বুধবার, ০৫ নভেম্বর, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


মুনাওয়ার হোসাইন মইনুল, গণমাধ্যম উদ্যোক্তা

প্রকাশিত: নভেম্বর ৫, ২০২৫, ০১:১৩ এএম

সংস্কার, সংবিধান ও জনগণের ম্যান্ডেট

মুনাওয়ার হোসাইন মইনুল, গণমাধ্যম উদ্যোক্তা

প্রকাশিত: নভেম্বর ৫, ২০২৫, ০১:১৩ এএম

সংস্কার, সংবিধান ও জনগণের ম্যান্ডেট

আমার প্রিয় স্বদেশ বাংলাদেশ আজ এক গভীর চড়াই-উতরাইয়ের সময় পার করছে। দীর্ঘ পনেরো বছর ধরে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র পরিচালনা করেছে। কিন্তু ২০১৪ সালের পর সেই শাসনকাল গণমানুষের ভোট, মতামত এবং দুঃখ-দুর্দশার প্রতি উদাসীন থেকেছে, এমন অভিযোগই জনমনে গভীর ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে।

ক্ষমতায় টিকে থাকার প্রবল আকাক্সক্ষা, একদলীয় মানসিকতা, বিরোধীদের ওপর দমন-পীড়ন ও গুম-খুনের রাজনীতি সব মিলিয়ে দেশ পড়ে রাজনৈতিক অচলাবস্থায়। নির্বাচনের নামে এক ধরনের প্রহসনের বন্দোবস্তই যেন স্থায়ী রূপ নেয়, যার করুণ সমাপ্তি ঘটে পরবর্তীতে।

পরিবর্তনের সূচনা

ছাত্রসমাজের কোটা-বিরোধী আন্দোলন দমন করতে সরকারের জোর প্রয়াসই শেষ পর্যন্ত বুমেরাং হয়ে দাঁড়ায়।

তীব্র ছাত্র-জনতার আন্দোলন, রাজনৈতিক চাপ এবং আন্তর্জাতিক উদ্বেগের মুখে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ক্ষমতার পালাবদল ঘটে। শেখ হাসিনা ও তার ঘনিষ্ঠ মহল পার্শ্ববর্তী দেশে আশ্রয় নেন, আর আওয়ামী লীগের বহু নেতা-কর্মী দেশের নানা প্রান্তে জনরোষের মুখে পড়েন।

এরপর দেশের নেতৃত্বভার আসে এক অন্তর্বর্তী সরকারের হাতে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে। দেশি-বিদেশি নাগরিকদের নিয়ে গঠিত উপদেষ্টা পরিষদকে ঘিরে শুরু হয় নতুন বিতর্ক। বিএনপি শুরু থেকেই এই সরকারের গঠন প্রক্রিয়া থেকে দূরত্ব বজায় রাখে। আন্দোলনের মধ্য থেকে উঠে আসা তিনজন ছাত্রনেতাকে উপদেষ্টা করা হয়, যাদের মধ্যে একজন পরবর্তীতে সরে দাঁড়ালেও দুজন এখনো দায়িত্ব পালন করছেন।

তবে ক্ষমতা পরিবর্তনের সময় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে শুরু হয় সরকার ও প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে নিজেদের লোক বসানোর প্রতিযোগিতা। বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির মতো দলগুলোকে ঘিরে তদবির-বাণিজ্যের অভিযোগও তখন ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক মাধ্যমে। বড় দল হিসেবে বিএনপি এবং নবগঠিত দল এনসিপিকে  ঘিরে সবচেয়ে বেশি ‘দখল ও চাঁদাবাজির খবর প্রকাশিত হতে থাকে সোশ্যাল মিডিয়ায়। যদিও বিএনপি বরাবরই এসব অভিযোগের বিরুদ্ধে অবস্থান পরিষ্কার করেছে। বিশেষ করে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান দলের মধ্যে বার্তা দিয়েছেন, চাঁদাবাজ ও দখলবাজদের দলে কোনো স্থান নেই। ইতিবাচকভাবে দেখা যায়, এই নির্দেশের পর বিএনপি প্রায় দুই হাজারের বেশি নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে এবং বহিষ্কার কার্যক্রম এখনো চলছে। এনসিপিও এসবের কথা অস্বীকার করেছে সবসময়, যদিও কয়েকটি অভিযোগ আসার পর এনসিপি কয়েকজনকে নোটিশ দিয়েছে এবং বহিষ্কারও করেছে।

