বৃহস্পতিবার, ০৬ নভেম্বর, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


হাসান আরিফ

প্রকাশিত: নভেম্বর ৬, ২০২৫, ০১:০৫ এএম

বাণিজ্যের নতুন আঞ্চলিক সংযোগের সূচনায় দুই দেশ

হাসান আরিফ

প্রকাশিত: নভেম্বর ৬, ২০২৫, ০১:০৫ এএম

বাণিজ্যের নতুন আঞ্চলিক  সংযোগের সূচনায় দুই দেশ

বাংলাদেশ ও ভুটানের মধ্যে বহু প্রতীক্ষিত ট্রানজিট চুক্তির আওতায় প্রথম পরীক্ষামূলক পণ্য চলাচলের প্রস্তুতি চূড়ান্ত করেছে সরকার। এরই মধ্যে ভুটান একটি প্রতিষ্ঠানকে পরীক্ষামূলকভাবে পণ্য পরিবহনের দায়িত্ব দিয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় চুক্তির আওতায় প্রযোজ্য ফি, চার্জ, প্রশাসনিক প্রক্রিয়া ও নিরাপত্তার প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয় ও এনবিআর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

চুক্তির আওতায় বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে প্রবেশ করে বুড়িমারি স্থলবন্দর দিয়ে বের হতে একটি চালানের এক মেট্রিক টনের জন্য খরচ হবে ২২০ টাকা, প্রতি ট্রাক বা ট্রেইলারের জন্য প্রতি কিলোমিটারে এসকর্ট চার্জ ৮৫ টাকা, প্রতি কনটেইনারে কনটেইনার স্ক্যানিং ফি ২৫৪ টাকা, প্রতি চালানে দলিল প্রক্রিয়াকরণ ফি ৩০ টাকা, ইলেকট্রনিক লক ও সিল ফি এবং সড়ক ব্যবহার মাশুল সংশ্লিষ্ট সংস্থার নির্ধারিত হারে দিতে হবে। এর বাইরে সব ফির ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাটও দিতে হবে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের ঊর্ধ্বতন প্রতিনিধিরা এতে অংশ নেন। বৈঠকের মূল উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশ-ভুটান ট্রানজিট চুক্তি কার্যকর করার প্রথম ধাপের প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো চূড়ান্ত করা, যাতে পণ্য চলাচল নির্বিঘেœ করতে পারে।

বাংলাদেশÑভুটান ট্রানজিট চুক্তির প্রথম পরীক্ষামূলক পণ্য চলাচল দক্ষিণ এশিয়ার সংযুক্তি ও বাণিজ্য সহযোগিতার ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করছে। এটি বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশ হবে দক্ষিণ এশিয়ার বাণিজ্য প্রবাহের কেন্দ্রবিন্দু আর ভুটানের জন্য এটি হবে অর্থনৈতিক পুনর্জাগরণের পথ।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সবকিছু নির্ভর করছে প্রশাসনিক প্রস্তুতি, সমন্বিত নীতিনির্ধারণ ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপর। বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি যৌথ কারিগরি কমিটি দ্রুত কার্যকর করা যায় এবং কাস্টমস ও বন্দর ব্যবস্থার ডিজিটাল সমন্বয় সম্পন্ন হয়, তাহলে এ চুক্তি আঞ্চলিক বাণিজ্য ইতিহাসে ‘বাংলাদেশ মডেল’ হিসেবে জায়গা করে নিতে পারবে।

ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে গুরুত্ব

ভুটান দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের একটি স্থলবেষ্টিত দেশ। তাদের সমুদ্রবন্দর নেই, ফলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে সীমাবদ্ধতা থেকে যায়। বাংলাদেশ তাদের জন্য সমুদ্রপথ খুলে দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক কূটনীতিতে একটি নতুন ভূমিকা নিচ্ছে।

এটি ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল, নেপাল ও ভুটানকে সংযুক্ত করে ত্রিদেশীয় বাণিজ্য করিডর তৈরির সুযোগ সৃষ্টি করবে। চট্টগ্রাম ও বুড়িমারী হয়ে ফুয়েনশোলিং পর্যন্ত এই রুট একদিকে বাংলাদেশকে ট্রানজিট রাষ্ট্রে পরিণত করবে, অন্যদিকে ভুটানকে বৈশ্বিক বাজারে সরাসরি প্রবেশের সুযোগ দেবে।

দুই দেশের পারস্পরিক সিদ্ধান্ত ও ট্রায়াল রান পরিকল্পনা

২০২৪ সালের ২৪Ñ২৫ এপ্রিল ভুটানের রাজধানী থিম্পুতে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশÑভুটান বাণিজ্যসচিব পর্যায়ের নবম সভায় সিদ্ধান্ত হয়, দুই দফা পরীক্ষামূলক ট্রানজিট চলাচল করার পর পূর্ণমাত্রায় চুক্তি বাস্তবায়ন করা হবে।

এই সিদ্ধান্তের পর ২০২৫ সালের ৯ অক্টোবর ভুটান সরকার বাংলাদেশকে জানায় যে, তারা ‘আবিত কার্গো কোম্পানি’কে প্রথম পরীক্ষামূলক পণ্য চালানের দায়িত্ব দিয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে দ্রুত প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেয়।

যৌথ কারিগরি কমিটি গঠনের প্রয়োজনীয়তা

চুক্তির প্রোটোকল অনুযায়ী একটি যৌথ কারিগরি কমিটি গঠনের কথা রয়েছে, যা উভয় দেশের বাণিজ্য ও বন্দরবিষয়ক কর্তৃপক্ষের মধ্যে সমন্বয় সাধন করবে। তবে সভায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি জানান, কমিটি এখনো গঠিত হয়নি এবং প্রক্রিয়াটি সময়সাপেক্ষ।

ফলে চুক্তির ধারাবাহিকতা রক্ষায় প্রথম ট্রায়াল রান অস্থায়ী প্রশাসনিক কাঠামোর আওতায় করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সভায় বলা হয়, কমিটি গঠনের পর চূড়ান্ত হার ও প্রক্রিয়া পুনর্মূল্যায়ন করা হবে।

বাংলাদেশ ভারত ট্রানজিট অভিজ্ঞতার অনুসরণ

সভায় সিদ্ধান্ত হয় যে, বাংলাদেশ-ভারত ট্রানজিট চুক্তির অধীনে চালু থাকা পদ্ধতি ও ফি-চার্জের হার প্রাথমিকভাবে অনুসরণ করা যেতে পারে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহার করে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে পণ্য পরিবহন চুক্তি কার্যকর রয়েছে, যার সফল বাস্তবায়ন এই নতুন চুক্তির জন্য একটি ব্যবহারযোগ্য মডেল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

এই নীতির আলোকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড নি¤œলিখিত ফি ও চার্জের প্রস্তাব অনুমোদন করেছেÑ দলিল প্রক্রিয়াকরণ ফি : প্রতি চালানে ৩০ টাকা। ট্রানশিপমেন্ট ফি : প্রতি মেট্রিক টনে ২০ টাকা। নিরাপত্তা চার্জ : প্রতি মেট্রিক টনে ১০০ টাকা। এসকর্ট চার্জ : প্রতি ট্রাক বা ট্রেইলারের জন্য প্রতি কিলোমিটারে ৮৫ টাকা। বিবিধ প্রশাসনিক চার্জ : প্রতি মেট্রিক টনে ১০০ টাকা। কনটেইনার স্ক্যানিং ফি : প্রতি কনটেইনারে ২৫৪ টাকা। ইলেকট্রনিক লক ও সিল ফি : কাস্টমস বিধিমালা অনুযায়ী বিদ্যমান হারে। এবং সড়ক ব্যবহার মাশুল (টোল) : সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের নির্ধারিত হারে দিতে হবে। এ ছাড়া এই ফির ওপর মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইন, ২০১২ অনুযায়ী ১৫ শতাংশ ভ্যাট প্রযোজ্য হবে।

পরীক্ষামূলক ট্রানজিট রুট

পরীক্ষামূলক ট্রানজিট রুট নির্ধারিত হয়েছেÑ থাইল্যান্ডের লেম ছাবাং বন্দর থেকে পণ্য সমুদ্রপথে চট্টগ্রাম বন্দরে আসবে। সেখান থেকে তা সড়কপথে বুড়িমারী স্থলবন্দর হয়ে ভারতের চ্যাংরাবান্ধা, শিলিগুড়ি করিডর, হাসিমারা, জয়গাঁও হয়ে ভুটানের ফুয়েনশোলিংয়ে প্রবেশ করবে।

চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনার খালাসের সময় কাস্টমস কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকবেন। পণ্যের সিল অক্ষত থাকলে তা ট্রানজিট ঘোষণা নথিতে লিখিত থাকতে হবে। প্রয়োজনে অতিরিক্ত নিরাপত্তা সিল সংযোজন করা হবে।

নিরাপত্তা ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা

সভায় নিরাপত্তাব্যবস্থার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। সিদ্ধান্ত হয়Ñ প্রবেশ ও প্রস্থান বন্দরে কাস্টমস কর্মকর্তারা সরাসরি তদারকি করবেন। প্রবেশের পর থেকে প্রস্থান পর্যন্ত পণ্য চলাচলে কাস্টমস কর্মকর্তাদের এসকর্ট থাকবে। কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের প্রতিনিধিরা নিরাপত্তা যাচাইয়ে অংশ নেবেন।

প্রয়োজনে প্রতিটি যানবাহনে ইলেকট্রনিক ট্র্যাকিং ব্যবস্থা (জিপিএস মনিটরিং) চালু করা হবে।

দলিলপত্র ও প্রক্রিয়া

প্রতিটি চালানের সঙ্গে বাধ্যতামূলকভাবে নি¤œলিখিত দলিলপত্র থাকবেÑ কাস্টমস ট্রানজিট ঘোষণাপত্র (সিটিডি), বিল অব লেডিং, চালান ও প্যাকিং তালিকা, নিশ্চয়তাপত্র এবং কনটেইনার সিল নম্বর ও যাচাইকরণ সনদ। এগুলোর প্রতিটিতে প্রবেশ ও প্রস্থানে বন্দরের কাস্টমস কর্মকর্তাদের সিল ও স্বাক্ষর থাকবে।

অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ও আঞ্চলিক প্রভাব

অর্থনীতিবিদদের মতে, এই ট্রানজিট চুক্তির বাস্তবায়ন বাংলাদেশের অর্থনীতিতে দ্বৈত সুফল বয়ে আনবে প্রথমত, বাংলাদেশের বন্দর ও সড়কব্যবস্থার ব্যবহার বাড়বে, যার মাধ্যমে সরকার রাজস্ব আয় বাড়াতে পারবে। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ দক্ষিণ এশীয় বাণিজ্যের একটি কেন্দ্রীয় লজিস্টিক হাবে পরিণত হবে।

চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহার করে ভুটান, নেপাল ও ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে বাংলাদেশ হয়ে উঠতে পারে আঞ্চলিক প্রবেশদ্বার। এটি শুধু বাণিজ্য নয়, বরং কৌশলগতভাবে দক্ষিণ এশিয়ার সংযুক্ত অর্থনীতির পথে একটি মাইলফলক।

প্রশাসনিক চ্যালেঞ্জ ও বাস্তবায়নের পূর্বশর্ত

তবে প্রশাসনিকভাবে এখনো কিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। যৌথ কারিগরি কমিটি এখনো কার্যকর হয়নি। সড়ক টোল হার এখনো চূড়ান্ত নয়। বন্দর ব্যবস্থাপনায় ডিজিটাল সংযোগ (কাস্টমসÑবন্দর ইন্টিগ্রেশন) এখনো পুরোপুরি একীভূত হয়নি।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এসব ঘাটতি দূর করা গেলে এই চুক্তি শুধু ভুটানের সঙ্গে নয়, ভবিষ্যতে বাংলাদেশ-ভুটান-ভারত-নেপাল (বিবিআইএন) আঞ্চলিক সহযোগিতা কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত বৃহত্তর ট্রানজিট নেটওয়ার্ক গঠনে সহায়ক হবে।

সভায় গৃহীত অন্যান্য সিদ্ধান্ত

সভায় আরও সাতটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়Ñ অর্থ বিভাগ প্রস্তাবিত ফি-চার্জ অনুমোদনের বিষয়ে মতামত দেবে; বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দ্রুত যৌথ কারিগরি কমিটি গঠন করবে; সড়ক পরিবহন বিভাগ টোলকাঠামো নির্ধারণে প্রস্তাব দেবে; সংশ্লিষ্ট তিনটি সংস্থার মতামত পাওয়ার পর বিষয়টি অর্থ উপদেষ্টার কাছে উপস্থাপন করা হবে; অর্থ উপদেষ্টার অনুমোদনপ্রাপ্তির পর এনবিআর অস্থায়ী দাপ্তিকি আদেশ জারি করবে; দ্বিতীয় ট্রায়াল রানের আগে যৌথ কমিটি পূর্ণাঙ্গভাবে সক্রিয় করা হবে এবং প্রথম ট্রায়াল রান শেষে এনবিআর একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রস্তুত করে স্থায়ী আদেশ জারি করবে।

চুক্তির পটভূমি ও তাৎপর্য

বাংলাদেশ ও ভুটানের মধ্যে পরিবহন চলাচলসংক্রান্ত এই ঐতিহাসিক চুক্তি দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীদের উপস্থিতিতে স্বাক্ষরিত হয় ২০২৩ সালের ২২ মার্চ। এর আওতায় উভয় দেশ পরস্পরের ভূখ- ব্যবহার করে পণ্য পরিবহন ও ট্রানজিট সুবিধা দেয়।

একই দিনে ‘ট্রানজিট প্রোটোকল’ স্বাক্ষরিত হয়, যাতে পণ্য পরিবহনের রুট, দলিলপত্র, কাস্টমস প্রক্রিয়া, নিরাপত্তাব্যবস্থা ও প্রশাসনিক কাঠামো বিস্তারিতভাবে নির্ধারিত আছে। চুক্তির উদ্দেশ্য শুধু দুই দেশের বাণিজ্য বৃদ্ধি নয়, বরং দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সংহতি ও সংযোগকে আরও দৃঢ় করা।

বাংলাদেশ এই চুক্তির মাধ্যমে শুধু বাণিজ্য নয়, বরং আঞ্চলিক ট্রানজিট রাষ্ট্র হিসেবে কৌশলগত অবস্থানকে দৃঢ় করছে। ভুটানের জন্য এটি এক নতুন বাণিজ্যিক দিগন্ত খুলে দিচ্ছে। কারণ, তাদের জন্য চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহারের সুযোগ অর্থনৈতিকভাবে অত্যন্ত লাভজনক হবে।

 

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!