টানা দুই বছরেরও বেশি সময় কেটে গেছে স্কুল বন্ধ। বিপর্যস্ত গাজার জনজীবন। এই দীর্ঘ অন্ধকার শেষে গাজার শিশুদের জীবনে ফিরে এসেছে নতুন ভোরের আভা। যুদ্ধ, অবরোধ ও ধ্বংসস্তূপের মাঝে অবশেষে খুলে গেছে স্কুলের দরজা। শনিবার থেকে জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএ ঘোষণা করেছে, গাজার ৩ লাখেরও বেশি শিক্ষার্থী আবারও ক্লাসে ফিরেছে। এই খবর গাজাবাসীর কাছে যেন এক টুকরো আশার আলো; যেখানে মৃত্যু, ক্ষুধা আর ধ্বংসের ভেতরেও শিক্ষার প্রতি টান ফিকে হয়ে যায়নি।
ইসরায়েলের অব্যাহত আগ্রাসনে বিপর্যস্ত গাজার জনজীবন এখন ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। অবশেষে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরিকল্পনা অনুযায়ী যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর শিশুদের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে স্কুলের দরজা। জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএ জানিয়েছে, শনিবার থেকে গাজার ৩ লাখ ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থী আবারও ক্লাসে যাওয়া শুরু করেছে। যদিও ইসরায়েলের অবরোধের কারণে এই অঞ্চলে সাহায্য ঢুকতে পারছে না। টানা দুই বছর ইসরায়েলের আগ্রাসনে গাজাবাসীদের জীবনযাত্রা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। নজিরবিহীন, নিরবচ্ছিন্ন হামলার মুখে শিশুদের স্কুলে যাওয়ার মতো নিত্যদিনের কাজও অনেক ঝামেলাপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। ইউএনআরডব্লিউএর মিডিয়া উপদেষ্টা আদনান আবু হাসনা জানান, এজেন্সিটি ৩ লাখ ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থীর জন্য শিক্ষার প্রক্রিয়া পুনরায় শুরুর জন্য পরিকল্পনা করেছে এবং তিনি আরও বলেন, এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। প্রায় ১০ হাজার শিক্ষার্থী সরাসরি স্কুল ও শেল্টারে উপস্থিত হয়ে ক্লাসে অংশ নেবে।
বাকি শিক্ষার্থীরা দূরশিক্ষণ পাবে। আবু হাসনা বলেন, আট হাজার শিক্ষক এই প্রোগ্রামে অংশ নেবেন। দুই বছরের স্কুল ছুটির পর স্কুলে ফিরতে কিছুতেই দেরি করা যাবে না। যুদ্ধের আগেও ছিল করোনা মহামারি। গাজায় ৮ অক্টোবর ২০২৩ থেকে ইসরায়েলের আক্রমণ শুরুর পর থেকে শিক্ষা কার্যক্রম স্থগিত ছিল। অনেক স্কুল ধ্বংস হয়ে গেছে অথবা তা শরণার্থী শিবিরে পরিণত হয়েছে। ফিলিস্তিনের শিক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ইসরায়েল ১৭২টি সরকারি স্কুল ধ্বংস করেছে, ১১৮টি স্কুল ক্ষতিগ্রস্ত করেছে এবং ১০০টিরও বেশি ইউএনআরডব্লিউএর স্কুলে হামলা চালিয়েছে। মন্ত্রণালয় আরও জানায়, ১৭ হাজার ৭১১ শিক্ষার্থী নিহত হয়েছে এবং ২৫ হাজার ৮৯৭ জন আহত হয়েছে। পাশাপাশি ৭৬৩ জন শিক্ষাক্ষেত্রের কর্মীও মারা গেছেন। আবু হাসনা জানান, ইউএনআরডব্লিউএ গাজার ২২টি কেন্দ্রীয় ক্লিনিক পুনরায় চালুর পরিকল্পনা করেছে এবং খাদ্য বিতরণের জন্য কয়েক ডজন পয়েন্টে কর্মীদের নিয়োজিত রেখেছে। তবে তিনি বলেন, গুরুত্বপূর্ণ সরবরাহ গাজার বাইরে আটকে আছে।
তিনি বলেন, ‘বেসিক প্রয়োজনীয় দ্রব্য, যেমনÑ আশ্রয়ের উপকরণ, কম্বল, শীতকালীন পোশাক এবং ওষুধ ইসরায়েলি সীমান্ত দিয়ে গাজায় প্রবাহিত হতে দেওয়া হচ্ছে না, যা মানবিক পরিস্থিতি আরও খারাপ করছে। তিনি বলেন, গাজার ৯৫ শতাংশ জনসংখ্যা এখন মানবিক সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল ‘তিনি সতর্ক করেছেন, গাজার শহরে ফিরে আসা হাজার হাজার বাস্তুচুত্য মানুষ এখনো খোলা আকাশের নিচে বাস করছে। ইসরায়েলি আক্রমণ গাজায় প্রায় ৬৮ হাজার ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে, তাদের মধ্যে অধিকাংশই নারী ও শিশু। এতে অঞ্চলটি বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।
এদিকে ফিলিস্তিনের গাজায় চলমান যুদ্ধবিরতির মধ্যেও ইসরায়েলি বাহিনীর বিমান হামলা ও গুলিবর্ষণে অন্তত চারজন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। এ ঘটনায় হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধবিরতির ভবিষ্যৎ নিয়ে নতুন করে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। মঙ্গলবার (২১ অক্টোবর) এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা। ফিলিস্তিনি সিভিল ডিফেন্সের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, গাজা সিটির পূর্বাঞ্চলের আল-শাআফ এলাকায় দুটি পৃথক হামলায় চারজন নিহত হয়। নিহতরা নিজেদের ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িঘর দেখতে ফিরে আসার সময় ইসরায়েলি সেনাদের গুলিতে প্রাণ হারায়। তবে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর দাবি, তারা কিছু ‘যোদ্ধার’ দিকে গুলি চালিয়েছিল, যারা ‘হলুদ সীমারেখা’ অতিক্রম করে শুজাইয়ার দিকে অগ্রসর হচ্ছিল এবং সেনাদের জন্য হুমকি সৃষ্টি করেছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় গত ১০ অক্টোবর থেকে কার্যকর যুদ্ধবিরতির পরও গাজায় বারবার হামলা ও সহিংসতার ঘটনা ঘটছে। গাজা কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, এ পর্যন্ত অন্তত ৯৭ জন ফিলিস্তিনি এ সময়ে প্রাণ হারিয়েছে। শুধু গত রোববার ইসরায়েলি বিমান হামলায় নিহত হয় অন্তত ৪২ জন, যাদের মধ্যে বহু নারী ও শিশু রয়েছে। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর দাবি, রাফাহ এলাকায় হামাস যোদ্ধারা গুলি চালিয়ে তাদের দুই সেনাকে হত্যা করেছিল, যার প্রতিশোধেই এই হামলা চালানো হয়। তবে হামাস এই অভিযোগ অস্বীকার করে জানিয়েছে, রাফাহর ইসরায়েলি নিয়ন্ত্রিত অংশে তাদের কোনো ইউনিট সক্রিয় নেই। তারা অভিযোগ করেছে, ইসরায়েল ‘পুনরায় যুদ্ধ শুরু করার অজুহাত তৈরি করছে।’
অন্যদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সোমবার হামাসকে সতর্ক করে বলেছেন, গাজা চুক্তি লঙ্ঘন করলে হামাসকে ‘নির্মূল’ করা হবে। তবে তিনি বলেন, তিনি ফিলিস্তিনি গোষ্ঠীটিকে যুদ্ধবিরতি পালনের সুযোগ দেবেন। ওয়াশিংটন থেকে বার্তা সংস্থা এএফপি এ খবর জানায়। ট্রাম্পের মন্তব্যের পর ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স ইসরাইলে গেছেন, সপ্তাহের শেষে ভঙ্গুর যুদ্ধবিরতি ভেঙে ফেলার হুমকি দেওয়ার পর দুই শীর্ষ মার্কিন দূতের সঙ্গে যোগ দেন। অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি আলবানিজকে স্বাগত জানানোর সময় ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা হামাসের সঙ্গে একটি চুক্তি করেছি যে, তারা ভালো আচরণ করবে এবং পরিবর্তন হবে। ‘আর যদি তারা তা না করে, তাহলে আমরা যাব এবং প্রয়োজনে তাদের নির্মূল করব।
তাদের নির্মূল করা হবে এবং তারা এটা জানে।’ প্রায় দুই সপ্তাহ আগে ট্রাম্প গাজা চুক্তিতে মধ্যস্থতা করতে সাহায্য করেছিলেন, কিন্তু ইসরায়েল হামাসকে মৃত জিম্মিদের হস্তান্তরে বাধা দেওয়ার এবং হামলা চালানোর অভিযোগ আনায় এটি বারবার হুমকির মুখে পড়েছে। এদিকে হামাসের শীর্ষ আলোচক খলিল আল-হাইয়া মিশরের আল-কাহেরা নিউজকে বলেছেন, দলটি এখনো যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। মঙ্গলবার সকালে সম্প্রচারিত মন্তব্যে তিনি বলেন, ‘মৃতদেহগুলো উদ্ধার করা আমাদের জন্য অত্যন্ত কঠিন, তবে আমরা এ ব্যাপারে আন্তরিক এবং তাদের উদ্ধারের জন্য কঠোর পরিশ্রম করছি।’
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন