বুধবার, ১৬ জুলাই, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


মিনহাজ পারভেজ, পাটগ্রাম

প্রকাশিত: জুলাই ১৬, ২০২৫, ০২:৩৫ এএম

যাদের মৃত্যু কাউকে কাঁদায় না

মিনহাজ পারভেজ, পাটগ্রাম

প্রকাশিত: জুলাই ১৬, ২০২৫, ০২:৩৫ এএম

যাদের মৃত্যু কাউকে কাঁদায় না

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগ। অনেকটা টেনেহিঁচড়ে চ্যাংদোলা করে আনা হলো এক যুবকের অচেতন দেহ। ছুটে এলেন চিকিৎসক। জানালেন, অনেক আগেই মারা গেছে। চারপাশে চোখ বুলিয়ে চিকিৎসক জানতে চাইলেন, কোনো স্বজন বা অভিভাবক আছেন কি না? কারো কোনো জবাব নেই। ফুটপাতে পড়ে ছিল, পথচারীদের কেউ একজন হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন। অজ্ঞাত ঘোষণা করে চিকিৎসক মরদেহ পাঠিয়ে দিলেন শবঘরে। হায় রে মৃত্যু! বিদায়ের সময় কপালে না জুটল প্রিয়জনের স্পর্শ। মৃত্যু ঘিরে চারপাশে নেই কোনো আহাজারি। দুফোঁটা চোখের জল ফেলার জন্যও নেই কোনো আপনজন। কারণ, সে ভবঘুরে, বেওয়ারিশ। রাজধানীর ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের আশপাশ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) এলাকার বিভিন্ন ফুটপাত থেকে গত সাড়ে তিন মাসে ঠিক এমনই ৬১ জনের মরদেহ উদ্ধার হয়। এর মধ্যে গত দেড় মাস বা ৪৫ দিনেই উদ্ধার হয়েছে ২৮টি। তাদের অধিকাংশই বেওয়ারিশ, ভবঘুরে এবং মাদকসেবী বলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং সংশ্লিষ্ট শাহবাগ থানা সূত্রে জানা গেছে।

এত অল্প সময়ের ব্যবধানে এই বিপুলসংখ্যক মরদেহ উদ্ধারের ঘটনায় উদ্বিগ্ন পুলিশ প্রশাসনও। উদ্ধারের সময় প্রায় সবারই পরিচয় অজ্ঞাত থাকে। এদের মধ্যে নানা বয়সের নারী, পুরুষ ও শিশু রয়েছে। উদ্ধারের পর পুলিশ মরদেহ থেকে আঙুলের ছাপ নিয়ে, এনআইডি শনাক্ত করে কারো কারো পরিচয় বের করতে পারলেও একটা উল্লেখযোগ্য সংখ্যা শেষ পর্যন্ত অজ্ঞাতই থেকে যায়। আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের মাধ্যমে এদের মরদেহ দাফন করা হয়।
তবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কর্মরত বিভিন্ন গণমাধ্যমের কয়েকজন সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মরদেহগুলোর একটি বড় অংশ সাধারণত ভবঘুরে এবং মাদকাসক্তদের। তবে এর বাইরেও রহস্যজনক অনেক মরদেহ পাওয়া যায়, যাদের শরীরে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে এবং মাদকাসক্ত বলে মনে হয় না। অনেকের পোশাকও বেশ পরিপাটি। কোনো মরদেহ পুলিশ উদ্ধার করে আনে, আবার অনেক সময় পথচারী বা এলাকাবাসীও নিয়ে আসেন। পুলিশ প্রতিটি মরদেহেরই সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করে এবং ময়নাতদন্তও সম্পন্ন হয়। থানাতেও লিপিবদ্ধ হয় অপমৃত্যু মামলা। কিন্তু এরপর কোন মরদেহের পরিচয় শনাক্ত হলো, কোনটা স্বভাবিক মৃত্যু আর কোনটা হত্যাকা- তা আসলে ধোঁয়াশাই থেকে যায়। পুলিশের তদন্তে খুব স্বল্প সংখ্যকেরই পরিচয় মিলে।
লাশের মিছিলে এরা কারা?

এসব মৃত্যুর ঘটনার নেপথ্য খুঁজতে রূপালী বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার বিভিন্ন ফুটপাত এবং ঢামেকের পাশর্^বর্তী এলাকায় সরেজমিন অনুসন্ধান চালিয়ে উঠে এসেছে অরাজকতার ভয়াবহ চিত্র। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে এসব এলাকায় ভবঘুরে, ভাসমান পতিতা, অসামাজিক কাজে লিপ্ত তৃতীয় লিঙ্গ বেশধারী হিজড়া, ছিনতাইকারী আর মাদকাসক্তদের অনেকটা জমজমাট মেলা বসে। বিশেষ করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের পাশে পুলিশ ক্যাম্পের অদূরের অন্ধকার গলি, হাসপাতালের বহির্বিভাগের চারপাশের খোলা জায়গা, চানখাঁরপুল, দোয়েল চত্বর থেকে শুরু করে শহিদ মিনারের চারপাশ এবং শিববাড়ি এলাকা। দিনভর তো চলেইÑ সন্ধ্যার পর থেকে এসব এলাকায় প্রকাশ্যে চলে মাদক (বিশেষ করে হেরোইন, পেথিডিন ইনজেকশন, ইয়াবা এবং ফেনসিডিল) বেচাকেনা। আর এসব মাদকের নিরাপদ সেবনের জায়গা হচ্ছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এলাকার অভ্যন্তরে চারপাশের খোলা জায়গা। সার্বক্ষণিক হাসপাতালের ক্যাম্প পুলিশ ও আনসার মোতায়েন থাকলেও তাদের ম্যানেজ করেই চলে এদের আনাগোনা। আর একের পর এক যে অজ্ঞাত মরদেহ উদ্ধার হচ্ছে, সেগুলোর অধিকাংশই এসব মাদকসেবীর।

