ঢাকা রবিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

শতবর্ষী ডা. গৌরাঙ্গ লাল সেন এবং তার রেখে যাওয়া চিহ্ন

সব্যসাচী দাশ
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৪, ২০২৫, ০১:০৫ এএম

গত বছর যখন অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন রেকর্ড বুকে তার বয়স লেখা হয় ৯৫ বছর। ডা. গৌরাঙ্গ লাল সেনের জাতীয় পরিচয়পত্রে জন্ম সাল ১৯৩০, প্রকৃত পক্ষে তার বয়স আরও বেশি। তার ভাইয়েরা বলেন, বড়দার জন্ম ১৯২৩ সালে। এই বিদগ্ধ মানুষটি তিনকাল পার করে গত ২৯ জুলাই অনন্তলোকে যাত্রা করেন। সময় বলছে ১০২ বছর আয়ুষ্কালের জীবন তার! কেউ একজন বলেছিলেন, জীবন দৈর্ঘ্য নয়, প্রস্থে বড় হওয়া দরকার। প্রথম শুনে কথাটা আমারও সঠিক বলে মনে হয়েছে। কিন্তু, কারো কারো ক্ষেত্রে জীবনের দৈর্ঘ্যরে সঙ্গে প্রস্থেরও বড় হওয়া দরকার। সেদিন ছিল সোমবার। শাওন রাত। অন্যদিনের মতো অঝরে ঝরছে ক্লান্তিহীন বৃষ্টি। গত কয়েক দিন ধরে তিনি ছিলেন অসুস্থ। জ্বর, সঙ্গে পেট খারাপ। এমনিতে তার এ দীর্ঘ জীবনে উচ্চ রক্তচাপ, বহুমূত্র কিংবা হৃদয়ের অসুখের মতো শহুরে রোগ শরীরে বাসা বাঁধেনি। বলা যায়, নিরোগ ছিলেন।

শেষের দিকে বার্ধক্যে তাকে কাহিল করতে পারেনি। বাড়ি থেকে তিন কিলোমিটার পথ পারি দিয়ে নিজের চেম্বারে বসতেন, নিয়মিত। সন্ধ্যায় রোগী দেখতেন বাড়িতে। রাতে নিয়মিত বই পড়তেন। গৌরাঙ্গ লাল সেনের বাড়ি পিরোজপুর জেলার কাউখালী উপজেলার গান্ডতা গ্রামে। বর্তমান সময়ের সঙ্গে বিবেচনা করলে গান্ডতা এখন শহরতলি গ্রাম বলা চলে। অথচ দুই দশক আগেও এ গ্রাম ছিল অজোপাড়া গাঁ! বিদ্যুৎ, রাস্তাঘাট, চিকিৎসা ব্যবস্থা এসব ছিল কল্পনাতীত। এখন পাকা রাস্তা, বিদ্যুৎ এমনকি ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট বাড়ি বাড়ি পৌঁছে গেছে। সেই দারুণ সময়ে গৌরাঙ্গ লাল সেন হেঁটে কাউখালী সদর আসতেন, রোগী দেখতেন।

কখনো কখনো রোগীর বাড়ি গিয়ে চিকিৎসা দিয়ে আসতেন। দীর্ঘ সময় ওই এলাকার অনেক মানুষের কাছে তিনি ছিলেন অন্ধের যষ্ঠি। ভাবা যায় সেই সময়ে ওইসব গ্রামীণ জনপদে রাত-দুপুরে কেউ অসুস্থ হলে প্রাথমিক কিংবা ন্যূনতম চিকিৎসার কি ব্যবস্থা ছিল! বেশির ভাগ খারাপ রোগীর ক্ষেত্রে অদৃষ্টের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। ডা. গৌরাঙ্গ লাল সেন এবং তার হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার বদৌলতে অনেক মানুষের জীবনরেখার দৈর্ঘ্য বেড়েছে।

মানুষ তাকে ভোলেনি। রাতে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে খবর পৌঁছে যায় ডা. ডাক্তার গৌরাঙ্গ লাল সেন মারা গেছেন। যার সুযোগ ছিল ওই বৃষ্টিবিঘিœত রাতে এসে উপস্থিত হয়েছেন। রাত পোহাবার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ আসতে শুরু করে, দীর্ঘ দিনের সুহৃদ থেকে কাছে দূরের বহুজন। এদিকে থেমে থেমে পাল্লা দিয়ে চলছে বৃষ্টি। ঘোর শ্রাবণ বলে কথা! ফর্সা পাতলা দীর্ঘদেহী সুপুরুষ ছিলেন ডা. গৌরাঙ্গ লাল সেন। মরদেহ ঘরে ঢুকতেই প্রথম কক্ষে রাখা ছিল। বহু মানুষ জানালায় উঁকি দিয়ে, দরজার সামনে দাঁড়িয়ে শেষবারের মতো দেখে গেছে। যে মানুষ দীর্ঘদিন তাদের অসুখের দুঃখ লাঘব করেছে। অবশেষে দুপুর সাড়ে ১২টায় জ্বলতে শুরু করে ডা. সেনের শ্মশান।

জোয়ার এসে থেমে গেছে। চারদিক জলে থই থই। ঘণ্টা তিনেকের বৃষ্টি বিরতি। সন্তান, আত্মীয়স্বজন জ্বলন্ত চিতায় চন্দন কাঠ আম্রপল্লবের অঞ্জলি জ্ঞাপন করছে। যারা তার সম্প্রদায়ের নয় কিন্তু তার প্রতি অদৃশ্য টান অনুভব করেন। তাদের অনেকেই দায় সারতে পারেননি ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলেন চিতার আগুন নেভার পূর্বক্ষণ পর্যন্ত। দাহপর্ব শেষ। বাড়ির সবাই স্নান করে নিমপাতা কামড়ে ঘরে ঢুকেছে। সারা দিন মেঘের পেছনে থেকে ক্লান্ত সূর্য পাটে বসেছে। বাড়ির কাঁচা রাস্তা পেরিয়ে বড় রাস্তায় ওঠে প্রবীণ একজন বলছেন গৌরাঙ্গ দা এই এলাকার লাঠি ছিল। তাকে ধরেই আমরা এতটা পথ চলেছি। চলো নামাজের সময় হয়েছে।