জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) অস্থিরতা এখনো কাটেনি। ‘ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ’ করায় নতুন করে ১৪ জন কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে সরকার। পাশাপাশি এবার শুল্ক ক্যাডারের ১১ কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়েছে।
এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের নামে আন্দোলন প্রত্যাহারের পর এর আগে চারজনকে বাধ্যতামূলক অবসর ও এক কমিশনারকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছিল। এ ছাড়া এনবিআরের দুজন সদস্যসহ ১৬ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুদকের তদন্ত চলমান রয়েছে।
নতুন করে গতকাল মঙ্গলবার আরও ১৪ কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্তের ঘোষণা দিয়েছে সরকার। তালিকায় রয়েছেন আরও প্রায় ৩০ কর্মকর্তা। এনবিআর চেয়ারম্যানের অভয়দানের পরও সরকারের এমন ঘোষণায় স্তম্ভিত হয়ে পড়েছেন রাজস্ব প্রশাসকেরা। সরকারের এমন নীতিতে রাজস্ব প্রশাসকেরা অসস্তুষ্ট। ফলে মাঠপর্যায়ে রাজস্ব আহরণ সংকুচিত হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
রাজস্ব প্রশাসকেরা বলছেন, চেয়ারম্যানের ঘোষণায় তারা ফের কাজে ফিরে যান এবং রাজস্ব আদায়ে মনোযোগী হন। কাস্টমস ও বন্ড হাউসগুলোতে কর্মপরিবেশ ফিরে আসে। স্বস্তি প্রকাশ করেন ব্যবসায়ীরাও।
তবে গতকালও আরও ১৪ জনের সাময়িক বরখাস্তের ঘটনায় এনবিআরে অস্থিরতা নতুন মাত্রা পেয়েছে। এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের নামে আন্দোলনকারী নেতাদের বিভিন্নভাবে হয়রানি ও চাকরি থেকে বাধ্যতামূলক অব্যাহতিতে রাজস্ব আদায়ে সংকটের নতুন মাত্রা যুক্ত হচ্ছে বলে মত প্রকাশ করেন তারা।
একদিকে, দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্ত, চাকরি থেকে বাধ্যতামূলক অবসর, বদলি ও সাময়িক বরখাস্ত হওয়ায় ভয়। সব মিলিয়ে চাকরিসহ সম্মান হারানোর শঙ্কায় দিন পার করছেন তারা। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে টানা এক যুগ রাজস্ব ঘাটতিতে ছিল এনবিআর। এনবিআর সংস্কার আন্দোলনের শেষে প্রাণবন্ত কর্মপরিবেশ সৃষ্টি না হওয়ায় জাতীয় রাজস্ব আহরণ ফের ঘাটতির হুমকিতে পড়ছে বলে মত দিয়েছেন অর্থনীতি বিশেষজ্ঞরা।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, এবার আরও ৮ কর কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করেছে সরকার। বদলির আদেশ প্রকাশ্যে ছিঁড়ে ফেলায় তাদের সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। গতকাল অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ (আইআরডি) এ-সংক্রান্ত পৃথক পৃথক আদেশ জারি করেছে।
বরখাস্তরা হলেন ঢাকা কর অঞ্চল-২-এর যুগ্ম কর কমিশনার মাসুমা খাতুন, কর অঞ্চল-১৫-এর যুগ্ম কর কমিশনার মুরাদ আহমেদ, কুষ্টিয়া কর অঞ্চলের মোরশেদ উদ্দীন খান, নোয়াখালী কর অঞ্চলের যুগ্ম কর কমিশনার মোনালিসা শাহরীন সুস্মিতা, কক্সবাজার কর অঞ্চলের যুগ্ম কর কমিশনার আশরাফুল আলম প্রধান, খুলনা কর অঞ্চলের উপকর কমিশনার শিহাবুল ইসলাম, রংপুর কর অঞ্চলের উপকর কমিশনার নুশরাত জাহান ও কুমিল্লা কর অঞ্চলের উপকর কমিশনার ইমাম তৌহিদ হাসান।
বরখাস্তদের মধ্যে আরও রয়েছেন এনবিআর ঐক্য পরিষদের সভাপতি ও অতিরিক্ত কমিশনার হাসান মোহাম্মদ তারেক রিকাবদার, অতিরিক্ত কর কমিশনার মির্জা আশিক রানা, উপকর কমিশনার মোহাম্মদ শাহাদাত জামিল, উপকর কমিশনার সিফাত-ই-মারিয়ম, রাজস্ব কর্মকর্তা শফিউল বাশার এবং রাজস্ব কর্মকর্তা সবুজ মিয়া। এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের নামে গত জুন মাসে ‘কমপ্লিট শার্টডাউন’ কর্মসূচি পালনের নেতৃত্বে ছিলেন তাদের অনেকে।
আদেশ অনুসারে, গত ২২ জুন জারি করা বদলির আদেশ অবজ্ঞাপূর্বক প্রকাশ্যে ছিঁড়ে ফেলার মাধ্যমে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করায় তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত করে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তাদের এনবিআরের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দিয়ে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। সাময়িক বরখাস্তকালে তারা বিধিমোতাবেক খোরপোষ ভাতা প্রাপ্য হবেন।
অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সচিব ও এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান আদেশে সই করেন। গত মাসে রাজস্ব খাতে যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন করেন এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। ২৮ ও ২৯ জুন সারা দেশে কাজ বন্ধ করে দেন। এরপর নতুন অর্থবছরে ব্যবসায়ীদের মধ্যস্থতায় আন্দোলন প্রত্যাহার করে কাজে ফেরেন রাজস্ব আদায়কারী প্রশাসকেরা।