সংস্কারের নামে নতুন প্রহসন

অন্তর্বর্তী সরকারের শুরুতেই দীর্ঘদিন প্রবাসে থাকা দ্বৈত নাগরিকদের সমন্বয়ে এবং মূল ভূমিকায় তাদের রেখে ঐকমত্য কমিশন গঠন করে যে সংস্কার প্রক্রিয়ার অঙ্গীকার করা হয়েছিল, তা এখন অনেকের চোখে প্রহসনে পরিণত হচ্ছে। সব দলকে নিয়ে দীর্ঘদিনের বৈঠকের পর ‘জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠিত হয়, যা তখন জাতীয় মুক্তির প্রতীক হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছিল, যদিও এনসিপি এতে স্বাক্ষর থেকে বিরত ছিল। এই সনদ স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে দেশের জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি নির্বাচনের বিষয়ে নতুন আশার সঞ্চার হয়।

কিন্তু বিপত্তি বাধে যখন ঐকমত্য কমিশন ২৮ অক্টোবর ২০২৫ ‘জুলাই সনদ’ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে সরকারের কাছে সুপারিশ জমা দেয়। কমিশন প্রস্তাব দিয়েছে, সংবিধান-সম্পর্কিত সংস্কার বাস্তবায়নে বিশেষ আদেশ জারি করে তার ভিত্তিতে গণভোট হবে। গণভোটে প্রস্তাব পাশ হলে আগামী সংসদ ২৭০ দিনের মধ্যে সংবিধান সংস্কার করবে। সংশোধন না করলে আপনা-আপনি সেটা সংবিধানে যুক্ত হয়ে যাবে। পাশাপাশি গণভোট নির্বাচনের দিন হবে, নাকি এর আগে হবে, তা ঠিক করবে সরকার। বিএনপি গণভোট চেয়েছে জাতীয় নির্বাচনের দিন, জামায়াতে ইসলামী বরাবরই এর বিপরীতে থেকে গণভোট নির্বাচনের পূর্বে করার পক্ষে। তা ছাড়া সুপারিশে ভিন্নমত বাদ দেওয়া, সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠন করে ২৭০ দিন সময় বেঁধে দেওয়া এবং এর মধ্যে সংস্কার না হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে যুক্ত হওয়াকে জনগণের ম্যান্ডেটবিহীন একটি ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখা হয়েছে।

সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয়, যারা এই সংবিধান সংস্কারের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাদের অধিকাংশই দীর্ঘদিন প্রবাসে থাকা নাগরিক, দেশের বাস্তবতা থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন। নয় মাস ধরে নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত প্রায় সব দলের সঙ্গে বৈঠক করেও তারা ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেননি। বরং দেশের সবচেয়ে বৃহৎ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন বাড়িয়ে দিয়ে নির্বাচনের আগেই নতুন অনিশ্চয়তার বীজ বপন করেছেন। বিশ্লেষকদের প্রশ্ন। এই প্রবাসফেরত বিশেষজ্ঞদের নেতৃত্বে সংবিধান সংস্কারের প্রক্রিয়া কতটা টেকসই? তারা ফিরে গেলে এই বিভ্রান্তির দায় বহন করবে কে? শেষ পর্যন্ত এই সংকটের বোঝা বহন করতে হবে আমাদের দেশীয় রাজনীতিক ও জনগণকেই।

জনগণের ম্যান্ডেট ছাড়া সংস্কার নয়

জুলাই আন্দোলনের সময় কিংবা ৫ আগস্টের আগে পর্যন্ত কোথাও সংবিধান পরিবর্তনের দাবি শোনা যায়নি।

কোটা-বিরোধী আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল কোটা সংস্কার, ন্যায়বিচার ও চাকরিতে মেধাভিত্তিক অংশগ্রহণের সুযোগ পরবর্তীতে সরকার পতনের একদফার আন্দোলন; সংবিধান সংস্কার নয়। তাহলে হঠাৎ এই সংস্কারের তাড়না কোথা থেকে এলো?

সংবিধান কোনো সরকারের সম্পত্তি নয়, এটি জাতির সামাজিক চুক্তি। তাই এর পরিবর্তন কেবল জনগণের প্রত্যক্ষ অনুমোদনেই সম্ভব। যদি সত্যিই সংবিধান সংস্কার করতে হয়, সেটি হতে হবে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়। যদিও সব দলকে অংশগ্রহণে জাতীয় ঐকমত্যের সিরিজ বৈঠকের ফলস্বরূপ এনসিপি ছাড়া সকলে সংস্কার চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিল, কিন্তু সরকারের কাছে এই কমিশন যেভাবে সুপারিশ জমা দিয়েছে, তা সত্যিকার অর্থে আগুনে ঘি ঢালার মতো, বড় দুই রাজনৈতিক দলকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। ঐকমত্য কমিশন ২৮ অক্টোবর ২০২৫ জুলাই সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে সরকারের কাছে সুপারিশ জমা দেয়। কমিশন প্রস্তাব দিয়েছে-সংবিধান-সম্পর্কিত সংস্কার বাস্তবায়নে বিশেষ আদেশ জারি করে তার ভিত্তিতে গণভোট হবে। গণভোটে প্রস্তাব পাস হলে আগামী সংসদ ২৭০ দিনের মধ্যে সংবিধান সংস্কার করবে। সংশোধন না করলে আপনা-আপনি সেটা সংবিধানে যুক্ত হয়ে যাবে। পাশাপাশি গণভোট নির্বাচনের দিন হবে নাকি এর আগে হবে তা ঠিক করবে সরকার। বিএনপি গণভোট চেয়েছে জাতীয় নির্বাচনের দিন। জামায়াতে ইসলামী বরাবরই এর বিপরীতে ছিল, গণভোট নির্বাচনের পূর্বেই চায় তারা। তা ছাড়া সুপারিশে ভিন্নমত বাদ দেওয়া এবং সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠন করে ২৭০ দিন সময় বেঁধে দেওয়া হয়। সংস্কার না হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে যুক্ত হওয়াকে জনগণের ম্যান্ডেটবিহীন একটি ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখেছেন ওয়াকিবহাল মহল। 

নির্বাচনি ইস্তেহারে সংস্কার

প্রত্যেক রাজনৈতিক দল তাদের নির্বাচনি ইশতেহারে সংস্কারের প্রস্তাব রাখতে পারে। জনগণ যেই দলের ধারণা গ্রহণ করবে, সেটিই গণতান্ত্রিকভাবে কার্যকর হবে, এটাই গণম্যান্ডেটের প্রকৃত অর্থ। গণভোটের মাধ্যমে চাপিয়ে দেওয়া কোনো সংস্কার জনগণকে বিভ্রান্ত করবে। কারণ এটি এমন এক জটিল বিষয় যা সাধারণ মানুষের কাছে পুরোপুরি স্পষ্ট নয়। ইউরোপের ব্রেক্সিট গণভোটই দেখিয়েছে, অপরিপক্ব সিদ্ধান্ত কীভাবে জাতিকে দীর্ঘমেয়াদি অনিশ্চয়তায় ফেলে দিতে পারে। ব্রিটেন ব্রেক্সিটের পর থেকেই খুব ভালোভাবে মূল্য দিচ্ছে, উগ্র জাতীয়তাবাদ এবং ইংরেজ আভিজাত্যের আবেগে গণভোটে অংশ নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে।

রাজনৈতিক বিভাজন ও নিরাপত্তা সংকট

অনেকদিন ধরে দেশে চলছে রাজনৈতিক অস্থিরতা, আলোচনার রাজনীতি ও অবিশ্বাসের পরিবেশ।

জাতীয় নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন, নির্বাচনের তারিখ যত বিলম্বিত হচ্ছে, রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতা ততই ঝুঁকিতে পড়ছে। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো ঐক্যের বদলে এখন বিভাজনে ব্যস্ত। যারা একসময় কাঁধে-কাঁধ মিলিয়ে আন্দোলন করেছিল, তারাই এখন বিবৃতির যুদ্ধে লিপ্ত। এদিকে নতুন করে ২৩ অক্টোবর উপদেষ্টা পরিষদে ‘গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধন অধ্যাদেশ ২০২৫’ চূড়ান্ত অনুমোদন হলেও বিএনপি এর প্রতিবাদে চিঠি দিলে আরপিও ২১ ধারা পরিবর্তন না করার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এতে করে জোটবদ্ধ দলগুলো নিজেদের প্রতীক না নিয়ে একই প্রতীকে নির্বাচন করতে পারবে। এতে প্রচ- ক্ষুব্ধ হয় জামায়াত। কারণ এই ২১ ধারা অব্যাহত থাকায় বিএনপি ও তার জোটভুক্ত দলগুলো ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করতে পারবে। এটা নিয়ে এখন জামায়াত ও বিএনপি মুখোমুখি অবস্থানে আছে।

জনগণের আশা জাতীয় নির্বাচন

৫ আগস্টের পরিবর্তনের পর মানুষ নতুন করে স্বপ্ন দেখেছিল, নিজেদের ভোটের মাধ্যমে প্রতিনিধি পাঠাতে পারবে সংসদে। কিন্তু আজ সংস্কার ও গণভোটের আলোচনায় সেই আশাই ম্লান হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের বর্তমান সংকটের একমাত্র টেকসই সমাধান হলোÑ স্বাধীন ও অংশগ্রহণমূলক জাতীয় নির্বাচন। জনগণের ম্যান্ডেটই নির্ধারণ করবে সরকার, সংবিধান ও ভবিষ্যতের পথরেখা। ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঘোষিত জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে সব দলেরই উচিত, ঐক্যবদ্ধ হওয়া, পারস্পরিক বিশ্বাস ফিরিয়ে আনা এবং জনগণের আস্থায় ফিরে যাওয়া।

দেশপ্রেম, দায়িত্ব ও জনগণের প্রতি আস্থা

বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রতিটি বড় পরিবর্তন এসেছে জনগণের হাত ধরে কখনো মিছিলে, কখনো ভোটে।

এই জাতি অজস্র ত্যাগ ও রক্তের বিনিময়ে তার গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে। আজ যদি সেই জনগণকেই বাদ দিয়ে রাষ্ট্র গঠনের চেষ্টা করি, ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না।

সংবিধান জনগণের, ক্ষমতা জনগণের, এবং গণতন্ত্রের আসল মালিকও জনগণই।

দেশকে ভালোবাসুন, জনগণের ওপর আস্থা রাখুন। জনগণের ম্যান্ডেটই হোক সংস্কারের চূড়ান্ত পথ।

নিজের ইচ্ছাকে জনগণের মতের ওপর চাপিয়ে দেবেন না, কারণ গণতন্ত্র মানেই জনগণের মতের প্রতি শ্রদ্ধা।

রাজনীতি বা সংবিধান, দুটিই কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর সম্পত্তি নয়। এটি জাতির যৌথ সম্পদ, যার রক্ষক আমরা সকলে। এই সত্য যত দ্রুত উপলব্ধি করতে পারব, তত দ্রুতই বাংলাদেশ ফিরে পাবে তার প্রাপ্য স্থিতি, মর্যাদা ও আস্থার জায়গা।

মুনাওয়ার হোসাইন মইনুল, গণমাধ্যম উদ্যোক্তা
সভাপতি, মানবাধিকার ও জলবায়ু উন্নয়ন সংগঠন

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!