বাংলাদেশের ইতিহাসের মোড় ঘোরানো দিন ৭ নভেম্বর জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস। ১৯৭৫ সালের এই দিনে জিয়াউর রহমান মুক্তির মশাল হয়ে জ্বলে উঠেছিলেন ব্যারাক থেকে সাধারণের অন্তরে। যদিও পরবর্তীতে তার স্মৃতি মুছে ফেলতে নানা ষড়যন্ত্র হয়েছে। তবে সে জাল ছেড়ে জিয়াউর রহমান জায়গা করে নিয়েছিলেন সাধারণের অন্তরে। মুজিব সরকারের অদুর্দশিতা আর অব্যবস্থাপনায় আসার আলো দেখেন জিয়াউর রহমান। ‘আমি মেজর জিয়াউর রহমান, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে আমি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি।
একাত্তরে জিয়াউর রহমানের এই ঘোষণায় বাংলার মানুষ প্রতিরোধের দেয়াল গড়ে তোলে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। অথচ মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম নায়ককে খলনায়ক বানানোর এমন কোনো চেষ্টা নেই যা করেনি স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকার। ১৯৭৫-এর নভেম্বর মাসের শুরুতে যে অনিশ্চয়তা শঙ্কা ঘিরে ধরেছিল দেশকে, তার অবসান হয় ৭ নভেম্বর। রেডিওতে তখন জিয়াউর রহমানের মুক্তির খবর প্রচার হতে থাকে। বাড়তে থাকে তার জনপ্রিয়তা। প্রদীপের আলোয় চলে আসেন তিনি। জাসদের কর্নেল তাহের জিয়ার কাঁধে বন্দুক রেখে ক্ষমতার পাখি শিকার করতে চেয়েছিলেন। সপ্তাহের মধ্যে সামরিক শাসন তুলে নেওয়া হবে। ঘটনা প্রবাহের শেষ অংকে জেনারেল জিয়াউর রহমান নেতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। সবকিছু চলে যায় তার নিয়ন্ত্রণে। সেনাবাহিনী ও জনসাধারণের জনপ্রিয় ছিলেন জিয়া। যে কারণে শেষ পর্যন্ত কর্নেল তাহের টিকতে পারেননি। ৭ নভেম্বর জাতির উদ্দেশে দেওয়া বার্তায় জিয়াউর রহমান বলেছিলেন, দেশের ক্রান্তি লগ্নে সাময়িকভাবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের চিফ মার্শাল ল এডমিনিস্ট্রেটর ও সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করতে হয়েছে। তাকে গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছিল। এটার কাউন্টার হিসেবে ৭ নভেম্বর একটা ক্যু হয়, যেটা সিপাহি জনতার ক্যু হিসেবে পরিচিত। বিপ্লব ও সংহতি দিবস হিসেবে পরিচিত।
৭ নভেম্বর জিয়াউর রহমানের সমর্থনে সামরিক বাহিনীর সদস্যদের পাশাপাশি রাজপথে নেমে আসেন সাধারণ মানুষ। শুধু স্বাধীনতার ঘোষণাই নয়, স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরুতে জিয়াউর রহমান বিদ্রোহ করে রণাঙ্গনে লড়াই করেন। ভাগ্য সাহসীদের সঙ্গে থাকেন। ১৯৭৫-এর নভেম্বরে তার বন্দি দশা থেকে মুক্তি রাষ্ট্র ক্ষমতার চূড়ান্ত ধাপে এগিয়ে দেয়।
জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বের বিশেষত্ব ছিল তার দৃঢ়তা ও বাস্তববাদে। তিনি ছিলেন না তাত্ত্বিক রাজনীতিক; ছিলেন এক কর্মঠ সৈনিক, যিনি সংকটে সিদ্ধান্ত নিতে জানতেন। মুক্তিযুদ্ধে তার নেতৃত্বই ছিল তার প্রমাণ, যখন তিনি চট্টগ্রামের কালুরঘাট থেকে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করে জাতিকে আশার আলো দেখান। ৭ নভেম্বরের ঘটনাপ্রবাহে তিনি আবারও সেই ভূমিকা নেন, এবার একটি বিপর্যস্ত রাষ্ট্রকে নতুন দিকনির্দেশনা দিতে। তার প্রতি সৈনিকদের আস্থা এবং জনগণের সমর্থন, এই দুই শক্তিই মিলেছিল এক সংহতির মঞ্চে।
‘বিপ্লব ও সংহতি দিবস’ কেবল রাজনৈতিক পালাবদলের দিন নয়; এটি ছিল বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের নবজন্ম। জিয়াউর রহমান উপলব্ধি করেছিলেন যে মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী রাষ্ট্রকে বাঁচাতে হলে প্রয়োজন নতুন আদর্শ, নতুন চেতনা। তাই তিনি ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’-এর ধারণা দেন, যা ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি ও ভূখ-ের ঐক্যকে একত্রিত করে। তার এই দর্শন ছিল আত্মমর্যাদার রাজনীতি, যেখানে বিদেশনির্ভরতা নয়। আত্মনির্ভরতা ছিল মূল মন্ত্র। অর্থনীতিতে তিনি কৃষি, গ্রামীণ উন্নয়ন ও স্বনির্ভরতার ওপর জোর দেন। ‘গ্রামে ফিরে যাও’ স্লোগান ছিল তার জনসংযোগমূলক কর্মসূচি, যার মাধ্যমে তিনি সাধারণ মানুষের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করেন। স্বল্প সময়ে তিনি প্রশাসনে শৃঙ্খলা ফেরান, অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আনেন এবং বৈদেশিক নীতিতে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করেন। বিশ্বের বিভিন্ন শক্তির সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করে তিনি বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক মঞ্চে মর্যাদার আসনে বসান।
নিছক রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ পেরিয়ে যদি রাষ্ট্রগঠন ও নেতৃত্বের নিরিখে বিচার করা হয়, তবে জিয়া ছিলেন এক সফল সংগঠক, একজন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাষ্ট্রনায়ক। ৭ নভেম্বর তাকে যে আস্থা ও দায়িত্বে প্রতিষ্ঠিত করেছিল, তা কেবল সামরিক ঘটনার পরিণতি নয়, এটি ছিল জাতির নেতৃত্বে এক নতুন দিগন্তের সূচনা।
আজকের বাংলাদেশে যখন রাজনৈতিক বিভাজন, সামাজিক অবিশ্বাস ও আদর্শের সংকট প্রকট হয়ে উঠছে, তখন বিপ্লব ও সংহতি দিবস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় ঐক্যের শক্তি। জিয়াউর রহমান সেই ঐক্যের প্রতীক হয়ে ইতিহাসে অমর। তার নেতৃত্ব দেখিয়েছে, জাতিকে নেতৃত্ব দিতে হলে কেবল ক্ষমতার নয়, চেতনার দিকনির্দেশনা দিতে হয়।
বিএনপি বাংলাদেশের রাজনীতিতে এমন একটি দল, যার জন্মই হয়েছিল জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার আদর্শ নিয়ে। ১৯৭৮ সালে শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ‘বহুদলীয় গণতন্ত্র’-এর ভিত্তি স্থাপন করেন। তার আদর্শ ছিল জনগণের ক্ষমতায়ন, অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা ও জাতীয় ঐক্যের রাজনীতি। তিনি বিশ্বাস করতেন, গণতন্ত্র মানে কেবল ভোট নয়, বরং জনগণের মতামত ও অংশগ্রহণের মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনা। সেই আদর্শকে আজও লালন করছেন তারই উত্তরসূরি, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
বিগত ১৬ বছর ধরে আওয়ামী লীগ সরকার বিএনপির ওপর যে নিপীড়ন-নির্যাতন চালিয়েছে, তা বাংলাদেশে রাজনৈতিক সহনশীলতার পরিপন্থি। হাজারো নেতাকর্মীকে গুম, খুন, মিথ্যা মামলায় জেলে পাঠানো হয়েছে। গণতন্ত্রের প্রধান শক্তি, বিরোধী দলের রাজনীতিকেই দমন করার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে প্রশাসন, আইন ও বিচারব্যবস্থা। ভোটারবিহীন নির্বাচন, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও বাকস্বাধীনতার ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণে দেশ আজ রাজনৈতিক অচলাবস্থার মুখে।
বিপ্লব ও সংহতি দিবসের প্রতিজ্ঞা হোক সংকট থেকে উত্তরণের। দেশের জনগণ চায় একটি নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন, যেখানে সব দল সমান সুযোগে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারে। গণতন্ত্রের পুনরুদ্ধারই জাতির একমাত্র পথ। তাই বর্তমান সরকারের উচিত শর্তের বেড়াজালে কালক্ষেপণ না করে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করে। দ্রুত নির্বাচন আয়োজন করা, যাতে জনগণ তাদের ভোটের মাধ্যমে নেতৃত্ব বেছে নিতে পারে। মেজর জিয়াউর রহমানের গণতান্ত্রিক আদর্শ ও তারেক রহমানের নেতৃত্বে বিএনপি আবারও জনগণের রাজনীতি ফিরিয়ে আনতে প্রস্তুত, যেখানে থাকবে স্বাধীনতা, ন্যায় ও জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি।
৭ নভেম্বর তাই শুধুই অতীতের দিন নয়, এটি জাতির আত্মমর্যাদার ঘোষণাপত্র। ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে সার্কিট হাউসে সেনাবাহিনীর একদল বিপথগামী সদস্যের হাতে নির্মমভাবে নিহত হন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান।
মার্কিন বিপ্লবী ফ্রেডেরিক অ্যালেন হাম্পটন সিনিয়র বর্ণবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের পথিকৃত হিসেবে বিশ^জুড়ে স্বীকৃত। তিনি বলতেন, তুমি একজন বিপ্লবীকে মেরে ফেলতে পার, কিন্তু বিপ্লবকে মেরে ফেলতে পারবে না। সত্যিই তাই। বিপ্লব চিরঞ্জীব। জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবসের ইতিহাসও তাই অমোচনীয়, অনস্বীকার্য। জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে শুরু হয়েছিল যে আত্মবিশ্বাসের যুগ, সেটি আজও আমাদের রাষ্ট্রচিন্তায় অনুপ্রেরণা জোগায়। যতদিন বাংলাদেশ বাঁচবে, ততদিন বিপ্লব ও সংহতির এই চেতনা, আর তার স্থপতি মেজর জিয়াউর রহমান, ইতিহাসের প্রেরণার আলো হয়ে জ্বলবে।

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন