রবিবার, ২৭ জুলাই, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


আফরান হোসাইন রাফি

প্রকাশিত: জুলাই ২৭, ২০২৫, ০১:৫৮ এএম

নশ্বর জীবনে অমর তারা

আফরান হোসাইন রাফি

প্রকাশিত: জুলাই ২৭, ২০২৫, ০১:৫৮ এএম

নশ্বর জীবনে অমর তারা

কিছু মানুষ থাকেন, যারা আসেন নীরবে। কাজ করেন নিঃশব্দে এবং চলে যান দায়িত্ব শেষ করে। কিন্তু যাওয়ার পথে রেখে যান এমন কিছু, যা কখনো ভুলে যাওয়া যায় না। অন্য সবার মতো নিজের পরিবার, নিজের কাজ, ছোট ছোট স্বপ্ন; সবকিছুই থাকে তাদের। কিন্তু সময়ের বিশেষ এক মুহূর্তে তারা এমন সব সিদ্ধান্ত নেন, যা মুহূর্তেই তাদের আলাদা করে দেয় বাকিদের থেকে। আমরা তাদের মনে রাখি, শ্রদ্ধা করি; কারণ তাদের কাজ আমাদের চিন্তার গতি নাড়িয়ে দেয়। সম্প্রতি এমনই দুই মহীয়সী নারীকে দেখল বাংলাদেশের মানুষ। যারা শিক্ষার্থীদের জন্য নিজের সবটুকু দিয়ে গেলেন নিঃসংকোচে। আর নিজেরা হয়ে উঠলেন নশ্বর জীবনে অমর। এই দুই মহীয়সী নারীকে তুলে ধরেছেন মির্জা হাসান মাহমুদ এবং আরফান হোসাইন রাফি 


মাহরীন চৌধুরী  
গত সোমবার দুপুরে রাজধানী ঢাকায় ঘটে এক ভয়াবহ দুর্ঘটনা। ঘটনাটা ঘটে রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুলের প্রাইমারি সেকশনে। দুপুরের দিকে, সবে ক্লাস শেষ হয়েছে। শিক্ষার্থীরা ধীরে ধীরে ক্লাসরুম ছেড়ে বের হচ্ছে। কেউ আবার বসে আছে বাবা-মায়ের অপেক্ষায়। কেউ হয়তো বন্ধুদের সঙ্গে খেলায় মত্ত। তারা কেউ জানত না, একটু পর কী হতে চলেছে! ঠিক তখনই বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে স্কুলের ভবনে আছড়ে পড়ে। বিধ্বস্ত বিমান থেকে মুহূর্তেই চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে আগুন। ছড়িয়ে পড়ে উত্তপ্ত ধোঁয়া এবং শিশুদের আতঙ্ক। অনেকেই ঘটনাস্থল থেকে ছুটে পালাতে ব্যস্ত। ভেতরে থাকা শিশুরা ধোঁয়ার কু-লীর ভেতর ভয় পেয়ে অসহায় হয়ে পড়ে। এদিকে আগুন ছড়িয়ে যেতে শুরু করে সময়ের গতিতে। সেই ভয়ঙ্কর মুহূর্তে সাহসী প্রাণের অবিশ্বাস্য উদাহরণ হয়ে উঠলেন সেই স্কুলের শিক্ষিকা মাহেরীন চৌধুরী। আতঙ্কে সবাই হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেললেও, দুই সন্তানের জননী মাহেরীন চৌধুরী ভুলে যাননি মায়ের দায়িত্ব। ছাত্রছাত্রীদের নিজের সন্তান মনে করে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েন জলন্ত আগুনের মধ্যে। প্রথমেই তিনি কাছের কয়েকজন শিশুকে বাইরে বের করে আনেন। তারপর আবার ঢুকে পড়েন ভবনের ভেতর। নিজের জীবনের চিন্তা না করে একজন শিক্ষক হয়ে, একজন আদর্শ মানুষ হয়ে, একজন মা হয়ে সন্তানদের বাঁচাতে আবারও ফিরে যান আগুনের ভেতর। এ সাহসিকতার মূল্য যে কী ভয়াবহ হতে পারে, তা হয়তো তিনি জানতেন। জানার পরও তিনি পিছিয়ে যাননি। দ্বিতীয়বার ভবনে ঢোকার পর নির্মম আগুনে মারাত্মকভাবে দগ্ধ হন মাহেরীন। পরে তাকে জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে নেওয়া হলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। কিন্তু ভয়াবহ এই দুর্ঘটনায় তিনি নিজের জীবন হারলেও রক্ষা করেছেন অন্তত ২০ জন শিক্ষার্থীর প্রাণ। মাইলস্টোনে দীর্ঘ ১৭ বছর শিক্ষকতা করেছেন মাহেরীন চৌধুরী। একসময় ছিলেন সিনিয়র শিক্ষক। পরে দায়িত্ব নেন প্রশাসনিক কাজেরও। যে ভবনে বিমানটি বিধ্বস্ত হয়, তার কো-অর্ডিনেটর ছিলেন তিনি। প্রতিদিনের মতোই ক্লাস শেষে শিক্ষার্থীদের নিরাপদে বের করে দেওয়ার সময় দুর্ঘটনাটি ঘটে। তিনি ভাবেননি কখনো এমন কিছু ঘটবে। কিন্তু যখন ঘটল, তখন তিনি নিজের জীবনের বিনিময়ে ছাত্রদের জীবন বাঁচানোর মতো সাহস দেখিয়েছেন। সেই ঘটনায় তার শরীরের প্রায় ১০০ শতাংশই পুড়ে গিয়েছিল। তবু মৃত্যুর আগে নিজ স্বামীর সঙ্গে কিছু কথা বলতে পেরেছিলেন তিনি। সেই আবেগঘন মুহূর্তে স্বামী তাকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘তুমি তোমার ছেলেদের এতিম করে দিলে?’ মাহেরীন কেঁদে বলেছিলেন, ‘ওরাও তো আমার বাচ্চা ছিল।’ মৃত্যুর আগে এ কথা মানুষ হিসেবে তার অবস্থানটাকে বুঝিয়ে দেয়। নিজের জীবন দিয়ে তিনি প্রমাণ করে গেলেন, শিক্ষকের পরিচয় শুধু পাঠদানে সীমাবদ্ধ থাকে না। অনেক শিক্ষক তাদের দায়িত্ব এমনভাবে নেন, যেন ছাত্রছাত্রীরাও তাদের নিজের সন্তান। এই দায়িত্ববোধ থেকে কেউ পালিয়ে বেড়ায়, কেউ আবার মাহেরীনের মতো জীবনের ঝুঁকিও নিয়ে ফেলেন। সে দিন তার মৃত্যুর খবর শোনার পর শিক্ষার্থী, অভিভাবক, সহকর্মীসহ পুরো দেশবাসীর মধ্যে গভীর শোক নেমে আসে। সবাই এমন কাজ করতে পারে না। সবাই পারে না নিজের স্বার্থ ভুলে অন্যের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তে। তাই মাহেরীন চৌধুরীর এ কাজ ভুলে যাওয়ার মতো নয়। এমন মানুষ যুগে যুগে একবার আসেন। হয়তো তারা শারীরিকভাবে অমর হয়ে থাকেন না, কিন্তু তারা থেকে যান তাদের কাজের মধ্য দিয়ে, তারা থাকেন মানুষের অন্তরে। আমরা তাদের স্মরণ করি আবেগ নিয়ে, শ্রদ্ধা নিয়ে। 


