বৃহস্পতিবার, ০৬ নভেম্বর, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


স্বপ্না চক্রবর্তী

প্রকাশিত: নভেম্বর ৫, ২০২৫, ১১:৩৬ পিএম

‘চোরের মায়ের বড় গলা’

স্বপ্না চক্রবর্তী

প্রকাশিত: নভেম্বর ৫, ২০২৫, ১১:৩৬ পিএম

‘চোরের মায়ের বড় গলা’

আগামী ১০ নভেম্বরের মধ্যে বকেয়া পরিশোধ না করলে ১১ নভেম্বর থেকে আবারও বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধের হুমকি দিয়েছে বাংলাদেশের জন্য নির্মিত ভারতের আদানি বিদ্যুৎকেন্দ্র কর্তৃপক্ষ। যেখানে বাংলাদেশ নিয়মিতভাবেই প্রতি মাসে কিস্তিতে টাকা দিচ্ছে, সেখানে কেন্দ্র কর্তৃপক্ষের এমন হুমকি সম্পূর্ণ অন্যায্য বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এটিকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলেও মনে করছেন তারা।

কেন্দ্রটির বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, চুক্তি ভঙ্গ করে অস্ট্রেলিয়ার কয়লা ব্যবহার না করে দেশীয় কয়লা দিয়ে বেশি দাম নিয়ে অন্যায্য আচরণ করেছে। শুধু তাই নয়, বিগত আওয়ামী লীগ সরকার কোম্পানিটিকে যে কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্রের চাইতে ক্যাপাসিটি চার্জ বেশি নির্ধারণ করে দিয়ে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে বারবার বকেয়ার দাবিতে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধের দাবিকে ‘চোরের মায়ের বড় গলা’ বলে অভিহিত করছেন বিশেষজ্ঞরা।

আদানি পাওয়ারের ভাইস চেয়ারম্যান অবিনাশ অনুরাগ গত ৩১ অক্টোবর বিপিডিবির চেয়ারম্যানের কাছে এ-সংক্রান্ত একটি চিঠি পাঠান।

চিঠিতে জানানো হয়, বিপিডিবি এখনো ৪৯৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বকেয়া পরিশোধ করেনি, যার মধ্যে ২৬২ মিলিয়ন ডলার বিপিডিবির নিজস্ব স্বীকৃত অপরিশোধিত বিল। যদি ১০ নভেম্বরের মধ্যে সব বকেয়া পরিশোধ না করা হয়, তাহলে আমরা ১১ নভেম্বর থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করতে বাধ্য হব।

ধারাবাহিক যোগাযোগ ও একাধিক চিঠি পাঠানোর পরও (সর্বশেষ ৩১ অক্টোবরের চিঠিসহ) বিপিডিবি পাওনা মেটাতে ব্যর্থ হয়েছে। আদানি পাওয়ার উল্লেখ করে, ২০১৭ সালের ৫ নভেম্বর স্বাক্ষরিত পাওয়ার পারচেজ অ্যাগ্রিমেন্টের (পিপিএ) অধীনে এমন পরিস্থিতিতে সরবরাহ বন্ধ করার অধিকার কোম্পানির রয়েছে।

আদানি পাওয়ার জানায়, চুক্তি অনুযায়ী সরবরাহ বন্ধ থাকলেও তারা ‘ডিপেন্ডেবল ক্যাপাসিটির’ ভিত্তিতে ক্যাপাসিটি পেমেন্ট পাওয়ার অধিকার রাখে।

এর আগে আদানি গ্রুপের চেয়ারম্যান গৌতম আদানি গত ২৭ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে পাঠানো চিঠিতে ৪৬৪ মিলিয়ন ডলার বকেয়া পরিশোধের আহ্বান জানান।

তিনি জানান, জুন থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে বাংলাদেশ আংশিক অর্থ পরিশোধ করলেও এখনো একটি বড় অঙ্ক বাকি রয়েছে।

