মানুষের হাতে থাকা টাকা আবার ব্যাংকে ফিরছে। এতে বাড়ছে ব্যাংকের আমানত। সরকার পরিবর্তনকে কেন্দ্র করে অস্থিরতা এবং উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে বিদায়ী অর্থবছরের বেশিরভাগ সময়েই আমানত প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশের নিচে ছিল। তবে চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে আমানতে বড় প্রবৃদ্ধি হয়েছে। যা প্রায় সাড়ে ৮ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন বিশ্লেষণে এই তথ্য জানা গেছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জুলাই মাস শেষে ব্যাংকে মোট আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৮ লাখ ৮০ হাজার ১০৭ কোটি টাকা। আগের বছরের একই সময়ে যা ছিল ১৭ লাখ ৩৪ হাজার ২৬ কোটি টাকা। সেই হিসাবে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ব্যাংক আমানত বেড়েছে ১ লাখ ৪৬ হাজার ৮১ কোটি টাকা বা ৮ দশমিক ৪২ শতাংশ।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২৪ সালের জুনে ব্যাংক খাতে আমানত প্রবৃদ্ধি ছিল ৯ দশমিক ২৫ শতাংশ। তবে সরকার পরিবর্তনের পর থেকেই এই প্রবৃদ্ধি ধারাবাহিকভাবে কমতে থাকে। ২০২৪ সালের আগস্টে তা নেমে দাঁড়ায় মাত্র ৭ দশমিক শূন্য ২ শতাংশে, যা ছিল আগের ১৮ মাসের মধ্যে সর্বনি¤œ। তবে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এই হার ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করে এবং তার ধারাবাহিকতায় মার্চ মাসে ৯ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি রেকর্ড হয়েছে। এপ্রিলে সেই ধারা অব্যাহত থাকলেও মে মাসে তা আবার কমে যায়। জুনেও একই প্রবৃদ্ধির ধারা বজায় ছিল। সবশেষ গত জুলাই মাসে তা আবার বেড়ে ৮ দশমিক ৪২ শতাংশ হয়েছে।
ব্যাংকিং ব্যবস্থায় নানা ধরনের অনিয়মে এমনিতেই গ্রাহকের আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। এরপর সরকার পরিবর্তনকে কেন্দ্র করে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হলে ব্যাংক থেকে আমানতের টাকা তোলার চাপ বাড়ে। এতে মানুষের হাতে টাকা ধরে রাখার পরিমাণ বাড়ে, অন্যদিকে ব্যাংকের আমানত কমতে থাকে। তবে চলতি অর্থবছরের শুরুতে পরিস্থিতি আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে ঘরের টাকা ব্যাংকে ফিরতে শুরু করেছে। ফলে ব্যাংকে আমানত বাড়ছে।
এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘উচ্চ মূল্যস্ফীতি, সরকার পরিবর্তনকে কেন্দ্র করে চলমান অনিশ্চয়তা এবং বেশ কয়েকটি ব্যাংকের পর্ষদ পুনর্গঠনের প্রভাবে মানুষ ব্যাংক থেকে টাকা তুলে হাতে ধরে রেখেছে। ফলে আমানত অস্বাভাবিক হারে কমে গিয়েছিল। আর ব্যাংকের বাইরে রাখা টাকার পরিমাণ বাড়ছিল। তবে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের নানা উদ্যোগে ব্যাংক খাতের প্রতি মানুষের আস্থা ফিরতে শুরু করেছে। ফলে গ্রাহকদের মধ্যে যারা অতিরিক্ত টাকা তুলেছিলেন, সেই টাকা আবার ব্যাংকে রাখতে শুরু করেছেন। আবার সুদের হার বাড়ায় নতুন আমানতও ব্যাংকে আসছে। তবে তার পরিমাণ খুব বেশি না। কারণ দীর্ঘদিন ধরে মানুষ উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে রয়েছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে বেকারত্ব। এ কারণে সঞ্চয়ের সক্ষমতা কমে যাচ্ছে। ফলে ব্যাংকের আমানতও প্রত্যাশা অনুযায়ী বাড়ছে না। আমানত না বাড়লে বিনিয়োগ বাড়বে না। আর বিনিয়োগ না বাড়লে কর্মসংস্থান বাড়বে না, আয় বাড়বে না, সঞ্চয়ও বাড়বে না। ফলে অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি সংকট তৈরি হবে। বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য স্থিতিশীল বিনিয়োগ পরিবেশের ওপর জোর দেন তিনি।
