বাংলাদেশ এখন এক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক মুহূর্তের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে। আগামী সপ্তাহে আদালতে বহুল আলোচিত জুলাই গণ-অভ্যুত্থান-সংক্রান্ত মামলার রায় ঘোষণার কথা রয়েছে। এদিনকে কেন্দ্র করে কার্যক্রম নিষিদ্ধদল আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ঢাকায় ‘লকডাউন’ কর্মসূচি ঘোষণা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উসকানিমূলক প্রচার, এবং নেতাকর্মীদের রাজধানীতে সমবেত হওয়ার নির্দেশ, সব মিলিয়ে রাজধানীসহ সারা দেশে উত্তেজনা বাড়ছে। এমন পরিস্থিতি যদি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তাহলে তা সহজেই নৈরাজ্যে রূপ নিতে পারে।
রায়ের দিনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের অবস্থান, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উত্তেজনাকর বার্তা, গুজব ও ভুয়া তথ্যের প্রচার, মাঠ পর্যায়ে সংগঠিত কর্মীদের মিছিল বা কর্মসূচি, এসবই সংঘর্ষের আশঙ্কা তৈরি করছে। এই পরিস্থিতিতে সাধারণ নাগরিকদের আতঙ্ক, যানবাহন চলাচলে বিঘœ, এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা দেখা দিতে পারে। সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় হলো, নির্বাচনের আগে এমন নৈরাজ্য তৈরি হলে পুরো প্রক্রিয়ার গ্রহণযোগ্যতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, গণ-অভ্যুত্থানে বিজয়ে দেশজুড়ে ছিল উল্লাসমুখর জনতার জোয়ার। রাস্তায় রাস্তায় আবেগাপ্লুত মানুষ করেছিল আনন্দ মিছিল। তবে গণ-অভ্যুত্থানের এক বছরের মাথায় ফ্যাসিবাদবিরোধীদের মধ্যে অনৈক্যের সুরে সেই আনন্দ আজ অনেকটা ফিঁকে হয়েছে। দেশজুড়ে চাঁদাবাজি, ছিনতাই, নিরাপত্তাহীনতা, জুলাই-মিত্র রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে চরম অনৈক্য; সংস্কার, পিআর, জাতীয় নির্বাচন, গণভোট এমনকি জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়েও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দ্বিমত প্রকট। তাদের এই দ্বিমত-অনৈক্যের সুযোগ নিয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করতে মগ্ন ফ্যাসিস্ট শক্তি ও তাদের দোসররা।
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিচার ছাড়া পরাজিত শক্তি সুযোগ পেলে তারা আগের চেয়ে ভয়ংকর হয়ে উঠবে। তারা যদি কোনোভাবে বিচারের সম্মুখীন না হয়ে রাজনৈতিক জায়গা করতে পারে তাহলে তা হবে ভয়াবহ।
রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্যের অভাব বা সংস্করণভিত্তিক বিভাজন যেকোনো ঘটনায় সুযোগ গ্রহণের পথ প্রসারিত করে। আওয়ামী লীগ এই সুযোগটাই কাজে লাগাতে চাচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যখন অনৈক্য পরিলক্ষিত হয়, তখন তা সাধারণ মানুষের ভোটাধিকার এবং গণতান্ত্রিক অনুশাসনকে সংকুচিত করে। তাই সব রাজনৈতিক নেতৃত্বকেই দায়িত্বশীলতা বজায় রেখে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। নির্বাচন বানচালের সব ষড়যন্ত্র অন্যদলগুলোর সঙ্গে হাতে হাত রেখে প্রতিহত করতে হবে। দেশের স্বার্থে অরাজকতা, ভাঙচুর, লকডাউনসহ যেকোনো আহ্বান সতর্কতার সঙ্গে সম্মিলিতভাবে প্রতিহত করতে হবে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এখন সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হলো, জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং রাজনৈতিক সহিংসতা প্রতিরোধ করা। তাদের প্রশিক্ষণ, গোয়েন্দা নজরদারি ও সমন্বিত পদক্ষেপ প্রশংসনীয়, তবে বাস্তব প্রয়োগে সতর্কতা আরও জরুরি। ইতোমধ্যে মানুষের নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার ও অপরাধীদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে। এ ছাড়া দেশের আইনশৃঙ্খলা সুষ্ঠু ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে এসপি-ওসি পদায়নে নিরপেক্ষতার বিষয়টি বেশ গুরুত্বসহকারে দেখা হচ্ছে, যাতে করে পুলিশে কোনো ধরনের রাজনৈতিক প্রভাব অথবা স্বজনপ্রীতির সিন্ডিকেট গড়ে না ওঠে।
অন্যদিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশনায় ঢাকার প্রবেশপথ, হোটেল, ছাত্রাবাসে তল্লাশি ও অভিযান চালছে। এর সবগুলোই ইতিবাচক। সরকারের উচিত, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নিরপেক্ষভাবে কাজ করার পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া এবং যেকোনো রাজনৈতিক প্রভাব থেকে তাদের মুক্ত রাখা।
এই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি হলো, উত্তেজনা না ছড়ানো, ভুল-তথ্য না ছড়ানো, এবং সাধারণ মানুষ যাতে গুজবে কান না দেয় সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এ লক্ষ্যে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সমন্বিত প্রস্তুতি নিতে হবে। যেকোনো মূল্যে নৈরাজ্য দমন করতে হবে।
আমরা আশা করব, হাসিনার রায়ের তারিখ ঘোষণার দিন আদালতপাড়াসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে অতিরিক্ত নিরাপত্তা জোরদার করবে সরকার। সেই সঙ্গে রায়কে কেন্দ্র করে সারা দেশে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা নাশকতা ও বিশৃঙ্খলা প্রতিরোধে সতর্ক ও কঠোর অবস্থানে থাকবে। দেশের মাটিতে কোনো রাজনৈতিক দলের কথিত লকডাউনের নামে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে আসন্ন নির্বাচন বানচালের যে চিন্তা তা শক্ত হাতে প্রতিরোধ করবে সরকার।

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন