ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৯ মে, ২০২৫

সন্দেহজনক লেনদেন বেড়েছে ২৩ শতাংশ

বিশেষ প্রতিনিধি
প্রকাশিত: মে ২৮, ২০২৫, ০৬:২৮ এএম
ছবি-রূপালী বাংলাদেশ

আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে দেশের আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)।

তারা জানিয়েছে, গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে পুরো আর্থিক খাতে সন্দেহজনক লেনদেন সার্বিকভাবে বেড়েছে, আগের অর্থবছরের তুলনায় যা প্রায় ২৩ শতাংশ বেশি।

বিএফআইইউর বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তাদের কাছে পাঠানো ঋণসংক্রান্ত সন্দেহজনক লেনদেন প্রতিবেদনের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৭ হাজার ৩৪৫টি, যা আগের ২০২২-২৩ অর্থবছরে ছিল ১৪ হাজার ১০৬টি। অর্থাৎ এ ধরনের লেনদেন প্রতিবেদনের সংখ্যা বেড়েছে ৩ হাজার ২৩৯টি।

এর আগে ২০২১-২২ অর্থবছরে এ সংখ্যা ছিল ৮ হাজার ৫৭১টি, ২০২০-২১ অর্থবছরে ছিল ৫ হাজার ২৮০টি এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে ছিল ৩৬৭৫টি। গতকাল মঙ্গলবার বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে এক অনুষ্ঠানে বিএফআইইউর বার্ষিক প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর, বিএফআইইউর প্রধান এ এফ এম শাহীনুল ইসলাম, নির্বাহী পরিচালক ও বিএফআইইউর উপপ্রধান মো. কাওছার মতিন, বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান, পরিচালক মহুয়া মহসীন প্রমুখ।

সভায় জানানো হয়, বিএফআইইউ গত অর্থবছরে ১১৪টি আর্থিক গোয়েন্দা প্রতিবেদন বিভিন্ন তদন্তকারী সংস্থার কাছে পাঠিয়েছে। আইন প্রয়োগকারী, নিয়ন্ত্রক সংস্থাসহ মোট ১ হাজার ২২০টি তথ্য বিনিময়ও হয়েছে, আগের বছরের তুলনায় যা ১৩ দশমিক ৯১ শতাংশ বেশি। বিএফআইইউর প্রধান এ এফ এম শাহীনুল ইসলাম বলেন, অর্থ পাচার ও হুন্ডি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।

দেশের আর্থিক স্থিতিশীলতা ও লেনদেন ভারসাম্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে এই প্রবণতা। অন্তর্বর্তী সরকারের নির্দেশনা ও পৃষ্ঠপোষকতায় স্থিতিশীলতা ফেরাতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পাচার করা অর্থ ফেরত আনতে কাজ চলছে। ১১টি গ্রুপ নিয়ে যৌথ তদন্ত চলছে। এ কাজে পরামর্শ ও সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে বিশ্বব্যাংক। বিএফআইইউর প্রধান বলেন, পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফেরত আনার লক্ষ্যে সংস্থাটি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, তদন্তকারী সংস্থা ও আন্তর্জাতিক সহযোগীদের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করছে।

বিশ্বব্যাংকের এসটিএআর, যুক্তরাষ্ট্রের ইউএস ডোজ, আইএসিসিসি ও আইসিএআরের সহায়তা নেওয়া হচ্ছে। এমনকি বিদেশি আইনি প্রতিষ্ঠান নিয়োগের মাধ্যমে অর্থ পুনরুদ্ধারে পদক্ষেপ নেওয়া শুরু হয়েছে। তবে প্রক্রিয়াটি দীর্ঘমেয়াদি ও জটিল হওয়ায় সময় লাগবে। অর্থ পাচার বা মানি লন্ডারিং ও অর্থায়ন প্রতিরোধব্যবস্থায় বাংলাদেশের ১৩ ধাপ উন্নতি হয়েছে। ব্যাসেল অ্যান্টি মানি লন্ডারিং (এএমএল) ইনডেক্স-২০২৪ রিপোর্টে এই তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। এর আগে ব্যাসেল অ্যান্টি মানি লন্ডারিং (এএমএল) ইনডেক্স-২০২৩ রিপোর্টে পাঁচ ধাপ এগিয়েছিল দেশ।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৪ সালে বাংলাদেশ ১৩টি দেশকে পেছনে ফেলে র‌্যাংকিংয়ের ৪৬ নম্বর দেশ থেকে ৫৯ নম্বরে জায়গা করে নিয়েছে। ২০২৩ সালে বাংলাদেশ পাঁচটি দেশকে পেছনে ফেলে র‌্যাংঙ্কিয়ের ৪১ নম্বর থেকে ৪৬ নম্বরে জায়গা করে নিয়েছিল। সভায় বিএফআইইউর পরিচালক মুহাম্মদ আনিছুর রহমান বলেন, অর্থ পাচার ধরা ও উদ্ধার করা ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। এটা চলতেই থাকবে। গত বছরের জুলাই মাসের পর বিএফআইইউর কাজ কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। সন্দেহজনক প্রতিবেদন অনেক বেড়েছে। বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদন পাঠানো চার গুণ বেড়েছে।

অনুষ্ঠানে গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে পাচার হওয়া অর্থ ফেরাতে চার থেকে পাঁচ বছর লাগবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, পাচারকৃত টাকার পরিমাণ নিরূপণ করা হচ্ছে। এর ভিত্তিতে আমরা আন্দাজ করছি ১৮ থেকে ২০ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে। যারা টাকা পাচার করেছে তাদের সম্পদ জব্দ করা হচ্ছে, যাতে এসব সম্পদ বিক্রি করে বিদেশে আবার নতুন করে পাচার না করে।

গভর্নর বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়ে আমাদের প্রধান কাজ হলো সর্বোচ্চ পরিমাণ সম্পদ জব্দ করা। যারা পাচার করেছে তাদের জেলে পোরা কঠিন কাজ, এমন কোথাও হয়নি। আমাদের লক্ষ্য হলো, ব্যাংক থেকে টাকা চলে গেলে সেই টাকা উদ্ধার করা। এখানে বিভিন্ন আইনের জটিলতা আছে। আমি যদি ক্রিমিনাল আইনে মামলা করি, তাহলে সিভিল মামলা করতে পারব না। এখন ভাবতে হবে আমি কোন মামলা করব।

আহসান এইচ মনসুর বলেন, এ ক্ষেত্রে বিদেশের আইনে কোনো ব্যত্যয় তারা মানবে না। আমরা কীভাবে মামলা করছি, যদি বিদেশে প্রশ্ন তোলে, তাহলে আমাদের সব আটকে যাবে। কাজেই আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে এভিডেন্স প্রস্তুত রাখতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আরও বলেন, এই টাকা উদ্ধার করার কাজ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নয়। কিন্তু আমরা কাজটি নিয়েছি, যাতে গতিশীল থাকে। অন্য কোনো দপ্তর এটা করলে গতিশীল হতো না।

তারপরও কোর্টে কেস ফাইল আমরা করব না, কেস ফাইল করবে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), কেস ফাইল করবে সিআইডি। তারা এভিডেন্স সংগ্রহ করছে, আমরাও যতদূর সম্ভব করছি। আমাদের অনেক এভিডেন্স সংগ্রহ করা হয়নি, ১১টি তদন্ত টিম কাজ করছে।

কিন্তু যারা যুক্ত আছে, যারা এ কাজ করছে, এখনো তারা পুরোপুরি নিবেদিত হয়ে শুরু করতে পারেনি। একসঙ্গে দুই অফিসের কাজ করতে হয়। তিনি বলেন, ইসলামী ব্যাংকগুলো একীভূত করা হবে। তবে সংখ্যাগুলো এখনই বলা যাচ্ছে না। প্রথমে অল্পসংখ্যক ব্যাংক একীভূত করা হবে। তারপর আরও কিছু ব্যাংক। নিয়ম অনুযায়ী ব্যাংকগুলোকে আগে সরকারীকরণ করা হবে। ব্যাংক অধিগ্রহণ করলে কোনো আমানতকারীর চিন্তা থাকবে না, সরকারই আমানতকারীর সব দায় নেবে। আমানতকারী যে ব্যাংকে আছে, সেখানেই থাকুন।

আহসান এইচ মনসুর বলেন, সরকারি করলে সরকারকে অনেক টাকা বিনিয়োগ করতে হবে, সেটাও নিশ্চিত করতে হবে। তারপর দেশি হোক বিদেশি হোক বিনিয়োগকারীকে আহ্বান করা হবে। সে ক্ষেত্রেও সময়সাপেক্ষ। পাচার হওয়া টাকা উদ্ধার প্রক্রিয়া বাংলাদেশের কাছে একেবারে নতুন। বিএফআইইউ বলুন, দুদক বা সিআইডি বলুন, কোনো সংস্থাই এ ধরনের কাজের জন্য প্রস্তুত ছিল না।