শুক্রবার, ২৭ জুন, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


শহিদুল ইসলাম রাজী 

প্রকাশিত: জুন ২৭, ২০২৫, ০৪:১৪ এএম

তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদন

গুমের পর টর্চার সেলে চালানো হতো অমানসিক নির্যাতন

শহিদুল ইসলাম রাজী 

প্রকাশিত: জুন ২৭, ২০২৫, ০৪:১৪ এএম

গুম হওয়া ব্যক্তিদের ওপর চালানো হতো অমানসিক নির্যাতন। ছবি- সংগৃহীত

গুম হওয়া ব্যক্তিদের ওপর চালানো হতো অমানসিক নির্যাতন। ছবি- সংগৃহীত

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে গোপন টর্চার সেলে রেখে গুম হওয়া ব্যক্তিদের ওপর চালানো হতো অমানসিক নির্যাতন। হাতকড়া পরিয়ে চোখ বেঁধে রাখা হতো সবসময়। টর্চার সেলে বিদ্যুতের শক দেওয়া, নখের নিচে পিন ঢুকিয়ে এবং পা বেঁধে ওপর দিকে করে ঝুলিয়ে নির্যাতন ছিল নিত্যনৈমত্যিক বিষয় বলে একাধিক ভুক্তভোগী গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের কাছে সাক্ষ্য দিয়েছেন। 

ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, টর্চার সেলগুলো ছিল সাউন্ড প্রুফিং। নির্যাতনের শব্দ ঢাকতে উচ্চস্বরে গান বাজানো হতো। এ ছাড়া বন্দিরা যখন টয়লেট ব্যবহার করত, তখনো সিসিটিভি ক্যামেরা মাধ্যমে তাদের ওপর নজরদারি করা হতো। গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন বিশ্লেষণ এবং ভুক্তভোগীদের বর্ণনায় এসব তথ্য পাওয়া গেছে। সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে ‘আনফোল্ডিং দ্য ট্রুথ: আ স্ট্রাকচারাল ডায়াগনসিস অব এনফোর্সড ডিজঅ্যাপিয়ারেন্স ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি জমা দেয় কমিশন।

গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশন জানিয়েছে, গত বছরের ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ের প্রমাণ ধ্বংসের চেষ্টার পরও তারা দেশের প্রায় প্রতিটি আটক কেন্দ্রে বিশেষ জেরা কক্ষ ও নির্যাতনের যন্ত্রপাতির অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘আমরা যেসব আটক কেন্দ্র পরিদর্শন করেছি, তার প্রায় প্রতিটিতেই নির্যাতনের জন্য বিশেষভাবে প্রস্তুত জেরা কক্ষ ছিল।’ প্রমাণ ধ্বংসের নানা চেষ্টা সত্ত্বেও কিছু আলামত উদ্ধার করা গেছে, যা নির্যাতনে ভুক্তভোগীদের বিবরণীর সঙ্গে মিলে গেছে। 

উদাহরণস্বরূপ, র‌্যাব-২ ও সিপিসি-৩-এ ঘূর্ণায়মান চেয়ার, র‌্যাব-৪ ও ডিবিতে ব্যবহার করা ‘যম টুপি’ ও টাস্কফোর্স ইন্টাররোগেশন (টিএফআই) সেলে মানুষকে ঝুলিয়ে নির্যাতন করার যন্ত্রের (পুলি সিস্টেম) অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, ধ্বংস করা প্রায় প্রতিটি স্থানে সাউন্ড প্রুফিংয়ের চিহ্ন পাওয়া গেছে। কক্ষগুলো এমনভাবে তৈরি ছিল, যেন নির্যাতনের শিকারদের চিৎকার বাইরের কেউ শুনতে না পায়। 

কিছু কেন্দ্রে নির্যাতনের শব্দ ঢাকতে উচ্চস্বরে গান বাজানো হতো, যা আবার নির্যাতকদের মনোরঞ্জনের মাধ্যম হিসেবেও ব্যবহৃত হতো। এ ছাড়া ভুক্তভোগীরা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়ে দীর্ঘ সময় ধরে অসহনীয় কষ্টভোগ করেছেন। তাদের প্রায়ই নিয়মিত প্রহরীদের অর্ধেক খাবার দেওয়া হতো, হাতকড়া পরিয়ে ও চোখ বেঁধে রাখা হতো ও সম্পূর্ণ নির্জন কক্ষে আটকে রাখা হতো।

২৭ বছর বয়সি এক ভুক্তভোগী যুবক ২০১৭ সালে র‌্যাব-১০ কর্তৃক অপহৃত হন। তিনি ১১৩ দিন ধরে নিখোঁজ ছিলেন। ওই যুবক গুম কমিশনকে বলেন, ‘এক দিন প্রচুর মারছে, বলতাছে, তোর বাড়িতে আমাদের ইনকোয়ারি গেছে। তোর নামে রিপোর্ট পাইছি, তোর পরিবার জামায়াত-বিএনপির সঙ্গে জড়িত, তোর নানির বাড়ি করে জামায়াত, আর তোর বাপ করে বিএনপি। এগুলো বলতাছে, এগুলো বইলা আমারে মারছে। 

মারার একপর্যায়ে আমি মনে হয় টেবিলের কোনা বা কিছু বাড়ি খেয়ে পড়ে গেছি, আমার জ্ঞান হারাইছি। পরে আমারে বাথরুমে মাথায় পানি দিয়ে আমার জ্ঞান ফিরাইছে। এই হাত আমার অবশ। আমি দাঁড়াইতে পারি না। মানে সোজা দাঁড়াইতে পারি না। এমন অবস্থা যে, দাঁড়াইলেই আর বসতে পারি না। বসলে আর দাঁড়াইতে পারি না। ওয়াশরুমে আমাকে নিয়ে গেছে। সেখানেও মারধর করা হয়েছে। অচেতন হয়ে পড়লে একজন লাথি দিয়ে দেখতেছে, মরে গেল কিনা।’ 

ভুক্তভোগী বলেন, এর মধ্যে আমাকে গামছা দিয়ে পানি ঢাললো মুখে। ‘কোথায় আছে, বল, কোথায় আছে বল? মানে আমাকে একটা সেকেন্ডও সময় দিতাছে না। ওরা কয়, না, তোর বলতে হইব। এখন কোথায় আছে, কোথায় গেলে পাব?’

‘এরপর শুরু হলো, কারেন্টের শক দেওয়া। আমাকে দাঁড় করাই রাখা। গ্রিলের মধ্যে হ্যান্ডকাফ দিয়ে আমাকে দাঁড় করিয়ে রাখত। আমি যাতে বসতে না পারি। দাঁড় করিয়ে রাখতো। পা এমন ফুলে গেছে আমার। আমার হাতে দাগ পড়ছে। ওয়াশরুমে যেতে চাইলে, ওয়াশরুমে যেতে দিত না। এই অত্যাচার শুরু হয়ে গেল। এর মধ্যে এক দিন এনে আঙ্গুলটাকে এভাবে প্লাস দিয়ে ধরছে। ধরার পরে টেবিলের ওপরে হাত রেখে, প্লাস ধরে, আরেকজন সূচ ঢুকাইছে।’ ওই যুবক সুইয়ের দাগ কমিশনে দেখিয়ে বলেন, ‘তারা কয় তুই আব্দুল মুমিন না?’ ‘স্যার, আমি আব্দুল মুমিন না, আমার নাম হলো হাবিব।’

২৩ বছর বয়সি আরেক ভুক্তভোগী যুবক ২০১৭ সালে র‌্যাব-১১ কর্তৃক অপহৃত হন। তিনি ৭২ দিন ধরে নিখোঁজ ছিলেন। এ ভুক্তভোগী যুবক গুম কমিশনকে বলেন, ‘আমার পা বেঁধে ওপর দিকে করে ঝুলাইছে। আমার শরীরে কোনো পোশাক রাখে নাই তখন, একেবারে উইদাউট ড্রেস। তারপরে এলোপাথাড়ি আমাকে দুজনে একসঙ্গে পিটাতে থাকে। খুব সম্ভব বেতের লাঠি দিয়ে। পরবর্তী সময়ে আমাকে অসংখ্যবার টর্চার করেছে এবং মারতে মারতে আমার এমন হয়েছে, চোখের কাপড় খুলে গেছে। নাকে-মুখে চড়ানো, থাপড়ানো। শুধু পিছে মারছে। ওই সময়ে চামড়া ফেটে রক্ত ঝরেছে। 

পরবর্তী সময়ে যখন আমাকে একটা সেলের সংকীর্ণ একটা জায়গায় রাখে, তখন আমি পেছনে হাত দিয়ে দেখি যে রক্ত পড়তেছে। আর এটার দাগ প্রায় দেড় বছর পর্যন্ত ছিল। মানে পেটানোর দাগ এরকম পুরো হয়ে গেছিল। তা আমি যখন উপুড় হয়ে শুয়ে আছি, তখন ওইখানে সাইফুল নামক একটা লোক, সে বলে যে, ভাই, আপনি উপুড় হয়ে শুয়ে আছেন কেন?’ আমি বলছি, ‘ভাই, আমি বসে থাকতে পারতেছি না। আমাকে গায়ে হাত দিয়ে টর্চার করেছে ২৫ দিন।’ 

অপর এক ৪৭ বছর বয়সি ভুক্তভোগী ব্যক্তি ২০২৩ সালে সিটিটিসি (কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম) বিভাগ কর্তৃক অপহৃত হন। তিনি ১৬ দিন নিখোঁজ ছিলেন। ওই ভুক্তভোগী কমিশনকে বলেন, ‘চোখে কখনো গামছা দিয়া, কখনো ওই যে যম টুপি, এগুলা দিয়ে বাঁধা থাকত। হাত কখনো সামনে, কখনো পেছনে। আর যখন বেশি মারবে, তখন এই হাত পেছনে দিয়ে রাখতো আর আমার এই কনুইগুলো, দুই হাঁটু এগুলোতে খুব জোরে জোরে মারতো মোটা লাঠি দিয়ে। আমি মনে করতাম, আমার হাড়গুলো বুঝি ভেঙে যাবে, কিন্তু পরবর্তী সময়ে দেখলাম যে ফুলে অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গেছে, কিন্তু হাড় ভাঙছে এরকম বুঝি নাই। 

পরে আমাকে বলল, তোর হাড় থেকে মাংস আলাদা করে ফেলব। এরপরে দীর্ঘদিন বসে নামাজ পড়াও কষ্টকর ছিল।’ বলতেছে, ‘এভাবে হবে না। এরে লটকা। টানাইতে হবে।’ একজন এএসআই লোক হবে, ও আমাকে দুই হাতে রশি লাগায়া ওই যে ফ্যানের হুক থাকে ছাদের মধ্যে, এটার মধ্যে ওর রশি দিয়ে এরকম ঝুলাইলো। শুধু পায়ের বুড়ো আঙুলটা লাগানো থাকে মেঝেতে আর পুরা শরীরটা ঝোলানো। হাত এখনো ওঠাতে পারি না, আমার এটা দুইটা জোড়ার মধ্যে সমস্যা হয়ে গেছে।’ 

গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিদের বেশির ভাগ সময়েই গুম করে রাখা হতো, যাতে আইনি জবাবদিহির ভয় ছাড়াই তাদের ওপর নির্যাতন চালানো যায়। ভুক্তভোগীরা কখনো আদালতে হাজির হবেন কি-না, নাকি রাষ্ট্রীয় রেকর্ড থেকে একেবারে মুছে যাবেন, এই অনিশ্চয়তা এমন এক পরিবেশ তৈরি করেছিল, যা অপরাধীদের সাহস অনেক বাড়িয়ে দিয়েছিল। ফলে নির্যাতন সহজেই চলত এবং তা থামানো বা তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার মতো কেউ থাকত না।

প্রতিবেদনের দ্বিতীয় অংশে বলা হয়েছে, যারা নির্যাতন চালাত, তারা অনেক সময় বাড়তি নজরদারির আশঙ্কায় প্রমাণ গায়েব করত। আবার কিছু ক্ষেত্রে নির্যাতনের দাগ মুছে যেতে বা ক্ষত সেরে উঠতে কয়েক সপ্তাহ অপেক্ষা করত। এরপরই কাউকে জনসমক্ষে হাজির করত, যাতে তাদের অপরাধের কোনো স্পষ্ট চিহ্ন না থাকে।

প্রতিবেদন বলছে, নিয়মিত যন্ত্রণা ছাড়াও নির্যাতনের সবচেয়ে সাধারণ প্রচলিত ধরন ছিল মারধর। এ ছাড়া মূত্রত্যাগের সময় যৌনাঙ্গে বিদ্যুতের শক দেওয়া, ঘূর্ণায়মান চেয়ার ব্যবহার করে কষ্ট দেওয়া ও পুরো শরীর ঢেকে অত্যাচার করার মতো যন্ত্রপাতি দিয়ে নির্যাতন চালানো হতো।

জানা গেছে, ২৯ বছর বয়সি যুবক ২০১০ সালে র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখা ও র‌্যাব-৫ কর্তৃক গুমের শিকার হন। তিনি ৪৬ দিন নিখোঁজ ছিলেন। এ ভুক্তভোগী কমিশনকে বলেন, ‘আমার শরীরে হাফ হাতা গেঞ্জি ছিল, কলারওয়ালা। সেটা মাথার ওপর দিয়ে মুখটা বন্ধ করে দেয়। মুখের ওপর অনবরত ঘুষি মারছিল, দাঁত দিয়ে ওপরের ঠোঁটটা আমার কেটে গেছিল। তাৎক্ষণিক পায়ে দুইটা ক্লিপ লাগায় দিল। ফার্স্ট সেবার শক খাওয়ার অভিজ্ঞতা। 

মনে হচ্ছে যখন শক দেয়, টোটাল শরীরটা আমার ফুটবলের মতো গোল হয়ে যায়। এরকম আট-দশবার আমাকে শক দিছে। শকটা হতো তিন-চার সেকেন্ড সর্বোচ্চ। তাৎক্ষণিক শরীরটা গোল হয়ে যায়, সব রগ চেপে ধরে। প্রশ্ন করে আর শক দেয়। খুবই বেপরোয়াভাবে চার-পাঁচজন পিটানি শুরু করল, দুই হাত ধরে ওই হুকের ওপর লাগায়। মনে হচ্ছে হয়তো কিছুতে সুইচ টিপছে, অটোমেটিক আমার শরীরটা ওপরে উঠে যাচ্ছে। 

ওই সময় আমার কাপড় খুলে, আবার ওই একই ক্লিপ লাগায় দেয় আমার গোপন দুইটা অঙ্গে এবং ওই জিজ্ঞাসাবাদ সেম চলতে থাকে। যখনই সুইচ দেয়, আমার মনে হয়েছে, আমার সে অঙ্গগুলো পুড়ে যাচ্ছে... এবং মাঝে মাঝে আমি গোস্ত পুড়লে যেরকম একটা গন্ধ লাগে, সেই গন্ধটা পাইতাম। চার থেকে পাঁচজন টোটাল বডিতে, আমার পা থেকে একেবারে গলা পর্যন্ত পিটাত। গরু পিটানের মতো, সবদিক দিয়ে। মানে, কোনো জায়গায় আমার ফাঁকা ছিল না। আমি জেলখানাতে যাওয়ার পরে শরীরটা যখন দেখি, মানে এমন কোনো জায়গা ছিল না, সব কালো হয়ে গেছিল।’ 

কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নির্যাতনের ব্যাপকতা ও এর ধারাবাহিকতা স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়, এটি শুধু মাঠপর্যায়ে অনুমোদিত ছিল না, বরং ক্ষমতার শীর্ষ পর্যায় থেকেও এর পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া গেছে। প্রতিবেদনটি বলেছে, ক্ষমতার উচ্চপর্যায়ের স্পষ্ট অনুমোদন ছাড়া এ ধরনের নির্যাতনব্যবস্থা গড়ে তোলা ও দীর্ঘ সময় ধরে চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। কারণ, এর জন্য অবকাঠামো, যন্ত্রপাতি কেনা ও রক্ষণাবেক্ষণে বাজেট বরাদ্দ লাগত। 

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ‘এই মানবতাবিরোধী অপরাধের দায় শুধু মাঠপর্যায়ের অপরাধীদের ওপরই পড়ে না, এর দায় বর্তায় সেসব শীর্ষ কর্মকর্তা ও কমান্ডিং অফিসারদের ওপরও, যারা এসব কর্মকাণ্ডে অনুমোদন দিয়েছেন বা উৎসাহিত করেছেন।’

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!