শহিদ মিনারের সামনে কথা হয় ২২ বছর বয়সি এক মাদকসেবীর সঙ্গে। এই যুবকের দাবি, তার নাম মিনার। শহিদ মিনার এলাকায় তার বসবাস হওয়ার কারণে এই নামটা তিনি নিজেই রেখেছেন। আসল নাম বলতে রাজি নন তিনি। কয়েকজন মাদকসেবীর পাশে বসা অবস্থায় মিনার কথা বলেন এই প্রতিবেদকের সঙ্গে। 
মিনারের ভাষ্য, এই এলাকায় তারা সংখ্যায় ৫০ থেকে ৬০ জনের মতো। সবারই পেশা ছোটখাটো চুরি আর সুযোগ পেলে ছিনতাই। শুধু দুবেলা খাবার আর নেশার টাকা জোগাতেই তারা এসব অপরাধ করে। তবে পেটের খাবারের চেয়ে নেশার আহারই তাদের কাছে মুখ্য। 

মিনারসহ বাকিরা জানান, তারা আসলে কেউ কাউকে চেনেন না। পানির ওপর ভাসমান কচুরিপানার মতো ভাসতে ভাসতে তারা এক হয়েছেন। বাবা-মা থেকে শুরু করে আত্মীয়-স্ব^জন কেউ আছেন কি নাÑ সেটা জানার প্রয়োজনও তারা মনে করেন না। তারা জানেন, এভাবেই একদিন মৃত্যু ঘটবে এবং অজানা হিসেবেই মাটির তলে মিলিয়ে যেতে হবে। মাদকসেবীদের মধ্যে যারা মারা গেছেন, তারা অধিকাংশই একে অপরের পরিচিত, তবে আসল নাম-ঠিকানা কেউ জানেন না এবং জানলেও ঝামেলা মনে করে কাউকে বলেন না।  

তাদের সবারই অভিন্ন ভাষ্য, আমাদের শারীরিক অবস্থা এমন যে সামান্য আঘাতেই অসুস্থ হয়ে যাই। এটাও বুঝি, যে অবস্থাÑ তাতে আঘাতও লাগবে না। এমনিতেই মৃত্যু ঘটবে এবং সেটা ঘটছেও। যখন ঘুম বা ক্লান্তিতে চোখ বন্ধ হয়ে আসে তখন মনে হয়Ñ এই বুঝি পৃথিবীর আলো দেখা শেষ। সত্য বলতে, আমাদের ওপারে চলে যাওয়ার ভিসা হয়ে গেছে, টিকিট কাটাও শেষ। শুধু উড়াল দেওয়ার অপেক্ষা। এরপরও মাঝেমধ্যে মন চায়, আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসি। কিন্তু ইচ্ছা থাকলেও সেই প্রত্যাশা বোধ করি আর পূরণ হবার নয়। কারণ, আমরা ভবঘুরে আর বেওয়ারিশ।

কয়েকটি উদাহরণ
৩০ জুন ঢামেকের জরুরি বিভাগের পাশে পুলিশ ক্যাম্পের ১৫ গজ পাশে পাওয়া যায় অজ্ঞাত দুই যুবকের মরদেহ। জানা যায়, তারা মাদকসেবী ছিল। ২ জুলাই ঢাবি মধুর ক্যান্টিন এলাকা, ১০ এপ্রিল, ২৮ জুন, ২০ জুন, ১ জুলাইও এসব এলাকা থেকে চারজন মাদকসেবীর মরদেহ উদ্ধার হয়। ১০ এপ্রিল তো ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের খোদ প্রশাসনিক ভবন ফটকের সামনের ফুটপাত থেকে উদ্ধার হয় এক মাদকসেবীর মরদেহ। গত রোববার সকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের জরুরি বিভাগের ওয়ানস্টপ ইমার্জেন্সি সেন্টারের (ওসেক) পেছন থেকে আনুমানিক ২৬ বছর বয়সের অজ্ঞাতপরিচয় এক নারীর মরদেহ উদ্ধার করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। সর্বশেষ গতকাল মঙ্গলবারও শাহবাগ মোড় ট্রাফিক পুলিশ বক্সের পাশ থেকে অজ্ঞাতপরিচয় এক কিশোরের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।

আইন কী বলে? 
দেশে ভবঘুরে ও নিরাশ্রয় ব্যক্তি (পুনর্বাসন) আইন, ২০১১ নামে একটি আইন রয়েছে এই বেওয়ারিশ বা ভবঘুরেদের জন্য।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সমাজসেবা অধিদপ্তরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ভবঘুরে ও নিরাশ্রয় ব্যক্তি (পুনর্বাসন) আইন-২০১১, ১০(২) বিধি অনুযায়ী এদের আটক করে সমাজসেবা অধিদপ্তরের হেফাজতে দেওয়ার কথা। প্রকৃত নিরাশ্রয় ব্যক্তিদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও উল্লেখ আছে এ আইনে। আইনে বলা আছে, পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর পদমর্যাদার নি¤েœ নয় এমন কর্মকর্তা অথবা ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনো কর্মকর্তা, কোনো ব্যক্তিকে ভবঘুরে বলে গণ্য হলে ওই ব্যক্তিকে যেকোনো স্থান থেকে যেকোনো সময় আটক করে ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে ভবঘুরে আশ্রয়কেন্দ্রে পাঠাবেন। ভবঘুরে ও ভিক্ষায় নিয়োজিত মানুষদের সরকারি তত্ত্বাবধানে রেখে প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য উপায়ে সমাজে পুনর্বাসিত করার বিধানও রয়েছে। এই সেবা দেওয়ার জন্য, সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীন গাজীপুরে দুটি এবং নারায়ণগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, ময়মনসিংহ ও রাজধানীর মিরপুরে একটি করে দেশে মোট ছয়টি আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে।  কিন্তু বাস্তবে এই সেবা কজনার ভাগ্যে জুটছে। মাঝেমধ্যে ভিক্ষুকদের এই আইনের আওতায় আটক করা হলেও এই মাদকাসক্ত ভবঘুরেরা থাকে অনেকটাই ধরাছোঁয়ার বাইরে। আসলে নানা প্রতিকূলতার কারণেই তারা এটি করতে পারেন না বা করতে চান না। এই বিভাগকে জবাবদিহির আওতায় আনা হলেই এই সেবার মানও বাড়বে বলে তিনি মনে করেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক এ বিষয়ে রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, হাসপাতালগুলোয় প্রতিনিয়ত যে পরিচয়হীন লাশ পাওয়া যাচ্ছে সেটি জানান দেয়, এই মানুষগুলো অসহায় কিংবা পরিচয়হীন অথবা ঠিকানাহীন ভাসমান জনগোষ্ঠী। এসব মানুষের স্বাভাবিক কিংবা কোনো অপরাধের শিকার হয়ে মারা যাওয়ায় তাদের লাশ পাওয়া যাচ্ছে। এটি সমাজের মধ্যে যে অবস্থার ইঙ্গিত করছে, সেটি হচ্ছেÑ সমাজকে সব মানুষের সমাজ বা সব মানুষকে সমানভাবে এগিয়ে নেওয়ার যে উদ্যোগগুলো রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে থাকার প্রয়োজন তার যথেষ্ট ঘাটতি আছে। আমরা স্পষ্টত লক্ষ করছি, সমাজের সব মানুষের জন্য রাষ্ট্রের যে অঙ্গীকার বা প্রতিশ্রুতি, সেটি দুটি জায়গাতে খুব বহাল তবিয়তে আছেÑ একটা হলোÑ যারা রাষ্ট্রের বিভিন্ন দায়িত্বে থাকেন তাদের মুখে, আর একটি খাতা-কলমে। এর বাইরে এগুলোকে যে যথাযথভাবে

বাস্তবায়ন করা দরকার সে বিষয়ে দারুণ উদাসীনতা রয়েছে। সদিচ্ছার ঘাটতিও স্পষ্ট। 
তিনি আরও বলেন, আমরা সুবিধাবঞ্চিত মানুষকে উন্নয়নের সুবিধাভোগী হওয়ার কথা বলি বা উন্নয়নের অংশীজনে পরিণত করতে চাই। রাষ্ট্র এদের যদি আশার আলো দেখাতে না পারে, পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না করতে পারে, তাহলে এই অজ্ঞাতপরিচয়ের মরদেহের সংখ্যাটা বাড়বে। অজ্ঞাতপরিচয়ের মৃতদেহের সংখ্যা একটি সমাজের স্বাভাবিক স্থিতিশীলতাকে ইঙ্গিত করে না। যদি এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হয়, বুঝতে হবে সামাজিক সূচকে এগিয়ে যাওয়ার বা ন্যূনতম জীবনযাপনের নিশ্চয়তার প্রশ্নে সামাজিক সূচকে আমরা পিছিয়ে আছি। সে ক্ষেত্রে সরকারের উচিত, এই মাদকাসক্ত বা ভাসমান জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসনে যথাযথ ব্যবস্থা বা প্রকল্প করে সত্যিকারার্থে সেটি বাস্তবায়নের মাধ্যমে এসব মানুষের জীবনযাত্রার গুণগত পরিবর্তনে কাজ করা।

রূপালী বাংলাদেশ

Shera Lather
Link copied!