প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রচ- বিরোধিতার মুখে ইতিহাস গড়ে যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম শহর নিউইয়র্কের মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী ৩৪ বছর বয়সি জোহরান মামদানি। নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের সাবেক গভর্নর ও স্বতন্ত্র প্রার্থী অ্যান্ড্রু কুমো ও রিপাবলিকান প্রার্থী কার্টিস স্লিওয়াকে পরাজিত করে ইতিহাস গড়লেন নিজেকে ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিস্ট পরিচয় দেওয়া মামদানি। একই সঙ্গে অঙ্গরাজ্যের আইনপ্রণেতা থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্রেটিক পার্টির সামনের সারির নেতৃত্বেও যাত্রা শুরু করলেন এই তরুণ তুর্কি।
এ জয়ের মধ্য দিয়ে মামদানি প্রথম মুসলিম হিসেবে নিউইয়র্ক সিটির ১১১তম মেয়র নির্বাচিত হলেন। এ ছাড়া গত একশ বছরেরও বেশি সময়ের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ মেয়র হওয়ারও ইতিহাস গড়েছেন মামদানি। শুধু তা-ই নয়, প্রথম দক্ষিণ এশীয় বংশোদ্ভূত এবং আফ্রিকায় জন্মগ্রহণকারী হিসেবেও নিউইয়র্কের প্রথম মেয়র নির্বাচিত হওয়ার রেকর্ড গড়েছেন মামদানি।
গত বছরের অক্টোবরে যখন মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঘোষণা দেন, তখনো শহরের অধিকাংশ মানুষের কাছেই মামদানি ছিল এক অচেনা নাম। কিন্তু জনহিতৈষী নির্বাচনি ইশতেহার দিয়ে কয়েক মাসেই তরুণদের মধ্যে দারুণ জনপ্রিয়তা অর্জন করেন তিনি। নিউইয়র্কের সেই তরুণরাই এবার মামদানির হাতে তুলে দিয়েছেন গোটা শহরের দায়িত্ব। যা যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম শহরটির রাজনীতির ইতিহাসে এনেছে অভূতপূর্ব পরিবর্তন।
মামদানির অভূতপূর্ব বিজয় সম্পর্কে বিশ্লেষক ল্যু জেনি বলেছেন, ‘মামদানির জীবন যেন সিনেমা। চলচ্চিত্র নির্মাতার সন্তান, সাবেক র্যাপার, সমাজকর্মী আর এখন শহরের মেয়র পদে আসীন এক মুসলিম ভারতীয় বংশোদ্ভূত তরুণ। তিনি এক নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধি, তরুণ এবং ডিজিটাল যুগের রাজনীতিক।’
নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভোটের প্রাথমিক ফলাফলে জোহরান মামদানি ১০ লাখ ৩৫ হাজার ৬৪৬ ভোট (৫১ শতাংশ), অ্যান্ড্রু কুওমো ৮ লাখ ৫৪ হাজার ৭৮৩ ভোট (৩৯ শতাংশ) এবং কার্টিস স্লিওয়া ১৪ হাজার ৬২৬ (৭.১ শতাংশ) ভোট পেয়েছেন। নিউইয়র্ক সিটির বোর্ড অব ইলেকশনস জানিয়েছে- পাঁচ দশকেরও বেশি সময়ের মধ্যে এবার ভোটার উপস্থিতি ছিল সর্বোচ্চ।
যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় গত মঙ্গলবার সকাল ৬টা থেকে শুরু হয়ে রাত ৯টা পর্যন্ত মেয়র নির্বাচনে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। শেষ মুহূর্তে নির্বাচনে আসে নাটকীয় মোড়। ডেমোক্রেটিক দলের প্রার্থিতার দৌড়ে জোহরান মামদানির কাছে হেরে গিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়া অ্যান্ড্রু কুওমোকে সমর্থন জানান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তাঁর দল রিপাবলিকান পার্টি কার্টিস স্লিওয়াকে প্রার্থী করেছে। ট্রাম্পের সমর্থনের কারণে রিপাবলিকান ভোটাররা কুওমোর দিকে ঝুঁকতে পারেন, যা নতুন এক সমীকরণ দাঁড় করাতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছিল। তবে নিউইয়র্কের নির্বাচন শেষ পর্যন্ত মামদানি বনাম ডোনাল্ড ট্রাম্পের লড়াইয়ে পরিণত হয়।
বিবিসি জানিয়েছে, অ্যান্ড্রু কুওমোকে ট্রাম্পের সমর্থনের কড়া জবাব দিয়েছেন মামদানি। মামদানি বলেন, ‘কুওমোকে সমর্থন করেছেন ট্রাম্প ও তাঁর দলের লোকজন। তিনি নিউইয়র্ক সিটি বা নিউইয়র্কের বাসিন্দাদের সেরা মেয়র হবেন না, তিনি হবেন ট্রাম্প ও তাঁর প্রশাসনের সেরা মেয়র।’ তবে মামদানি জিতলে কেন্দ্রীয় তহবিল বন্ধ করে দেওয়ারও ঘোষণা দেন ট্রাম্প। ট্রাম্প বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিউইয়র্ককে অধিক অর্থ দেওয়া আমার পক্ষে কঠিন হতে যাচ্ছে।’ এ প্রসঙ্গে মামদানি বলেন, ‘এটা কোনো নিয়ম নয়, হুমকি।’
নির্বাচনে অবিশ^াস্য বিজয়ের পর ভাষণে মামদানি বলেন, ‘এই নিরঙ্কুশ জয় প্রমাণ করেছে, ট্রাম্পের মতো শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বীকেও পরাজিত করার পথ দেখাতে পারে নিউইয়র্ক। যদি কেউ ট্রাম্পের বিশ্বাসঘাতকতায় ক্ষতিগ্রস্ত একটি জাতিকে বাঁচানোর পথ দেখাতে পারে, তবে তা নিউইয়র্কই, যে শহরে ট্রাম্প বেড়ে উঠেছেন।’ ট্রাম্পের উদ্দেশে তিনি আরও বলেন, ‘আমি জানি আপনি এটি দেখছেন। আপনাকে শুধু চারটি কথা বলার আছে: টার্ন দ্য ভলিউম আপ!’ ভাষণ শেষ হতেই ব্যাকগ্রাউন্ডে বেজে ওঠে বলিউডের জনপ্রিয় গান ‘ধুম মাচালে’।
জোহরান মামদানির বাবা-মা দুজনই ভারতীয় নাগরিক। তবে তার জন্ম উগান্ডার কাম্পালায়। মামদানির মা বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা মীরা নায়ার। মনসুন ওয়েডিং, দ্য নেমসেক ও মিসিসিপি রিভারের মতো বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্রের পরিচালক তিনি। আর বাবা মাহমুদ মামদানি কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রখ্যাত অধ্যাপক ও সমাজবিজ্ঞানী। শৈশবের কিছু সময় দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউনে বেড়ে উঠেছেন তিনি। এরপর সাত বছর বয়সে পরিবারসহ যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে স্থায়ী হন। ২০১৮ সালে মামদানি মার্কিন নাগরিকত্ব লাভ করেন। এরপর সিরিয়ান-আমেরিকান শিল্পী রামা দুয়াজিকে বিয়ে করে কুইন্সের অ্যাস্টোরিয়ায় থিতু হন এই দম্পতি। ২০১৮-পরবর্তী মাত্র সাত বছরেই যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ নিউইয়র্ক সিটির মেয়র হয়ে নতুন ইতিহাস লিখলেন মামদানি।

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন