বুধবার, ০৫ নভেম্বর, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


আব্দুল আহাদ, সিলেট

প্রকাশিত: নভেম্বর ৫, ২০২৫, ০১:০৬ এএম

দালালে ভরা নির্বাচন অফিস টাকায় মেলে সেবা

আব্দুল আহাদ, সিলেট

প্রকাশিত: নভেম্বর ৫, ২০২৫, ০১:০৬ এএম

দালালে ভরা নির্বাচন অফিস  টাকায় মেলে সেবা

জাতীয় পরিচয়পত্র বা এনআইডি শুধু একটি কার্ড নয়, এটি নাগরিকত্বের প্রতীক, রাষ্ট্রীয় পরিচয়ের ভিত্তি। নাগরিক জীবনের অন্যতম অপরিহার্য দলিল। ব্যাংক হিসাব খোলা, জমি কেনাবেচা, পাসপোর্ট, ভোটার তালিকা, এমনকি চিকিৎস সেবার ক্ষেত্রেও এটি এখন অপরিহার্য। অথচ এই মৌলিক সেবা পেতেই মানুষকে পড়তে হচ্ছে দালালদের দৌরাত্ম্যের ফাঁদে।

সংশোধন, পুনঃপ্রদান কিংবা নতুন আবেদনÑ সব ক্ষেত্রেই সরকারি সেবাকেন্দ্র নির্বাচন অফিসে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বাড়ছে। বিশেষ করে বিদেশে থাকা প্রবাসীরা সীমিত সময় নিয়ে দেশে ফিরে পড়ছেন সবচেয়ে বড় বিপাকে। সময়মতো কাজ না হওয়ার ভয়, জটিল প্রক্রিয়া, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ধীরগতি ও অনিয়মÑ সব মিলিয়ে নির্বাচন অফিসের এক অচল প্রশাসনিক বাস্তবতায় গড়ে উঠেছে এক প্রভাবশালী দালালচক্র।

সিলেটের দক্ষিণ সুরমার মনোয়ারা খাতুন প্রায় চার দশক ধরে যুক্তরাজ্যে থাকেন। গত আগস্টে জমি ক্রয়-বিক্রয়ের নথি সম্পন্ন করতে তিনি ২৫ দিনের ছুটি নিয়ে দেশে ফেরেন। জমির কাগজপত্রে এনআইডির প্রয়োজন ছিল জরুরি ভিত্তিতে।

তিনি গেলেন সিলেট সদর উপজেলা নির্বাচন কমিশনের অফিসে। অফিসে উপস্থিত হয়ে জানতে পারেন, অনলাইনে আবেদন করে কপি নিয়ে আসতে হবে। অফিস থেকে বের হতেই ‘রানা’ নামে এক দালাল এগিয়ে এসে বলেন, ‘আপনার কাজ আমি করে দেব, না হলে মাসের পর মাস লেগে যাবে।’

মনোয়ারা প্রথমে রাজি হননি। পরক্ষণেই রানা বলেন, ‘ভেতরের লোকজনকে ম্যানেজ না করলে দ্রুত কার্ড পাবেন না।’ শেষ পর্যন্ত সময়ের চাপে মনোয়ারা রাজি হন।

‘আমি তো প্রবাসে থাকি, নিজে করতে জানি না। জমির কাজ শেষ করতে না পারলে বড় ক্ষতি হবে। তাই বাধ্য হয়েই ১০ হাজার টাকা দিয়েছি।’ বললেন মনোয়ারা খাতুন।

কাজটি কতটা দ্রুত হলো? মনোয়ারা জানালেন, ‘ওরা তিন দিনের মধ্যে প্রিন্ট কপি এনে দিল। কিন্তু আমি জানি না এটা অফিস থেকে কতটা নিয়মমাফিক হয়েছে।’ তার মতো অনেক প্রবাসীই সীমিত সময়ের কারণে এভাবে দালালদের খপ্পড়ে পড়তে বাধ্য হচ্ছেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, নির্বাচন কমিশন অফিসের এনআইডি অফিসের আশপাশে দালালদের একটি দৃশ্যমান নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে। এরা অফিসের বাইরে অবস্থান করলেও ভেতরের কিছু অসাধু কর্মচারীর সঙ্গে যোগাযোগ রেখে কাজ করে।

প্রক্রিয়া জটিল করে দিলে সাধারণ আবেদনকারী বিভ্রান্ত হন। তখন দালালেরা এগিয়ে এসে ‘দ্রুত সমাধান’ দেখিয়ে অতিরিক্ত টাকা নেয়। অভিযোগ রয়েছে, কেউ টাকা না দিলে তাদের ফাইল ইচ্ছাকৃতভাবে আটকে রাখা হয়।

সিলেটের সদর উপজেলা নির্বাচন অফিসে গিয়ে দেখা যায়, সকাল থেকে শতাধিক মানুষ সারিতে দাঁড়িয়ে আছেন। কিন্তু কর্মকর্তা উপস্থিত নেই বা অনলাইন সার্ভার কাজ করছে নাÑ এমন অজুহাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা। এরই মধ্যে কয়েকজন দালাল এসে আবেদনপত্র পূরণ থেকে শুরু করে ‘দ্রুত কাজ করে দেওয়ার’ প্রস্তাব দিচ্ছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমাদের জনবল খুব সীমিত। একসঙ্গে শতাধিক ফাইল প্রক্রিয়া করতে হয়। দালালেরা এই সুযোগটাই নেয়। তারা বাইরে থেকে আবেদনকারীদের বিভ্রান্ত করে। কিছু কর্মচারীও এতে জড়িত থাকেন, এটা অস্বীকার করা যায় না।’

প্রবাসীদের জন্য এই হয়রানি আরও কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। তারা দেশে আসেন স্বল্প সময়ের জন্য, অনেকের হাতে থাকে মাত্র কয়েক সপ্তাহ। এনআইডি বা অন্যান্য কাগজপত্র ঠিক না থাকলে ব্যাংক লেনদেন, জমি হস্তান্তর, পাসপোর্ট নবায়নÑ সব কাজ আটকে যায়।

কুয়েতপ্রবাসী শাহিন আহমদ ফোনে বলেন, ‘দুই সপ্তাহের ছুটিতে দেশে গিয়ে শুধু এনআইডি ঠিক করতে চার দিন অফিসে ঘুরেছি। পরে দালালের হাতে ৮ হাজার টাকা দিয়েছি। না দিলে কাজ হতো না।’ এভাবে একদিকে সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, অন্যদিকে দেশের ভাবমূর্তি ও প্রবাসীদের আস্থাও নষ্ট হচ্ছে।

মানবাধিকার ও সুশীল সমাজের নেতারা মনে করেন, দালালদের দৌরাত্ম্য কেবল দুর্নীতির চিহ্ন নয়, এটি প্রশাসনিক দুর্বলতার প্রতিফলন।

অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম বলেন, ‘প্রবাসীরা আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার বড় উৎস। তাদের হয়রানি মানে অর্থনীতিকে আঘাত করা। দালালচক্রের বিরুদ্ধে তদন্ত, জবাবদিহি ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার জরুরি।’

তিনি আরও বলেন, “প্রযুক্তিনির্ভর সেবাকাঠামো গড়ে না তোলা পর্যন্ত এই চক্র থামবে না। অনলাইন সিস্টেমে ত্রুটি থাকলে দালালেরাই ‘সহজ উপায়’ হিসেবে নিজেদের বিকল্প হিসেবে দাঁড় করায়।”

সিলেট জেলা নির্বাচন অফিসের সিনিয়র জেলা নির্বাচন অফিসার মোহাম্মদ মুঞ্জুরুল আলম বলেন, ‘আমরা দালালদের প্রশ্রয় দিই না। কেউ প্রতারিত হলে লিখিত অভিযোগ দিলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক কর্মকর্তা বলেন, ‘প্রযুক্তিগত ব্যাঘাত, সার্ভার সমস্যা ও জনবল ঘাটতির কারণে কাজ বিলম্বিত হয়। এতে দালালেরা সক্রিয় হয়ে ওঠে। আমরা প্রতিদিন শত শত আবেদন পাই অথচ কাজের লোক মাত্র কয়েকজন। অনলাইন সেবা অনেক সময় বন্ধ থাকে। ফলে মানুষ দালালের কাছে যায়।’

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, দালালরা সাধারণত তিন ধাপে কাজ করে। অফিসের বাইরে যোগাযোগÑ আবেদনকারীর সমস্যার ধরন বোঝা ও ‘দ্রুত সমাধানের’ প্রস্তাব দেওয়া। অভ্যন্তরীণ সংযোগÑ নির্দিষ্ট কর্মচারীর মাধ্যমে ফাইল প্রক্রিয়ায় অগ্রাধিকার দেওয়া বা আটকে রাখা। অর্থ লেনদেনÑ ‘ম্যানেজ খরচ’ নামে টাকা হাতবদল হয়, যার একটি অংশ সদর উপজেলা নির্বাচন অফিসের জাহাঙ্গীর, রুরেলের মাধ্যমে অফিসের ভেতরেই যায় বলে অভিযোগ রয়েছে।