মাসুকা বেগম
শিক্ষক হিসেবে মাসুকা বেগম ছিলেন অতুলনীয়। মানুষের জীবনপথ বেছে নেওয়ার মুহূর্তে অনেকেই নিজেকে জিজ্ঞেস করেন, ‘আমি কী হতে চাই?’ মাসুকা বেগমের সেই উত্তর বহু আগেই জানা ছিল, তিনি হতে চেয়েছিলেন একজন শিক্ষক। ছোটবেলায় স্কুল ইউনিফর্ম পরা মেয়েটি স্বপ্ন দেখতেন, একদিন তিনি শিক্ষক হবেন এবং কলম হাতে তুলে পনবেন মানুষ গড়ার দায়িত্ব। সেই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে মাসুকা বেগমের কাছে শিক্ষকতা কেবল একটি পেশা ছিল না, ছিল ব্রত। সেই কারণেই তিনি নিজের জীবনের বহু সম্ভাবনার দরজায় নিজেই তালা ঝুলিয়েছেন। একদিন নিজের ইচ্ছাতেই বলেছিলেন, ‘বিয়ে করব না। শিক্ষার্থীরাই আমার সন্তান।’ এই একটি বাক্যে তিনি নিজেকে পরিণত করেছিলেন, নিঃস্বার্থ মমতার প্রতীক এক মায়ের রূপে, যার মাতৃত্ব রক্তসূত্রে নয়, গড়ে উঠেছিল সম্পর্ক আর দায়বদ্ধতার আশ্চর্য বন্ধনে। মাসুকা বেগম ছিলেন, ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক। চার বছর আগে রাজধানীর উত্তরা এলাকায় অবস্থিত মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। সেখানে প্রতিদিন তার কাজ ছিল পাঠদান আর শিক্ষার্থীদের কাছে জ্ঞানের আলো পৌঁছে দেওয়া। কিন্তু তিনি শুধু শিক্ষা দেননি, দিয়েছেন সাহস, ভালোবাসা আর নিরাপত্তার আশ্বাস। যেটুকু সময় তিনি কক্ষের ভেতর কাটিয়েছেন, সেটুকু সময় তিনি শিক্ষার্থীদের কাছে ছিলেন ঠিক ততটাই গুরুত্বপূর্ণ, যতটা একজন মা সন্তানের কাছে। গত সোমবার দুপুরের সময় যখন বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সজোরে আছড়ে পড়ে মাইলস্টোন স্কুলের একটি ভবনে। তখন সেই ভবেনের এক কক্ষেই ক্লাস নিচ্ছিলেন মাসুকা বেগম।  চারদিকে আগুনের লেলিহান শিখা যখন ঝলসে দিচ্ছিল শিক্ষার্থীদের কোমল শরীর, তখন তিনি শিক্ষার্থীদের বলছিলেন ‘তোমরা ভয় পেও না। আমি আছি।’ এরপর তিনি একে একে শিক্ষার্থীদের বের করে আনতে থাকেন। ঘটনার একপর্যায়ে তিনি নিজেও আগুনে গুরুতর দগ্ধ হন। তার শরীরের প্রায় ৮৫ শতাংশের পুড়ে যায়। তারপর কেউ খোঁজ পাচ্ছিলেন না তার। পরিবারের কাছে ফোনে এক সহকর্মী শুধু বললেন, ‘মাসুকা আহত হয়েছেন।’ এরপর শুরু হয় আত্মীয়স্বজন আর সহকর্মীদের ছুটে বেড়ানো। ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে খোঁজ নেওয়া, উদ্বেগ, কান্না, আর প্রার্থনা। শেষ পর্যন্ত রাত ৯টার দিকে জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউট একটি তালিকা প্রকাশ করে, সেই তালিকায় ছিল মাসুকার নাম। ৮৫ শতাংশ দগ্ধ শরীর, কণ্ঠনালিও পুড়ে গেছে। ডাক্তারদের মুখেই তখন আশাভঙ্গের অন্ধকার। এরপর রাত সাড়ে ১২টায় আনুষ্ঠানিকভাবে খবর আসে, মাসুকা বেগম আর নেই। তবে এর আগেই তার সহকর্মীরা জেনে গিয়েছিলেন, মৃত্যুর আগে কী করেছিলেন তিনি। ভীত-সন্ত্রস্ত শিক্ষার্থীদের আগুনের ভেতর থেকে বের করে আনার সময়ই তিনি দগ্ধ হন। একবার নয়, একাধিকবার ভবনের ভেতরে ঢুকেছেন তিনি, শিশুদের বাঁচানোর তীব্র চেষ্টা আর মা হয়ে জড়িয়ে ধরতে তার সন্তানদের। শেষবার বেরিয়ে আসার পর তিনি হয়তো জানতেন না, এটাই তার জীবনের শেষ মুহূর্ত। মাসুকা বেগমের মৃত্যু কেবল একজন শিক্ষক হারানোর বেদনা নয়। এটা একজন মানুষের জীবনের শেষ অধ্যায়, যা শুরু হয়েছিল ভালোবাসা দিয়ে এবং আত্মত্যাগে। একজন শিক্ষকের সাহস, ভালোবাসা এবং আত্মত্যাগের যে অনন্য উদাহরণ তিনি রেখে গেলেন, তা আমাদের সামনে নতুনভাবে উন্মোচন করে শিক্ষকের সংজ্ঞা। শিক্ষক মানে শুধু বইয়ের পাতায় শেখানো ব্যক্তি নয়, শিক্ষক মানে এমন কেউ, যিনি প্রয়োজন হলে আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়েন, নিজের জীবন দিয়ে শিক্ষার্থীদের রক্ষা করেন এবং প্রমাণ করেন এখানেই একজন শিক্ষকের সত্যিকারের সার্থকতা।

রূপালী বাংলাদেশ

Shera Lather
Link copied!