তিনি আরও বলেন, ২০২৫ সালের ২৩ জুন অনুষ্ঠিত বৈঠকে বিপিডিবি কর্মকর্তারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে সেপ্টেম্বরের মধ্যে সব বকেয়া ও লেট পেমেন্ট সারচার্জ (এলপিএস) পরিশোধ করা হবে, কিন্তু এখনো কোনো নির্দিষ্ট সময়সূচি দেওয়া হয়নি। চিঠিতে গৌতম আদানি আহ্বান জানান, অবিলম্বে পাওনা নিষ্পত্তি করতে উদ্যোগ নিন, যাতে অপারেশন ও অর্থায়ন প্রক্রিয়ায় বাড়তি চাপ না পড়ে।

কিন্তু বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) তথ্যমতে, ঋণ পরিশোধ একটি চলমান প্রক্রিয়া। প্রতি মাসেই কেন্দ্রটিকে কোনো না কোনো উপায়ে কিস্তি আকারে ঋণ পরিশোধ করা হচ্ছে। এখন অন্তর্বর্তী সরকারের শেষ সময়ে এসে আবারও এমন হুমকি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলেও মনে করছেন তারা। এর আগেও ঋণ পরিশোধ না করে বাংলাদেশ চুক্তি ভঙ্গ করেছে বলে একাধিকবার অভিযোগ জানিয়েছে ভারতের আদানি পাওয়ার ঝাড়খ- লিমিটেড (এপিজেএল)। যদিও অস্ট্রেলিয়ার কয়লা ব্যবহারের কথা বলে দেশীয় কয়লা দিয়েই এযাবৎ বিদ্যুৎ উৎপাদন করে আসছে প্রতিষ্ঠানটি। তাতেও তাদের খেদ মেটেনি। বাংলাদেশ সরকার নিয়মিত বকেয়া পরিশোধের পরও সম্পূর্ণ বকেয়া এককালীন পরিশোধের দাবিতে উৎপাদন বারবার বন্ধ করেছে, যার প্রভাব পড়ছে দেশের সার্বিক বিদ্যুৎ খাতে।

অভিযোগ রয়েছে, শুধু ভারতকে খুশি করতেই সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কয়েকজন ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি স্বার্থসিদ্ধির জন্য চাহিদা না থাকা সত্ত্বেও আদানির সঙ্গে বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তিতে প্রভাব রাখে। কিন্তু সর্বশেষ চিঠিটি  অন্তর্বর্তী সরকারকে জিম্মি করে বকেয়া পাওনা একসঙ্গে আদায় করার এটি একটি কৌশল বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বিপিডিবি সূত্রে জানা যায়, গত বছর ভারত থেকে কয়লার দামসহ ৮০ কোটি মার্কিন ডলার বকেয়ার দাবিতে চিঠি দেওয়া হয়। যেখানে প্রতি টন কয়লার দাম ধরা হয় ৯৬ ডলার। কিন্তু দেশের পটুয়াখালীর পায়রায় নির্মিত ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতি টন কয়লার দাম নিচ্ছে ৭৫ মার্কিন ডলার। চট্টগ্রামের বাঁশখালীর এস এস পাওয়ার প্ল্যান্ট ও বাগেরহাটের রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রতি টন কয়লার দাম ৮০ মার্কিন ডলারের কম। তার মানে, প্রতি টন কয়লায় পায়রা ও রামপালের চেয়ে ১৬ থেকে ২১ মার্কিন ডলার পর্যন্ত বাড়তি দাম চায় আদানি। দেশীয় কয়লায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে কোনো প্রভাব না পড়লেও চুক্তি ভঙ্গ করে কোম্পানিটি বাংলাদেশ থেকে বেশি মুনাফা আদায় করতে চাইছে বলে মনে করেন বিদ্যুৎ, জ¦ালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান।

এ বিষয়ে তিনি রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘এরই মধ্যে আমরা তাদের কয়েকবার বিল দিয়েছি, কিন্তু তারা কোনো কথা না শুনে বরং বারবার বিদ্যুৎ বন্ধের হুমকি দেয়Ñ এটি অবশ্যই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এর আগেও তারা এমনটি করেছে। হঠাৎ করে গত বছরের ২ অক্টোবর জানায়, ৭ নভেম্বর থেকে তোমাদের আর বিদ্যুৎ দেব না। এরপর থেকেই তারা সক্ষমতার অর্ধেক বিদ্যুৎ দেয় আমাদের। পরে তারা ৭৩২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ দেয়। পরে আবার একটি ইউনিটের উৎপাদন বন্ধ করে রাখে। সবই তাদের পলিসি। আমরা কারো বকেয়া না রাখতে বদ্ধপরিকর। কিন্তু এর জন্য বারবার হুমকি প্রদান সৌজন্যমূলক আচরণ নয়। তিনি বলেন, তারা খুব বেশি টাকা আমাদের কাছে পাবেও না। তবু কোম্পানিটির এমন ব্যবহার গ্রহণযোগ্য নয়।

বিপিডিবি বলছে, বর্তমান পরিস্থিতি ভিন্ন। আদানি যদি কঠোর অবস্থানে যায়, তাহলে বাংলাদেশও কঠোর অবস্থানে যাবে। আমাদের উৎপাদন সক্ষমতা পর্যাপ্ত পর্যায়ে রয়েছে। কোনো বিশেষ গোষ্ঠীকে সুবিধা দেওয়ার প্রয়োজন নেই জানিয়ে পিডিবির চেয়ারম্যান প্রকৌশলী রেজাউল করিম রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘এই কেন্দ্র শুধু বাংলাদেশে বিদ্যুৎ দেওয়ার জন্য তৈরি করা হয়েছে। বাংলাদেশে না দিতে পারলে কী করবে বিদ্যুৎ দিয়ে? যদিও সম্প্রতি তারা নিজেদের দেশেও কেন্দ্রটি থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করার বিধান রেখে নীতিমালা করেছে। এমনটা করলে তা চুক্তি ভঙ্গেরই শামিল। তাই বাংলাদেশ নয়, বরং তারাই চুক্তি ভঙ্গ করেছে বলে আমি মনে করি। যদি তারা আমাদের জিম্মি করে কোনো বিষয়ে, তাহলে চুক্তি পুনরায় পর্যালোচনা করতে আমরা বাধ্য হব।’

তিনি আরও বলেন, ‘আদানির ঋণ প্রদান একটি নিয়মিত বিষয়। প্রায় প্রতি মাসেই নিয়মিতভাবে আমরা তাদের ঋণ পরিশোধ করে আসছি। চলতি মাসেও ডলারপ্রাপ্তি সাপেক্ষে বকেয়া পরিশোধের চেষ্টা করা হচ্ছে। তাদের আমাদের কাছে বকেয়া আছে সেটা সত্যি। ২০২৩ সালের ডিসেম্বর থেকেই এই বকেয়া শুরু। এক দিনেই তো আর পরিশোধ সম্ভব নয়। দুই পক্ষের আলোচনায় এর সমাধানে আসা সম্ভব।

ভারতের আদানি গ্রুপের কেন্দ্র থেকে ২৫ বছরের জন্য বিদ্যুৎ কেনা চুক্তিটি প্রথম থেকেই ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। হয়েছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। প্রথমেই কয়লার অতিরিক্ত দর নিয়ে অভিযোগ উঠেছিল। পিপিএ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, শুধু কয়লার দাম নয়; করছাড়, ক্যাপাসিটি চার্জ, কয়লার ক্যালরিক ভ্যালু, কয়লা কেনা, কয়লা পরিবহন, বিদ্যুৎ কেনার শর্তসহ অনেক বিষয়েই আদানি বাড়তি সুবিধা ভোগ করবে।

খাতসংশ্নিষ্টরা বলছেন, এই বাড়তি সুবিধা না থাকলে বিদ্যুতের দাম কম হতো। তারা বলছেন, চুক্তির দুর্বলতার কারণে বাংলদেশকে অতিরিক্ত খরচের বোঝা ২৫ বছর টানতে হবে। জনস্বার্থে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে এই চুক্তি সংশোধন অথবা বাতিলের দাবিও তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা।

ক্যাপাসিটি চার্জ বেশি

আদানির সঙ্গে স্বাক্ষরিত পিপিএ ও সমমানের অন্য দুটি বিদ্যুৎ প্রকল্পের পিপিএ বিশ্লেষণে দেখা যায়, আদানির চুক্তিতে ক্যাপাসিটি চার্জ হিসাব করা হয়েছে ট্যারিফ ফর্মুলায়। ফলে পিপিএতে ক্যাপাসিটি চার্জ নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। পিপিএ অনুসারে ক্যাপসিটি চার্জের পরিবর্তনশীল অংশটি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কমে আসবে। প্রথম বছর প্রতি কিলোওয়াট/মাসে ক্যাপাসিটি চার্জ ধরা হয় ২১ দশমিক ৮৯২৭ মার্কিন ডলার। ২৫তম বছরে তা কমে হবে ১৪ দশমিক ৬২৭০ মার্কিন ডলার। ক্যাপসিটি চার্জের অপরিবর্তনশীল অংশটি আদানির পিপিএতে প্রতি কিলোওয়াট/মাসে ৩ দশমিক ৬৫ ডলার নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। কিন্তু পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের পিপিএতে ক্যাপাসিটি চার্জ নির্ধারণ করা হয়েছে কস্টপ্লাস ফর্মুলায়। এতে ক্যাপাসিটি চার্জ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কমে আসবে।

এসব বিষয় নিয়ে জ¦ালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামসুল আলম রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, চুক্তি অনুসারে বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ¦ালানি খরচ পিডিবি বহন করে, যা বিদ্যুতের দামের সঙ্গে যুক্ত থাকে। পিপিএতে এই জ¦ালানির মূল্য নির্ধারণের পদ্ধতি উল্লেখ করা থাকে। পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের পিপিএতে কয়লার দর নির্ধারণে ডিসকাউন্ট ফ্যাক্টর বিবেচনার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু আদানির চুক্তিতে এমন সুযোগ নেই। আদানির পিপিএর শিডিউল ৬-এর টেবিল সি’তে কয়লার দর নির্ধারণের ফর্মুলা দেওয়া আছে। এটি অনুসারে দর নির্ধারণে ইন্দোনেশিয়ান কোল ইনডেপ এবং নিউ ক্যাসেল ইনডেপের গড় হিসাব করা হবে। এ ছাড়া ৪ হাজার ৬০০ কিলোক্যালরির কয়লা ব্যবহার করলেও ৪ হাজার ৬০০ ও ৬ হাজার ৩২২ কিলোক্যালরির কয়লার মিশ্র দাম নিতে পারবে আদানি।

আদানির সঙ্গে চুক্তিটি অস্বচ্ছ বলে দাবি করেছে টিআইবিও। আদানির সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তি অসম, অস্বচ্ছ ও বৈষম্যমূলক উল্লেখ করে তা সংশোধন এবং প্রয়োজনে চুক্তি বাতিল করার পরামর্শ দিয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, চুক্তিটিতে আদানি গোষ্ঠীর স্বার্থকে এমনভাবে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে যে, বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাত এই প্রতিষ্ঠানের হাতে জিম্মি হয়ে গেছে। আমরা এটি আগেও বলেছি, এখনো বলছি। আমার দেশকে জিম্মি করে একটি কোম্পানি হয়রানি করবে, তা মেনে নেওয়া যায় না। অন্তর্বর্তী সরকার নিশ্চয়ই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!