সিলেট জেলা প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন বলেন, প্রবাসী অধ্যুষিত সিলেটের মানুষের সরলতার সুযোগ কাজে লাগিয়ে কিছু কর্মচারী আর্থিক সুবিধা নিয়ে চুক্তিভিত্তিকভাবে কাজ করেনÑ এমন অভিযোগ রয়েছে। ভুক্তভোগীরা অফিসে এসে কাজ করাতে না পেরে ফিরে যান, কিন্তু দালালের মাধ্যমে গেলে কাজ দ্রুত সম্পন্ন হয়। তাই মানুষের ভোগান্তি দূর করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

মনির হোসেন নামের এক ভুক্তভোগী বলেন, ‘এখানে দালালেরা প্রকাশ্যে কাজ করে। তারা অফিসের গেটেই বসে থাকে, নতুন কেউ এলে কাছে যায়। প্রশাসন চাইলেই এদের চিহ্নিত করা সম্ভব।’

ভুয়া এনআইডির ঝুঁকি: আরও ভয়াবহ একটি দিক হলো, এই দালালচক্রের হাত ধরে ভুয়া এনআইডিও তৈরি হচ্ছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, রোহিঙ্গা ও অন্যান্য অননুমোদিত ব্যক্তি টাকার বিনিময়ে বাংলাদেশি পরিচয়পত্র পাচ্ছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, কিছু দালাল রোহিঙ্গাদের এনআইডি করে দেওয়ার মতো অপরাধেও জড়িত। এটি কেবল দুর্নীতি নয়, জাতীয় নিরাপত্তার ঝুঁকি।

বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেন, দালালচক্র নিয়ন্ত্রণে শতভাগ অনলাইন আবেদন ও ডেলিভারি সিস্টেম চালু করা, যাতে অফিসে না গিয়েই সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। নাগরিকের দেওয়া তথ্য সঠিকভাবে যাচাই করা। সিসি ক্যামেরা ও পর্যবেক্ষণব্যবস্থা জোরদার, প্রতিটি সার্ভিস কাউন্টার, প্রবেশদ্বার ও অফিস প্রাঙ্গণে নজরদারি নিশ্চিত করা। প্রতিটি আবেদন অনলাইনে ট্র্যাকযোগ্য করা, নাগরিক যেন নিজেই জানতে পারেন কোন পর্যায়ে তার আবেদন আছে। স্বতন্ত্র অভিযোগ মেকানিজম গঠন, দালাল বা কর্মচারীর অনিয়মের অভিযোগ দিলে তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে তদন্তে যায়। সার্ভিস টাইমলাইন নির্ধারণ, নির্দিষ্ট সময়সীমা লঙ্ঘন হলে কর্মকর্তার জবাবদিহি নিশ্চিত করা। পুলিশি নজরদারি ও অভিযানÑ দালালচক্র চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি।

জাতীয় পরিচয়পত্র শুধু একটি কার্ড নয়, এটি নাগরিকত্বের প্রতীক, রাষ্ট্রীয় পরিচয়ের ভিত্তি। এই সেবায় দুর্নীতি বা দালালচক্রের প্রভাব অব্যাহত থাকলে জনগণের আস্থা ক্ষুণœ হবে, রাষ্ট্রীয় সেবার বিশ্বাসযোগ্যতাও হারাবে।

প্রবাসীরা দেশের জন্য রেমিট্যান্স পাঠিয়ে অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রাখছেন। অথচ তারা দেশে ফিরে এমন হয়রানির শিকার হলে তা শুধু ব্যক্তিগত ক্ষতি নয়, জাতীয় ভাবমূর্তির জন্যও নেতিবাচক বার্তা দেয়।

দালালচক্রের ফাঁদে পড়ে যদি সাধারণ মানুষ হয়রানির শিকার হয়, তাহলে প্রশাসনের দায়িত্ব শুধু ‘অভিযোগ নেব’ বলায় শেষ হয় না, প্রয়োজন বাস্তব পরিবর্তন। কার্যকর নজরদারি, ডিজিটাল স্বচ্ছতা ও কঠোর জবাবদিহিই পারে নির্বাচন অফিসকে দালালমুক্ত করতে। এখন সময় এসেছে প্রশাসনকে বাস্তব পদক্ষেপে নামার। কেবল অভিযান নয়, প্রয়োজন প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার ও জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার।

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!