দেশের অর্থনৈতিক জোনগুলোতে কাজে যোগ দেওয়ার পরে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া শুরু হয়। আন্দোলন প্রত্যাহারের পর এই পর্যন্ত তিনজন সদস্য ও একজন কমিশনারকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠায় সরকার। একই দিনে কাজ বন্ধ রাখার অভিযোগে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের তৎকালীন কমিশনারকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এ ছাড়া এনবিআরের দুজন সদস্যসহ ১৬ জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে দুদক।
বদলি ও অস্থিরতার প্রসঙ্গে এনবিআর সদস্য জি এম আবুল কালাম কায়কোবাদ রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘চাকরি থেকে অব্যাহতির বিষয়টি সরকারের ইস্যু এবং বদলির বিষয়টি এনবিআরের রুটিন ওয়ার্ক। প্রতিবছর জুনের শেষে সরকারি চাকরিজীবীদের বদলি শুরু হয়। কাজেই এটি ভিন্ন খাতে প্রবাহের সুযোগ নেই।’
এনবিআর সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন সম্প্রতি রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘স্বাধীনতার সময়েও দেশের পোর্ট কখনো বন্ধ ছিল না। অর্থনীতির ব্লাড সার্কুলেশন এ পথেই হয়। পোর্ট বন্ধ রেখে আন্দোলন করা কতটা নৈতিকতার শামিল এটা আমাদের কারো বোধগম্য হয় না’, বলেন তিনি।
ঢাকা কাস্টম হাউস পরিদর্শন শেষে গত ৭ জুলাই এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান বলেন, ‘এনবিআর কর্মকর্তাদের ভয়ের কিছু নেই। তবে যারা অনেক বড় আকারে সীমা লঙ্ঘন করেছে, সেটি ভিন্নভাবে দেখা হবে। সাধারণভাবে কারো কোনো ভয়ের কারণ নেই।’
আস্থার সংকট নিরসন সম্পর্কে চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমি এসেছি তাদের অভয় দেওয়ার জন্য। প্রত্যেকে যদি দায়িত্বশীল আচরণ করেন, তাদের যে কাজকর্ম, সেগুলো যদি তারা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করেন; তাহলে আমি মনে করি না তাদের ভয়ের কোনো কারণ আছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘কেউ কেউ বড় আকারের সীমা লঙ্ঘন করেছেন। সেটা হয়তো ভিন্নভাবে দেখা হবে। তবে সাধারণভাবে আমার মনে হয় না কারো ভয়ের কোনো কারণ আছে। যেসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, সেটি সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত।’
আতঙ্ক চলতে থাকলে রাজস্ব আহরণে ব্যাঘাত সৃষ্টি হবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা তো চলতে থাকবে না। রাজস্ব বিভাগে যারা কর্মরত আছেন, তারাই রাজস্ব আদায় করবেন। এটা তাদের কাজ, আপনারা যে ভয়গুলো পাচ্ছেন রাজস্ব আদায় হবে না, আতঙ্ক কাজ করছে। এগুলো কেটে যাবে। সবই ঠিক হয়ে যাবে।’
সরকারের নির্দেশনা আমলে না নেওয়ায় এনবিআরের তিনজন সদস্য ও একজন কমিশনারকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠিয়েছে সরকার। অবসরপ্রাপ্তরা হলেনÑ এনবিআরের সদস্য (কাস্টমস নীতি ও আইসিটি) হোসেন আহমেদ, সদস্য (মূসক নীতি) ড. মো. আবদুর রউফ, সদস্য (কর অডিট, ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন) মো. আলমগীর হোসেন এবং কর-কমিশনার শাব্বির আহমেদ।
বরিশাল কর অঞ্চলে কমিশনারের চলতি দায়িত্ব পালন করছিলেন শাব্বির আহমেদ। তার আগের রাতে চট্টগ্রামের কাস্টম হাউসের কমিশনার জাকির হোসেনকে সাময়িক বরখাস্ত করে সরকার, সেখানে কমিশনার হিসেবে মোহাম্মদ শফি উদ্দিনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। অব্যাহতি পাওয়া চারজনের চাকরিকাল ২৫ বছর পূর্ণ হওয়ায় অব্যাহতি দিয়েছে সরকার।
তার আগে এনবিআরের মোট ১১ কর্মকর্তার দুর্নীতির অনুসন্ধানের ঘোষণা করেছে দুদক। তারা হলেন এনবিআরের বৃহৎ করদাতা ইউনিটের অতিরিক্ত কমিশনার আব্দুল রশীদ মিয়া, এনবিআরের সদস্য লুতফুল আজীম, এনবিআরের সিআইসি সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক মোহাম্মদ আলমগীর হোসেন, ঢাকা কর অঞ্চল-১৬-এর উপকর কমিশনার মোহাম্মদ শিহাবুল ইসলাম এবং যুগ্ম কমিশনার মো. তারেক হাছান।
তালিকায় আরও আছেন এনবিআরের আয়করনীতি বিভাগের সদস্য এ কে এম বদিউল আলম। নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের অতিরিক্ত কমিশনার হাছান মুহম্মদ তারেক রিকাবদার, তিনি এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের সভাপতি। ঢাকা-৮ কর অঞ্চলের অতিরিক্ত কমিশনার মির্জা আশিক রানা ও শাহরীন সুস্মিতা ঐক্য পরিষদের সহসভাপতি।
ঢাকা দক্ষিণ কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেটের অতিরিক্ত কমিশনার সাধন কুমার কু-ু এবং বিএসএস কর একাডেমির যুগ্ম কর কমিশনার মোহাম্মদ মোরশেদ উদ্দীন খান। এ ছাড়া এই তালিকায় নতুন করে আরও নাম অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে বলে এনবিআরের বিশেষ একটি সূত্র জানিয়েছে।