ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৭ আগস্ট, ২০২৫

রেশমি চুড়ির মায়ায় আরফান হোসাইন রাফি

আরশি প্রতিবেদক
প্রকাশিত: আগস্ট ৭, ২০২৫, ১২:২৬ এএম

বালিকা, তোমার রেশমি চুড়ি, নীল শাড়ি আর কপালের কালো টিপের কোলাজ নিয়ে যেন কোনো প্রেমিক বসে পড়েছে ঢাকার রাস্তায় খুচরো দোকান খুলে। তাই তো টিএসসি, চারুকলা, দোয়েল চত্বর, শাহবাগ নানান জায়গা যেন রোজ রূপ নেয় এক প্রেমময় মেলায়, যেখানে সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি বিক্রি হচ্ছে নানা রঙের রেশমি চুড়ি।

একেকটা চুড়ি যেন একেকটি আবেশ। কখনো কখনো কানে ভেসে আসে ফিসফিস করে গেয়ে ওঠে আশা ভোশলের সেই পুরোনো বলিউড সুর ‘কিনে দে রেশমি চুড়ি, নইলে যাব বাপের বাড়ি’ রেশমি চুড়ি, এই শব্দজোড়ার মধ্যেই লুকিয়ে আছে একধরনের নরম, কোমল আবেগ। সময়ের পরিক্রমায় যেমন নারীর পোশাক ও পরিচ্ছদের বৈচিত্র্য বেড়েছে, তেমনি বদলেছে অলঙ্কারের উপাদান ও তা ব্যবহারের উদ্দেশ্যও। কিন্তু চুড়ি, বিশেষত রেশমি চুড়ি অদ্ভুত এক ক্ষমতায় যুগ যুগ ধরে নারীসত্তার অভিব্যক্তির বাহক হয়ে থেকেছে। প্রাচীনকাল থেকেই চুড়ি ছিল নারীর সৌন্দর্যচর্চার অবিচ্ছেদ্য অংশ। শারীরিক সৌন্দর্যের সঙ্গে মানসিক আত্মপরিচয়ের মেলবন্ধন ঘটিয়ে এই গহনা পরিণত হয়েছে একধরনের সাংস্কৃতিক প্রতীকে। একসময় কেবল বিয়ের উপকরণ হিসেবেই ধরা হতো চুড়িকে।

বিশেষত সবুজ কাচের চুড়ি গৃহবধূর পরিচায়ক হিসেবে ব্যবহৃত হতো। শুদ্ধতা, আনুগত্য আর সামাজিক প্রতিষ্ঠার এক নীরব প্রতীক হয়ে উঠেছিল তা। তবে সময় থেমে থাকেনি। নারীর অবস্থান সমাজে যেমন বদলেছে, তেমনই বদলে গেছে তার অলঙ্কার বেছে নেওয়ার অভিরুচিও। একসময় যে চুড়ি ছিল নিছক বিবাহবন্ধনের চিহ্ন, তা-ই এখন হয়ে উঠেছে স্টাইল স্টেটমেন্ট। কাচ কিংবা ধাতব উপাদানে তৈরি ঐতিহ্যবাহী চুড়ির জায়গায় এসেছে রেশমি সুতা দিয়ে মোড়ানো, হস্তশিল্পে সাজানো আধুনিক চুড়ি। এখনকার চুড়িতে মিশে আছে নকশার চমৎকারিত্ব, রঙের খেলা, সংস্কৃতির ছায়া আর ফ্যাশনের ঝলক। রেশমি চুড়ির এক আলাদা আবেদন রয়েছে তার রং ও স্পর্শের কারণে।

একেকটি রং একেকটি আবেগের প্রতিনিধি হয়ে উঠে। লাল রং যেমন প্রেম ও শক্তির প্রতীক, তেমনি নীল রঙে খুঁজে পাওয়া যায় আস্থার ছোঁয়া। এই চুড়িগুলো কেবল বাহ্যিক সাজ নয়, একজন নারীর মনোজগৎকেও ছুঁয়ে যায়। আর হয়ে ওঠে তার অভ্যন্তরীণ আবেগ, স্মৃতি, শৈল্পিক রুচি এবং স্বাতন্ত্র্য প্রকাশের একটি বাহ্যিক রূপ।

রেশমি চুড়ির ব্যবহারে তাই আছে একধরনের সজীব অভিব্যক্তি। কোনো কোনো নারী শুধু পহেলা বৈশাখ বা ঈদ-পূজার মতো উৎসবেই নয়, প্রতিদিনের পোশাকের সঙ্গে মানিয়ে পরে চুড়ি। কারণ চুড়ি এখন আর শুধুই ঐতিহ্যের প্রতীক নয়; বরং তা একধরনের আত্মপ্রকাশ, নিজেকে নতুন করে সাজিয়ে তোলার আনন্দ। রেশমি চুড়ির ঝুনঝুন শব্দ যেন হয়ে উঠেছে আত্মবিশ্বাসের ধ্বনি, নারীর চলার পথে নিজের উপস্থিতি জানান দেওয়ার একটি নান্দনিক উপায়। এই চুড়ির চাহিদা ও বহুমাত্রিকতা ফ্যাশনের জগতেও বেশ গুরুত্ব পেয়েছে। এখন চুড়ির ডিজাইন হয় পোশাকের কাট ও রঙের সঙ্গে মিল রেখে। কাঠ, প্লাস্টিক, টেরাকোটা, রেজিন, বা সুতা দিয়ে তৈরি হয়ে উঠছে নতুন নতুন স্টাইলের রেশমি চুড়ি। অনেক চুড়িতে যোগ হচ্ছে ছোট ঝুমকা, পুঁতি বা সিকুইনের কাজ। যা পুরো চেহারায় এনে দিচ্ছে শৈল্পিক পরিপূর্ণতা।

তবে কেবল বাহ্যিক নয়, রেশমি চুড়ির সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক অদৃশ্য স্মৃতিরেখা। মা বা দিদার আলমারিতে থাকা পুরোনো রেশমি চুড়ির সেট যেন জড়িয়ে রাখে এক সময়ের ছবি। যেখানে ভালো কোনো ব্র্যান্ড থেকে কেনা প্রথম উপহার কিংবা কলেজ জীবনের কোনো গোপন প্রেমের কথা ধরা থাকে একেকটা চুড়ির কাঁচে, সুতায়, রঙে। এই অলঙ্কার তাই সময়ের সঙ্গে হেঁটে চলা নারীর আত্মার অনুরণন। যিনি ঘরে থাকেন কিংবা কর্মক্ষেত্রে, যিনি শহরের কোলাহলে কিংবা গ্রামের মেঠো পথে, সেই সব নারীর হাতেই বাজে রেশমি চুড়ি। কখনো প্রেমের প্রতীক, কখনো বিদ্রোহের আওয়াজ, কখনো শুধু নিছক সাজ। রেশমি চুড়ির ব্যবহার এখন পেরিয়ে গেছে বয়স বা শ্রেণি-বিভাজনের গ-ি। তরুণী থেকে বৃদ্ধা, ছাত্রী থেকে চাকরিজীবী সবার পোশাকে জায়গা করে নিচ্ছে এই রঙিন অলঙ্কার। ফ্যাশনের ভোল বদলালেও রেশমি চুড়ির আবেদন আজও অমলিন। বরং আধুনিক ডিজাইন ও বৈচিত্র্যময় উপাদানের সংমিশ্রণে এই চুড়ি আরও বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। নারী এখন অনেক বেশি আত্মনির্ভরশীল, স্বাধীন ও স্বরচিত।

তার সাজে তাই আরোপিত রীতি নয়, থাকে নিজের পছন্দের ছাপ। রেশমি চুড়ি সেই পছন্দের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেখানে ঐতিহ্য ও আধুনিকতা পাশাপাশি হাত ধরাধরি করে চলে। অতএব, রেশমি চুড়ি কেবল একটি অলঙ্কার নয়। এটি সময়ের গল্প। এটি নারীর গল্প। এটি তার আত্মপরিচয়ের একটি নিঃশব্দ প্রকাশ, যা ঝংকারে কথা বলে, রঙে ছবি আঁকে, আর সুরে বুনে চলে এক অমলিন মায়া।