ব্যাংকাররা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নর আহসান এইচ মনসুর দায়িত্ব নেওয়ার পর পরিস্থিতি কিছুটা বদলাতে শুরু করে। তার নেতৃত্বে অন্তত ১৫টি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন, টাকা ছাপিয়ে তারল্য সহায়তা এবং বেনামি ঋণ বন্ধে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়। যদিও এসব উদ্যোগে সব দুর্বল ব্যাংকের অবস্থার উন্নতি না হলেও অবনতি ঠেকানো সম্ভব হয়েছে। গভর্নরের ভাষ্য অনুযায়ী, ইসলামী ও ইউসিবি ব্যাংকের অবস্থান আগের তুলনায় কিছুটা ভালো হয়েছে। একই সঙ্গে ভালো অবস্থানে থাকা ব্যাংকগুলোর প্রতি গ্রাহকদের আস্থা বাড়ায় সেগুলোতে আমানতও বাড়তে শুরু করেছে। এ ছাড়া, অনেক ব্যাংক আমানত টানতে ১৪ শতাংশ পর্যন্ত সুদহার দিচ্ছে। সব মিলিয়ে ব্যাংকের আমানত আবার বাড়তে শুরু করেছে।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, কয়েকটি দুর্বল ব্যাংকে আমানত কমলেও সবল ব্যাংকগুলোতে আমানত বেড়েছে। আমানত বৃদ্ধির তালিকায় যেসব ব্যাংক রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- সিটি, ব্র্যাক, পূবালী, ইস্টার্ন, যমুনা, ট্রাস্ট, প্রাইম এনসিসি, মিউচুয়াল ট্রাস্ট, ডাচ্-বাংলা, শাহজালাল, উত্তরা, যমুনা, মিডল্যান্ড, সিটিজেন ব্যাংক।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অভিজ্ঞ ব্যাংকার ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নুরুল আমিন বলেন, ব্যাংকই একমাত্র মাধ্যম যেখানে আমানত রাখা যায়, ঋণ নেওয়া যায়, আমদানি-রপ্তানিসহ সব ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করা যায়। ফলে মানুষ খুব বেশি দিন ব্যাংকের বাইরে টাকা রাখতে পারবে না। ব্যাংকে আসতেই হবে। তবে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক যেসব দুর্বল ব্যাংক চিহ্নিত করে পর্ষদ পুনর্গঠন করে দিয়েছে, সেসব ব্যাংকে টাকা উত্তোলনের চাপ অনেক বেড়ে গেছে। মানুষ দুর্বল ব্যাংক থেকে টাকা তুলে সবল ব্যাংকে রাখবে- এটাই স্বাভাবিক। ব্যাংকের আমানত বৃদ্ধি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, সরকার পরিবর্তনের পর কয়েকটি ব্যাংকের প্রতি গ্রাহকের আস্থা কমে গিয়েছিল। ফলে তারা ওইসব ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিয়েছিল। যার প্রভাব পুরো ব্যাংক খাতেই পড়েছিল। তবে বর্তমানে ব্যাংকের প্রতি গ্রাহকের আস্থা আবার বাড়তে শুরু করেছে। ফলে আমানতের পরিমাণও বাড়ছে। আশা করি ভবিষ্যতে এই ধারা অব্যাহত থাকবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের অপর এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ব্যাংকের বাইরে মানুষের হাতে থাকা টাকার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৮৭ হাজার ৯৪ কোটি টাকা। যা আগের মাস জুনে ছিল ৯৬ হাজার ৪৫১ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক মাসে ব্যাংকের বাইরে মানুষের হাতে ধরে রাখা টাকার পরিমাণ কমেছে ৯ হাজার ১৫৭ কোটি টাকা বা ৩ দশমিক ০৯ শতাংশ। যদিও মে মাসে ব্যাংকের বাইরে টাকার পরিমাণ বেড়েছিল ১৬ হাজার ৪১২ কোটি টাকা।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন