচতুর পরিকল্পনামাফিক গাজাকে হামাসমুক্ত করে ধীরে ধীরে দখল করে নেওয়া কিংবা কৌশলে দখল করে তা ইসরায়েলের নিকট হস্তান্তর করাÑ যা বহু বছর ধরে ইসরায়েল চাচ্ছে। দ্বিতীয়ত, ইসরায়েলি জিম্মিদের মুক্ত করা।

তৃতীয়ত, নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি। এসব কারণের কিছু প্রমাণও পাওয়া যায়। গত ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দে ট্রাম্প বলেছেন, ফিলিস্তিনিদের অন্যত্র সরিয়ে দিয়ে অর্থাৎ উচ্ছেদ করে যুক্তরাষ্ট্র গাজাকে দখল করে মালিকানা নেবে ও সেখানে অর্থনৈতিক উন্নয়নে কাজ করবে। এর আগেও ২৫ জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি জর্ডান ও মিসরকে ফিলিস্তিনিদের বেশি বেশি আশ্রয় দেওয়ার আহ্বান জানান। এভাবে ফিলিস্তিনিদের অন্যত্র সরিয়ে গাজা খালি করার কথা বলেন। তা ছাড়া বার্তা সংস্থা আনাদোলুর ৬ আগস্টের আরেক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ট্রাম্প এই ইঙ্গিতও দিয়েছিলেন যে, ইসরায়েল গাজার পুরোপুরি দখল নিলেও যুক্তরাষ্ট্র বাধা দেবে না। এদিকে নোবেলপ্রাপ্তির ব্যাপারে ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দে ট্রাম্প বলেই ফেলেছেন, তাকে নোবেল প্রাইজ না দেওয়া হলে তা হবে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অপমান।

এর আগেও তিনি বলেছেন, তিনি সাতটি যুদ্ধ থামিয়েছেন এবং প্রতিটি যুদ্ধ থামানোর বিনিময়ে তার আলাদা করে নোবেল পাওয়া উচিত। আর জিম্মি মুক্তির ব্যাপারটি তো প্রস্তাবের মধ্যেই আছে। বৃহস্পতিবার (৯ অক্টোবর, ২০২৫ খ্রি.) এক্সে (সাবেক টুইটার) ইসরায়েলের চরম ডানপন্থি অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিচ সব জিম্মিদের মুক্ত করার পর হামাসকে ধ্বংস করার হুমকি দিয়েছেন। এ থেকেই বোঝা যায়, শান্তি প্রস্তাবের অন্যতম লক্ষ্য কৌশলে ইসরায়েলি জিম্মিদের মুক্ত করা। সার্বিক বিবেচনায় আমার মনে হয়, ডোনাল্ড ট্রাম্পের ২০ দফা শান্তি পরিকল্পনা তার উপর্যুক্ত উদ্দেশ্যের প্রতিফলন। মুখে যতই মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি প্রতিষ্ঠার কথা বলা হোক, সেগুলো কেবল কথার কথা, ভেলকিবাজি। আদতে ট্রাম্পের ২০ দফা কি স্বাধীন ফিলিস্তিন গঠনে ভূমিকা রাখবে? উত্তরটি নেতিবাচক। শান্তি পরিকল্পনার ২০ দফার কোথাও স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের কথা বলা নেই।

নেতানিয়াহুও এটি স্পষ্ট করেছেন। ইসরায়েল স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা মেনে নেবে না; তারা চায় যেকোনো মূল্যে গাজাকে ইসরায়েলের সঙ্গে একীভূত করতে সেটা সামরিকভাবে হোক কিংবা কৌশলে। আপাতদৃষ্টিতে ট্রাম্পের ২০ দফা সেই কৌশলেরই অংশ বলে মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয়। একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনে জনসমষ্টি, নির্দিষ্ট ভূখ-, সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীন নিজস্ব সরকারের প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু দফা ২, ৭, ১০, ১১ অনুসারে, শান্তি পরিকল্পনা আচরণগতভাবে গাজার জীবনযাপন ও অবকাঠামো পুনর্গঠনের ওপর জোর দিচ্ছে। কিন্তু দফা‑৯ এ শাসন প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে একটি আন্তর্জাতিকভাবে নিয়ন্ত্রিত বোর্ডের কথা বলা হয়েছে। এর মানে হলো, স্থানীয় সার্বভৌমত্বকে সীমিত করে আন্তর্জাতিক তত্ত্বাবধানে গাজাকে পরিচালনা করা, যা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দিকে সরাসরি পদক্ষেপ গ্রহণ নয়; বরং এটি একটি ‘অন্তর্বর্তী ব্যবস্থাপনা’ যা অনির্দিষ্টকালের জন্য দীর্ঘায়িত হতে পারে এবং শেষপর্যায়ে গাজার সার্বভৌমত্ব অর্জনকে জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রতার দিকে নিয়ে যেতে পারে।

দফা‑১৬ বলছে, ইসরায়েল গাজা দখল বা একীভূত করবে না। কিন্তু একই সঙ্গে আরও বলা হয়েছে, আইএসএফের মাধ্যমে নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রণ ও সীমান্ত ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রিত হবে। সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ ও কাস্টমস বিভাগ রাষ্ট্রীয় স্বায়ত্তশাসনের অন্যতম মূল উপাদান; যদি তা বিদেশি বাহিনীর কার্যকর নিয়ন্ত্রণে থাকে, তখন পূর্ণ সার্বভৌমত্ব তৈরি হবে না। তবে দফা‑১৯ বলছে, যতদিন গাজা পুনর্গঠন ও ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের সংস্কার চলবে, ততদিন ফিলিস্তিনের স্বশাসন ও নিজেদের রাষ্ট্র গঠনের পথে শর্তগুলো বাস্তবায়নের কাজ চলবে।

কিন্তু সেই পুনর্গঠনের কাজ কবে নাগাদ শেষ হতে পারে তার কোনো সম্ভাব্য সময়সীমার উল্লেখ নেই। ফলে এই ২০ দফা স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের সরাসরি পথ নয়; বরং এটি গাজা পুনর্গঠন, সাময়িক নিরাপত্তা প্রদান ও আপাতত মানবিক স্থিতি ফিরিয়ে এনে ভবিষ্যতের জন্য গাজার ভাগ্য ঝুলিয়ে রাখবে। শান্তি পরিকল্পনার দফা‑১৩ স্পষ্ট করে বলে, হামাস ও অন্য কোনো সংগঠন কোনোভাবেই গাজা শাসনের অংশীদার হতে পারবে না; হামাসকে আত্মসমর্পণ করতে হবে। চাইলে হামাস সদস্যরা আত্মসমর্পণ করে দেশে থাকতে পারবে কিংবা অন্য কোনো দেশ নিতে চাইলে দেশত্যাগ করতে পারবে। গাজাকে পুরোপুরি নিরস্ত্রীকরণ করতে হবে এবং সকল টানেল ও অস্ত্রকারখানা ধ্বংস করতে হবে।

এই শর্তগুলো বাস্তবায়িত হলে গাজায় ‘মুক্তিযোদ্ধা’ কিংবা ‘প্রতিরোধ যোদ্ধা’ বলতে আর কেউ অবশিষ্ট থাকবে না, যা ইসরায়েলের বহুদিনকার দাবি। পরবর্তীকালে  শান্তি পরিকল্পনা ভেস্তে গেলে ইসরায়েল চোখের পলকে গাজা দখল করে নিতে পারবে। তখন প্রতিরোধ করার মতো শক্তি, সরঞ্জাম ও লোকবল গাজাবাসীর থাকবে না। ডোনাল্ড ট্রাম্প তো একবার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে, ইসরায়েল গাজা দখল করলে যুক্তরাষ্ট্র কিছু বলবে না। আপাতদৃষ্টিতে শান্তি পরিকল্পনার এই দফা ইসরায়েলের দখলদারিত্বের পথকে ভবিষ্যতের জন্য নির্বিঘœ করবে। হামাস জানিয়েছে, তারা শান্তি পরিকল্পনাকে স্বাগত জানায় এবং ইতোমধ্যে তারা শান্তি পরিকল্পনার প্রথম ধাপের চুক্তিতে সম্মতও হয়েছে। তবে হামাসের সাংগঠনিক বিলুপ্তিসহ পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণ প্রক্রিয়া, গাজা পুনর্গঠনে হামাসের কোনো অংশগ্রহণ না থাকা, বোর্ড অব পিসের নামে ফিলিস্তিন ও মুসলিম বিশ্বের বাহিরে অন্য কোনো বহিঃশক্তির শাসনকে মেনে নেওয়ার প্রশ্নে হামাসের অবস্থানের ওপর নির্ভর করছে ফিলিস্তিনের ভবিষ্যৎ ভাগ্য।

এদিকে গাজায় ব্যাপক জনসমর্থন থাকা হামাসকে ফিলিস্তিন পুনর্গঠনের বাইরে রেখে শান্তি পরিকল্পনা কতটুকু সফল হবে, তা নিয়েও সংশয় থেকে যায়। প্রকৃতপক্ষে, স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন ব্যতীত কোনো শান্তি পরিকল্পনাই ফিলিস্তিনে স্থায়ীভাবে শান্তি নিশ্চিত করতে পারবে না। যতই শান্তিচুক্তি হোক, ইসরায়েল সেই চুক্তি ভঙ্গ করবে না, তার কোনো গ্যারান্টি নেই। কারণ চুক্তি লঙ্ঘনের মতো কাজ ইসরায়েল এর আগে বহুবার করেছে।

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!